ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার পরিত্যক্ত চরে শীঘ্রই জেগে উঠবে এক খণ্ড উপশহর

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

তিস্তার পরিত্যক্ত চরে শীঘ্রই জেগে উঠবে এক খণ্ড উপশহর

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ তিস্তার চরের সমৃদ্ধি এখন আর স্বপ্ন নয়। অচিরেই বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। মহাউন্নয়ন পরিকল্পনার মহাযজ্ঞ ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত দুই শ’ মেগাওয়াট সোলার বিদ্যুত উৎপাদন নির্মাণ পরিকল্পনা ছিল। সেই সোলার বিদ্যুত কেন্দ্রে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড ৩০ মেগাওয়াট উৎপাদন শুরু করেছে। সেনা কল্যাণ সংস্থা উৎপাদন করবে এক শ’ মেগাওয়াট। বেসরকারী খাতে ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে ৩০ মেগাওয়াট উৎপাদিত সৌর বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যোগ হতে যাচ্ছে। তিস্তা নদীর পরিত্যক্ত বালুচরের বুকে একখণ্ড উপশহর এখন প্রায় দৃশ্যমান। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার স্বপ্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় প্রায় ১২ লাখ হেক্টর বালুচরের জমি উদ্ধার হবে। এই জমি চাষাবাদে ব্যবহার হবে সৌর বিদ্যুতের সেচ দিয়ে। কমমূল্যে কৃষক সেচ সুবিধা পাবে। জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুতের চাপ কমবে। সৌর বিদ্যুত দিয়ে দিনেরবেলা সকাল ৮ টা হতে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত ছোট, বড়, মাঝারি, শিল্প কারখানা চলবে। সৃষ্টি হবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান। একই সাথে সমৃদ্ধশালী দেশের মর্যাদা পেতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য পরিবেশবান্ধব বিদ্যুত উৎপাদনের শর্ত পূরণে দেশ একধাপ এগিয়ে যাবে। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের শৈলমারীর দুর্গম পরিত্যক্ত ধুঁধু ৃ বালুচরে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লি. সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করেছে। প্রায় ১১০ একর বালুচরে প্রাথমিক পর্যায়ে ৩০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এবছর ৩০ সেপ্টেম্বর উৎপাদনে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু করোনার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আগামী ফেরুয়ারি মাসে উৎপাদনের ডেড লাইন ঘোষণা করেছে। কোম্পানির সাফল্যের ওপর সমৃদ্ধি নির্ভর করছে। প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লি. সৌর বিদ্যুত উৎপাদন খাতে বেসরকারী বিনিয়োগ করে ঝুঁকি নিয়েছে। আপাতদৃষ্টে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সফল করতে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ মনে হচ্ছে। এই বিনিয়োগ ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঝুঁকি হলেও সৌর বিদ্যুত কেন্দ্রের কারণে চরের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছে। সভ্যতা ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। সামাজিক কুসংস্কার ও বেকারত্ব কমেছে। নির্জন চর হতে বহু দূরের ৩টি গ্রামের প্রায় ১৬ হাজার মানুষ বিদ্যুত সেবার আওতায় এসেছে। প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলতে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন ৩-৪ শ’ শ্রমজীবী ও শুষ্ক মৌসুমে দৈনিক প্রায় দুই হাজার শ্রমিকের সোলার কেন্দ্রে কর্মসংস্থান হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও মানবেতর জীবন যাপনে অতিষ্ঠ ছিল চরের মানুষ। বিগত দিনের স্বৈরশাসকরা তিস্তাপাড়ের মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন নানা প্রতিশ্রæতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে চরবাসীর ভাগ্যের উন্নয়নে যুগোপযোগী কর্মপরিকল্পনা ছিল না, বরং চরের দুর্দশার কথা দেশে-বিদেশে প্রচার করে ত্রাণ এনে লুটপাট করে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন করেছেন। জনকল্যাণে ও সরকারের ব্যয় হ্রাসে ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লিমিটেড নিজ খরচে স্থাপিত দুই কিলোমিটার বৈদ্যুতিক সঞ্চালন লাইন স্থাপন করে নেসকো বিদ্যুত বিক্রি ও বিতরণে সহায়তা করেছে। ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার ৫৮টি সৌর প্লেট বসিয়ে তাদের দফতরে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে সোলার বিদ্যুত দিয়ে তারা কর্মকর্তার দফতরে এসি চালাচ্ছে। চরে এসি। ভাবতে অবাক লাগে। ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লি. সূত্রে জানা গেছে, সোলার কেন্দ্রে যাতায়াতে ও নির্মাণ সামগ্রী, ভারি যন্ত্রপাতি, যানবাহন, শ্রমিক-কর্মচারী পরিবহনে ইন্ট্রাকো কয়েক কোটি টাকা নিজ ব্যয়ে চরে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা, দুটি স্টীলের বেইলি ব্রিজ, ১৮টি কালভার্ট ও বক্সকালভার্ট নির্মাণ করেছে। সেতুর কাজ চলছে । নদী ভাঙ্গন রোধে ৪ কিমি সাইড ওয়াল নির্মাণ করেছে। নেসকো ৩টি চরে বিদ্যুত সংযোগ দিতে যাচ্ছে। সরকারের বা নেসকোর কোন অর্থ ব্যয় হয়নি। রাষ্ট্রের কয়েক শ’ কোটি টাকা সঞ্চালন লাইন স্থাপনে ব্যয় হ্রাস হয়। সৌর বিদ্যুত প্রকল্প ভাগ্য খুলছে। মানুষের হাতে সারাবছর কাজ থাকে। রাস্তাঘাট থাকায় চরবাসী এখন খুব সহজে দেশের নানা প্রান্তে যেতে পারবে। সৌরশক্তি নির্ভর সেচের দ্বিস্তর কৃষি প্রযুক্তি স¤প্রসারণ ও বহুমুখী ব্যবহারে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এই সোলার পাওয়ারে উৎপাদিত বৈদ্যুতিক শক্তি জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়ে ক্রমবর্ধমান বিদ্যুত চাহিদা নিরসন করবে। প্রাকৃতিক শক্তির আধার নবায়নযোগ্য সৌরশক্তি। দেশে সূর্যালোকের প্রাচুর্য সংরক্ষণ করে রাত্রিকালীন বিদ্যুত উৎপাদন ব্যয় সাপেক্ষ। রাতে সৌরশক্তি নয়। সৌরশক্তি সরাসরি দিনেরবেলায় ব্যবহার লাভজনক। সৌরশক্তির উৎপাদন খরচ কুইক রেন্টালের চেয়ে কম। দিনেরবেলা সৌরশক্তিতে সেচপাম্পসহ গৃহস্থালি চলবে। সৌরশক্তি শতভাগ পরিবেশবান্ধব। বহু দেশ সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ও পরিবেশগত ক্ষতি সম্পর্কে অগ্রীম চিন্তা করেনি। নগরায়ন পরিবেশের ক্ষতি করেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্রতা রক্ষা করে উন্নয়ন করতে হবে। এই অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সৌর বিদ্যুত প্লান্ট জোরালো ভূমিকা রাখবে। ইন্ট্রাকো সোলার পাওয়ার লি. কেন্দ্রের প্লান্ট ইনচার্জ প্রকৌশলী মোঃ আক্তারুজ্জামান জানান, জোগেন বানিয়ার ঘাট ও জামির বাড়ি ঘাট দুটি এই পাওয়ার প্লান্টের খুব কাছে। এই ঘাট দুটির মানুষ যাতাযাতে সুবিধা পাবে। কোম্পানির নিজ অর্থায়নে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি এ্যাপ্রোজ লোহার ব্রিজ ( দৈঃ ২৭.০৫ মিটার ও প্রঃ ৪ মিটার) নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে সৌর বিদ্যুত কেন্দ্র পুরোদমে বিদ্যুত উৎপাদনে যাবে। সেচ মৌসুমকে র্টাগেট করে জোরেশোরে ফিনিশিং কাজ চলছে। সোলার পাওয়ার প্যানেলের প্লেটগুলোর মাঝখানের ফাঁকা জায়গা মৎস্য, পশু পালন, ছোট ছোট ফলের বাগান, নানা জাতের সবজি চাষ করা হবে। এখানে কার্বন নিঃসরণের হার শূন্য থাকবে। সোলার প্লান্টের চারধারে ও আবাসিক চত্বরে সবুজের সমারোহ থাকবে। যা পর্যটনকে আকর্ষণ করবে। তৈরি করা হবে রিসোর্ট। কর্মকর্তাদের বসবাসে বাংলোবাড়ি, কোয়ার্টার। চরের বুকে ছোটখাটো শহর হবে। এই প্রজেক্টের পাশাপাশি সেনা কল্যাণ সংস্থার অধীনে ৪শ’ একর জমির ওপর ১শ’ মেগাওয়াট পৃথক আরেকটি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সেনা কল্যাণ সংস্থা। তাদের দফতর ও সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে।
×