স্টাফ রিপোর্টার ॥ এবছর বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনকালে আমাদের মনে রাখতে হবে ২০২১ সাল বাংলাদেশের গণহত্যারও ৫০ বছর। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবির কারণে বর্তমান সরকার ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি, যা গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য অত্যন্ত জরুরী। নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে আমরা গত ১৫ বছর ধরে দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের জন্য আন্দোলন করছি। এই দুটি বিষয়ে অবিলম্বে সরকারীভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত ও রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সরকার, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং বিশিষ্ট নাগরিকরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার ভয়বতা ও ব্যাপকতা তুলে ধরে এর প্রতিবাদ করেছেন। নির্মূল কমিটি ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে সব সংগঠন ও ব্যক্তি কাজ করছেন তারাও বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরে গণহত্যাকারীদের বিচারের পক্ষে জনমত সংগঠিত করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগহীনতা দুর্ভাগ্যজনক। একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেছেন শাহরিয়ার কবির। শনিবার বিকেলে ‘বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানী গণহত্যাকারীদের বিচার’ শীর্ষক এই ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক ও সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে এই আলোচন সভার প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক। সভায় বক্তব্য প্রদান করেন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সভাপতি বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শিক্ষাবিদ শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সর্বইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সভাপতি মানবাধিকার নেতা তরুণকান্তি চৌধুরী, প্রজন্ম ’৭১-এর সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, নির্মূল কমিটির সুইজারল্যান্ড শাখার সভাপতি মানবাধিকার নেতা খলিলুর রহমান, নির্মূল কমিটির অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি ডাঃ একরাম চৌধুরী, নির্মূল কমিটির যুক্তরাজ্য শাখার নির্বাহী সভাপতি মানবাধিকার নেতা সৈয়দ এনামুল ইসলাম, নির্মূল কমিটির বেলজিয়াম শাখার সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেত্রী আনার চৌধুরী, দৈনিক সমকালের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আবু সালেহ রনি, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সিনিয়র রিপোর্টার সাংবাদিক আরাফাত মুন্না, ৭১ টিভির বিশেষ প্রতিনিধি সাংবাদিক মিল্টন আনোয়ার, দৈনিক ভোরের কাগজের ডেপুটি চীফ রিপোর্টার সাংবাদিক ঝর্ণা মনি ও নির্মূল কমিটি কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকার নেতা কাজী মুকুল।
ওয়েবিনারে শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেই একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে ৭২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন এবং তার শাসনামলে সাড়ে তিন বছরে এসব ট্রাইব্যুনালে আড়াই হাজারেরও বেশি ব্যক্তির বিচার হয়েছিল, যেখানে ৭৫২ জনকে মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- প্রদান করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে এই বিচার শুধু বন্ধ করেননি, সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর গণহত্যাকারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন, জেনারেল জিয়া পাকিস্তানকে তুষ্ট করার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তাদের দল করার সুযোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ জাতিকে বিভক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার মাশুল এখনও দিতে হচ্ছে। স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পর বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ও বিদেশের যাবতীয় বাধা অগ্রাহ্য করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই বিচার প্রক্রিয়া এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। কী কারণে দুটি ট্রাইব্যুনালকে কমিয়ে একটিতে নামিয়ে আনা হলো কী কারণে ট্রাইব্যুনালে এখনও পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী এবং গণহত্যাকারী অন্যান্য সংগঠনের বিচার হচ্ছে না তা আমাদের বোধগম্য নয়। ’৭১-এর গণহত্যার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার প্রাক্কালে আমরা আবারও দাবি জানাচ্ছি- অবিলম্বে ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানী গণহত্যাকারীদের বিচার শুরু করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোজাম্মেল হক বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতির মতো বিষয়গুলোতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-নির্মূল কমিটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসে। ‘বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ এখন জাতীয় দাবি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে নির্মূল কমিটির সহযোগিতায় কাজ করলে এই দাবি পূরণ হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের দূতাবাসগুলো বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যার নৃশংসতা, ভয়াবহতা বহির্বিশ্বের নিকট তুলে ধরার কাজে সর্বদা নিয়োজিত। তারপরেও আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি আছে। সরকারের বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরার ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি তার ভূমিকা সাফল্যের সঙ্গে পালন করছে। আমরা বিশ্বাস করি, যে জাতি তার ইতিহাসকে লালন করে না, সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। যে চার মূলনীতির ভিত্তিতে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এগুলোর একটিও থেকে বিচ্যুত হলে আমরা আর ঘুরে দাঁড়াতে পারব না। জাতির পিতার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার চেষ্টায় অঙ্গীকারবদ্ধ।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, এ ব্যাপারে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না যে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময় পাকিস্তানী হানাদার এবং তাদের বাঙালী দোসররা যে গণহত্যা, গণধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতন চালিয়েছিল তা এমন কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার চেয়েও প্রকট ছিল এই অর্থে যে নাৎসিরা চার বছরে ৬০ লাখ ইহুদীকে হত্যা করেছিল, অথচ বাংলাদেশে নয় মাস সময়ই ন্যূনতম পক্ষে ৩০ লাখ লোককে হত্যা করেছে। যদিও এটি বলা হয় আড়াই লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছে, কিন্তু নিরপেক্ষ হিসাব অনুযায়ী তাদের সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন জানিয়েছেন ধর্ষিতা মহিলার সংখ্যা ৫ লাখের কম নয়। আমাদের স্বাধীনতার পর পর চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ায় বাংলাদেশের গণহত্যা এখনও জাতিসংঘে স্বীকৃতি পায়নি। এখন পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমাদের এই দাবি নিয়ে নতুন করে এগোতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক লবি। এখনও নিশ্চয়ই পাকিস্তান এবং সে দেশের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু চীন আমাদের দাবির বিরোধিতা করবে। কিন্তু তার পরেও আমরা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সমর্থন আশা করতে পারি যদি যথোপযুক্ত লবি চালিয়ে যাওয়া যায়। এ ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফলপ্রসূ ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। ভারত এবং অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পথ খুলে যাবে। বাংলাদেশে গণহত্যায় অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের বিচারের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এমন ভূমিকা রাখতে হবে যাতে পাকিস্তানের ওপর বিভিন্ন দেশ চাপ সৃষ্টি করতে পারে।