ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাইবার প্যাট্রোলিংসহ গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি

আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণের উস্কানি

প্রকাশিত: ২২:১৩, ৪ আগস্ট ২০২১

আফগানিস্তানে গিয়ে জঙ্গী প্রশিক্ষণের উস্কানি

শংকর কুমার দে ॥ ‘মুজাহিদ ভাই, চলেন আফগান যাই’-এই স্লোগানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ায় সাইবার প্যাট্রোলিংসহ নজরদারি শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে খুশি হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশের সঙ্গে আফগানমুখী মুজাহিদ তৈরিতে উস্কানি দেয়ার কোন যোগসূত্র খুঁজে দেখাই হচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থার উদ্দেশ্য। অনলাইনে জঙ্গীবাদে উস্কানি দিয়ে আফগানিস্তানে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপরতা চালাতে পারে দেশীয় উগ্রবাদী জঙ্গী গোষ্ঠী। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’-প্রবাদের মতো ‘মুজাহিদ ভাই, চলেন আফগান যাই’ স্লোগানটির সঙ্গে ভয়াবহ জঙ্গীবাদের তৎপরতা জড়িত। জঙ্গীবাদের অজানা আতঙ্ক, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়ভীতির জন্ম দেয়া স্লোগানটির উৎসের সন্ধানে মাঠে নেমেছে গোয়েন্দারা। কারণ ‘মুজাহিদ ভাই, চলেন আফগান যাই’, দেশীয় উগ্রবাদী ও জঙ্গী সংগঠনের সাম্প্রতিক অনলাইন প্রচারণার বিষয়টি জঙ্গীবাদে উস্কানি দিয়ে আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ানোর তৎপরতা চালাচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠী। আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে ফেরত এসে জঙ্গীবাদের তৎপরতা চালানো হলে তা হবে দেশের জন্য ভয়াবহ করুণ পরিণতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আফগানিস্তানে তালেবান উত্থানে খুশি হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশের পাশাপাশি তাদের প্রশংসা করার ঘটনাটি খুবই উদ্বেগজনক। মূলত তালেবানের উত্থানে দেশের জঙ্গী সংগঠন ও উগ্রাবাদীদের মধ্যে একধরনের উৎসব উৎসব ভাব দেখছে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জঙ্গী সংগঠন এবং জঙ্গীদের অনলাইন ও অফলাইনে সাংগঠনিক আলাপে এখন আফগান প্রসঙ্গই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, আশির দশকে বাংলাদেশে প্রথম স্লোগান শোনা যায়, ‘আমরা হব তালেবান-বাংলা হবে আফগানিস্তান’। এই স্লোগান দিয়ে আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে তরুণ, যুবক, কিশোরদের জঙ্গীবাদে উস্কানি দিয়ে আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়ার নজির বিদ্যমান। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে জঙ্গীবাদের প্রকাশ্য উত্থানের সময়েও ‘আমরা হব তালেবান-বাংলা হবে আফগানিস্তান’ স্লেøাগানটি সামনে চলে আসে। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে উগ্রবাদী ইসলামী দলগুলোর মিটিং মিছিল থেকে প্রকাশ্যে আসা এই স্লোগানের অন্যতম উদ্যোক্ত ছিলেন প্রায়ত শায়খুল হাদিস আজিজুল হক। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই স্লোগানটি মৃতপ্রায় থেকে উঠিয়ে আনে হেফাজতে ইসলাম। চলতি বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিবিরোধী মিছিল ও স্লোগানের সময়ে হেফাজতের নেতৃত্বে তরুণরা এই স্লোগান দিয়ে মাঠ গরম করেছে। এখন আবার আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার সৈন্যদের প্রত্যাহার করে নেয়ার ঘোষণা দেয়ার পর আফগানিস্তানের প্রায় আশিভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে সশস্র আফগান মুজাহিদরা। আফগানিস্তনে মুজাহিদদের জয়জয়কারের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জঙ্গীবাদে উস্কানি দিয়ে দলে দলে আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়ে মুজাহিদ প্রশিক্ষণ দেয়ানোর পর বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে নড়ে চড়ে বসেছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে দেশের জঙ্গীদের কেউ কেউ আফগানিস্তান যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আফগানিস্তানে যাওয়ার দাওয়াত দিতে দেখা যাচ্ছে কাউকে কাউকে। আবার কেউ কেউ আফগানিস্তানে তালেবানের দখলের ভিডিও ও ছবি প্রকাশ করে প্রশংসায় ভাসাচ্ছে। তবে যুদ্ধ করতে দেশের জঙ্গীদের কেউ গত দুই-তিন মাসে আফগানিস্তানে গিয়েছে এমন তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর খতিয়ে দেখছে। বাংলাদেশ থেকে এনজিওসহ বিভিন্ন কাজে আফগানিস্তানে যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। অনলাইনে দেশীয় জঙ্গী সংগঠনগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নজরদারি বৃদ্ধি করেছে নেট দুনিয়ায়। তারা বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করছে। এ্যাপস নির্ভর যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে জঙ্গীরা নিজেদের সংগঠিত করে কাজ করার কথা বলছে। কেউ আফগানিস্তানে যাওয়ার চেয়ে নিজ দেশে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দেয়ার কথা বলছে। এই গোষ্ঠীটি আফগানিস্তানে তালেবানের জয় দেখতে পাচ্ছে, তাই সেখানে এই মুহূর্তে যাওয়ার দরকার নেই বলেও মনে করছে। তারা কেবল অনলাইনে তালেবানদের প্রশংসা করেই দায় সারছে। তালেবানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে চীন, ভারত, আমেরিকাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিকদের বৈঠকের ছবি শেয়ার ও প্রকাশ করছে দেশের উগ্রবাদীরা। এসব ছবিতে বিভিন্ন ক্যাপশন দিয়ে নেট দুনিয়ায় ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের পুরনো জেএমবির যেসব সদস্য ভারতে লুকিয়ে আছে সেই গ্রুপটি আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা মাঝেমাঝেই এই চেষ্টা করেছে, কেউ কেউ সফলও হয়েছে। তাদের সঙ্গে দেশীয় নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের কোন কোন সদস্য সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। তবে তারা সফল হয়েছে- এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে জঙ্গীদের মধ্যে সবসময় যেমন অনলাইনে প্রচার, হুমকি ও আলোচনা হয়, তা আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। পৃথিবীর যেখানেই জঙ্গীবাদ বা জঙ্গীসংগঠন সফল হবে, অন্য প্রান্তের জঙ্গীরা খুশি হবে। তারাও সেভাবে কাজ করার চেষ্টা করবে। তবে একই কাজ করার সক্ষমতা সকল জঙ্গী সংগঠনের থাকে না। দেশে জঙ্গী সংগঠনগুলোরও নেই। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে সেই সক্ষমতা তারা হারিয়েছে। তবে মতাদর্শের কারণে কেউ কেউ চেষ্টা করবে, তাদের নজরদারিতে রাখতে হচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, আফগানিস্তানের তালেবানের সঙ্গে সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখিয়েছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে তালেবানরাও। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করছে তাদের এই নীতির পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী জঙ্গীবাদ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তালেবানরা ঘোষণা দিয়েছে, আফগানিস্তানের জমি ব্যবহার করে কেউ অন্য কোন রাষ্ট্রের ক্ষতি করতে পারবে না। তালেবানদের এই নীতি অব্যাহত থাকলে, দেশে জঙ্গী সংগঠনগুলোর ধ্বংসাত্মক কাজ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেও মনে করা হচ্ছে। ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানের কাছাকাছি অনেকে বলে, তবে তাদের সঙ্গে আমাদের ভাষার কোন মিল নেই, সংস্কৃতির মিল নেই, খাদ্যাভ্যাসে মিল নেই। চিন্তা চেতনাতেও মিল নেই। তাই তালেবান উত্থানে হঠাৎ করে যে তীব্র পরিবর্তন হবে দেশের জঙ্গী সংগঠনগুলোর, তা মনে করার কোন কারণ নেই। চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বিদেশী সেনার আফগানিস্তান ছাড়ার কথা রয়েছে। দেশটি থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার হলে তালেবান আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে বলে জোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক আফগানিস্তান থেকে চুক্তি অনুযায়ী অধিকাংশ মার্কিন সেনা দেশে ফিরে গেছে। ন্যাটো বাহিনীও আর নেই। এই অবস্থায় আফগানিস্তান জুড়ে আক্রমণ জোরদার করেছে তালেবান। ইতোমধ্যেই অনেকগুলো জেলার দখল নিয়ে নিয়েছে। সদ্য দখল করা এসব অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ চালাচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠীটি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, বাংলাদেশ এখনই তালেবানের সঙ্গে কোন কূটনৈতিক সম্পর্কে যাবে না। বাংলাদেশ বর্তমান বৈধ আফগান সরকারের সঙ্গেই কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখবে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সরকার। গত ২৬ মার্চ ঢাকায় এসে গেছেন মোদি। তার আগমনকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্নস্থানে সহিংস সন্ত্রাসের সঙ্গে মিটিং, মিছিল করে নাশকতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরিতে উস্কানি দিয়েছেন উগ্রপন্থী মৌলবাদী গোষ্ঠী। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠনের বিক্ষোভে বাংলাদেশকে আফগানিস্তানে পরিণত করার হুমকি দেয়া হয়েছে। নিজেদের তালেবানের মতো জঙ্গীতে রূপান্তরের কথাও জানানো হয়েছে। বিক্ষোভে নানা জন নানা রকমের বক্তব্য দেন। এর মধ্যে মাইক হাতে বক্তব্য দেয়া হয়েছে, ‘যদি মোদিকে আসতে দেয়া হয়, তাহলে আমরা সবাই সন্ত্রাসে পরিণত হব। আমরা ওসামা বিন লাদেনের মতো হুঙ্কার দিয়ে উঠব। আমরা কোন বাধা মানব না। আমরা রাসুলসেনা, ভয় করি না বুলেট বোমা। বুলেট বোমাকে ভয় করি না আমরা। বাংলা হবে আফগান, আমরা হব তালেবান।’ সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই বক্তব্য গোয়েন্দা সংস্থার সংগ্রহে আছে বলে কর্মকর্তার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আফগানিস্তানে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অংশগ্রহণে তালেবান জঙ্গীরা বেশ প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। ৯০ দশকের শেষ দিকে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাও দখল করে নেয়। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার পর আফগানিস্তানে জঙ্গীবিরোধী অভিযান শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান আমরিকা দেশটি। সে সময়ও কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের নেতারা ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান দিয়ে সভা সমাবেশ করে। সে সময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নেতা ফজলুল হক আমিনী পল্টন ময়দানে হাতে তলোয়ার নিয়ে উপস্থিত হয়ে এই স্লোগান দেন ‘আমরা হব তালেবান, বাংলা হবে আফগান’। এখন আবার সেই একই কায়দায় ‘মুজাহিদ ভাই, চলেন আফগান যাই’-অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্লোগানটি ভাইরাল করে দিয়ে দলে দলে আফগানিস্তান গিয়ে মুজাহিদের প্রশিক্ষণ নেয়ার উস্কানি দিচ্ছে জঙ্গী গোষ্ঠী। জঙ্গী তৎপরতার বিষয়গুলোর সাইবার প্যাট্রোলিং করাসহ গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হচ্ছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।
×