ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছন্দ ফিরেছে জীবনে ॥ স্বস্তি ব্যবসা বাণিজ্যেও

প্রকাশিত: ২১:৪০, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ছন্দ ফিরেছে জীবনে ॥ স্বস্তি ব্যবসা বাণিজ্যেও

এম শাহজাহান ॥ কঠোর বিধিনিষেধের পর মহামারী করোনার প্রকোপ কমে আসায় আবার সব কিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে আসায় আতঙ্ক কেটে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। শ্রমজীবী মানুষ আবার কাজকর্মে ফিরে এসেছেন। ঘুরছে উৎপাদনমুখী শিল্পের চাকা। জীবন-জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে সবাই বের হওয়ায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে পরিবহন চলাচল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প খাতে গতি ফিরে এসেছে। দোকানপাট, মার্কেট ও শপিংমলে বেচাকেনা শুরু হয়েছে পুরোদমে। দেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে ছুটে যাচ্ছেন পর্যটকরা। ঘরে-বাইরে নির্বিঘ্নে কাজ করছেন কর্মজীবী মানুষ। দীর্ঘ অচলাবস্থার পর সব ধরনের কর্মকান্ড বাড়ায় গতি ফিরছে দেশের অর্থনীতিতে। ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। গত বছরের এই সময়ের তুলনায় এবার শুধু আগস্ট মাসে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ফের চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বাড়ছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। অভ্যন্তরীণ বাজারে কমেছে চালের দাম। ভোজ্যতেল চিনি এবং ডালের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জানা গেছে, মহামারী করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি দেশের প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি মানুষকে দ্রুত করোনার ভ্যাকসিন দেয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সোর্স থেকে ২৬ কোটির বেশি ভ্যাকসিন কেনার জন্য সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারাদেশে শুরু হয়েছে গণহারে টিকা কার্যক্রম। এর ফলে করোনা নিয়ে মানুষের আতঙ্ক কেটে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি এক বৈঠক শেষে জানান, দ্রুত অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে দেশের সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন দেয়া হবে। এজন্য চীনের সিনোফার্ম থেকে টিকা আমদানি এবং দেশে টিকা উৎপাদন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চীনের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার, মডার্না এবং জাপান থেকে এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেশে আনা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের জনগণকে টিকা দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড আবার স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশও সেই পথে হাঁটছে। করোনাভীতি কেটে যাওয়ায় অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হওয়ার পর এবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। করোনা অতিমারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত ১৯ আগস্ট কক্সবাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতসহ সকল পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। আবারও প্রাণ ফিরে এসেছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত সৈকত ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো। আবারাও চেনারূপে ফিরে এসেছে সৈকত। বেড়েছে পর্যটক ও স্থানীয় দর্শনার্থীদের ভিড়। সারাদেশে পর্যটন খাতে আবার গতি বাড়তে শুরু করেছে। এতে করে স্বস্তির হাসি ফুটেছে পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের মাঝে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনেকেরই রয়েছে অনীহা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দোকানপাট, শপিংমল, অফিস-আদালত, ছোট-বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, শিল্পকারখানা ও সড়ক, নৌ, রেল, আকাশপথের পরিবহনসহ সব কিছু খুলে দেয়ায় বিভিন্ন শ্রেণী- পেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে। এছাড়া পুঁজিবাজার খ্যাত শেয়ারবাজারেও শুরু হয়েছে উর্ধমুখিতা। ব্যবসা-বাণিজ্যের সব খাত স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফিরে গেছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, কঠোর বিধিনিষেধের পর এখন পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গণহারে করোনা ভ্যাকসিন কার্যক্রম শুরু হওয়ার কারণে মানুষের আতঙ্ক ও উদ্বেগ কমে গেছে। এছাড়া এখন সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমে গেছে। এ কারণে দ্রুত দেশের সবাইকে করোনার ভ্যাকসিন দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে অর্থনীতির সকল খাত পুরোদমে চালু করতে হবে। করোনার পাশাপাশি এখন আরেক সঙ্কট ডেঙ্গু। মশাবাহিত এই রোগ থেকে বাঁচতেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে অবশ্যই করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে ॥ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কারণে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরে এসেছে। এ কারণে চাঙ্গা হচ্ছে অর্থনীতি। উৎপাদনমুখী গার্মেন্টস, কৃষি, চামড়া. মৎস্যসহ সকল খাতে এখন পুরোদমে কাজ হচ্ছে। এ কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বাড়ায় চাপ বাড়ছে ডলারের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ফের চাঙ্গা হয়ে উঠছে। বাড়ছে আমদানি-রফতানি। ব্যাংকগুলোতে বেড়েছে ডলারের চাহিদা। চলতি ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে জুন প্রান্তিকে দেশী-বিদেশী ১৮৪টি শিল্প ইউনিট স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড-বিডা। গতবছর একই সময়ে নিবন্ধিত হয়েছিল মাত্র ৪৬টি প্রতিষ্ঠান। বিডার বিনিয়োগ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৮৪টি দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ১৪ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। যা ২০২০ সালের একই সময়ের তুলনায় ৮ হাজার ৪৪৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুন শেষে আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৫ শতাংশ। আগস্ট শেষে রফতানি প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংকের কাছেই পর্যাপ্ত ডলার নেই। ডলারের চাহিদা মেটাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. জায়েদ বখত বলেন, খাদ্যপণ্য আমদানি বেড়েছে। টিকা আনতেও টাকা লাগছে। রফতানিও বেড়েছে। আর এ কারণেই ডলারের চাহিদা বাড়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে। এদিকে, করোনা মহামারী সত্ত্বেও দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাময়িক হিসেবে মাথাপিছু আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়ে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার হয়েছে। বেড়েছে রফতানি আয় ॥ করোনার মধ্যেও গত আগস্ট মাসে ৩৩৮ কোটি ডলারের বা ২৮ হাজার ৭৩০ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ শতাংশ বেশি। গত আগস্টে ২৯৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। তবে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি। এ তথ্য প্রকাশ করেছে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, গার্মেন্টস খাতে এখন প্রচুর অর্ডার আছে। অর্ডার অনুযায়ী গার্মেন্টসগুলো পণ্য ডেলিভারি দিতে সক্ষম হলে আবার এ খাতে প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হবে। তবে গত কয়েক মাসে গার্মেন্ট খাতে বেশ চাপ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে করোনা মহামারীর মধ্যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি আয়ের উৎস চামড়া খাতে। এছাড়া গত দুই মাসে করোনা মহামারীর মধ্যেও বড় প্রবৃদ্ধি করেছে হিমায়িত চিংড়ি রফতানিতে। বিভিন্ন কৃষিপণ্য রফতানি করে চলতি অর্থবছরের দুই মাসে বাংলাদেশ ২০ কোটি ৭২ লাখ ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কম অর্জিত হয়েছে। এছাড়া দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারও স্থিতিশীল হয়ে আসছে। বিশেষ করে চালের দাম কমে আসায় বাজারে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে ভোজ্যতেল, চিনি ও ডালের দাম বাড়ায় ভোক্তাদের কষ্ট বেড়েছে। শীঘ্রই এসব পণ্যের দাম কমানোর কিছু পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র।
×