ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বর্ণাঢ্য উদ্বোধন টোকিওয় ॥ চার ইভেন্টে অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশের ছয় এ্যাথলেট

পর্দা উঠল অলিম্পিকের

প্রকাশিত: ২২:১১, ২৪ জুলাই ২০২১

পর্দা উঠল অলিম্পিকের

জাহিদুল আলম জয় ॥ বিশ্বের বৃহত্তম ক্রীড়া আসর অলিম্পিক গেমস। এই আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও যে কোন ক্রীড়া আসরের চেয়ে মনোমুগ্ধকর, নয়নাভিরাম, জমকালো, বর্ণিল হয়ে থাকে। যে কারণে অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৃষ্টি থাকে গোটা দুনিয়ার। এবারের ৩২তম টোকিও অলিম্পিকও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আয়োজক জাপানের দুর্ভাগ্য- বর্ণিল আলোকসজ্জা, নিজেদের নানা সংস্কৃতি ফুটিয়ে তোলাসহ সব আয়োজন করার পরও মনের মতো করে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতে পারেনি সূর্যোদয়ের দেশ। পারবে কি করে! মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে পরিকল্পনা ও অনুষ্ঠানমালায় অনেক পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছেন আয়োজকরা। এরপরও জমকালো ও বর্ণিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে পর্দা উঠেছে টোকিও অলিম্পিক গেমসের। টোকিও’র অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গেমসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জাপানের রাজা নারুহিতো। এর ফলে ভয়, আতঙ্ক আর অদৃশ্য ভাইরাসের শঙ্কা সঙ্গী করেই পথচলা শুরু হয়েছে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থের’। অবশ্য আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দু’দিন আগেই কয়েকটি ইভেন্টের খেলা মাঠে গড়িয়েছে। বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় শুরু হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, এমপি। তিনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগদান ও খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতে টোকিও গেছেন। সন্ধ্যা ৭টা ৩ মিনিটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মার্চপাস্টে আসেন বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা। মার্চপাস্টে লাল-সবুজের পতাকা বহন করেন সাঁতারু আরিফুল ইসলাম। এবারের আসরে বাংলাদেশের ছয় খেলোয়াড় চার ইভেন্টে প্রতিন্দ্বিতা করছেন। এরা হলেন- আরচারিতে রোমান সানা ও দিয়া সিদ্দিকী। শূটিংয়ে আব্দুল্লাহ হেল বাকী। সাঁতারে আরিফুল ইসলাম ও জুনাইনা আহমেদ। আর এ্যাথলেটিক্সে জহির রায়হান। করোনা মহামারীতে গোটা দুনিয়ায় অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এখনও এ ধারা অব্যাহত আছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই করোনায় নিহতদের উদ্দেশে সমবেদনা জানিয়ে নীরবতা পালন করা হয়। গত বছর হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে পিছিয়ে যায় টোকিও অলিম্পিক। ভিলেজের মধ্যে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ায় এবারও শেষ মুহূর্তে আসর বাতিল হওয়ার শঙ্কা জেগেছিল। শেষ পর্যন্ত গেমস শুরু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে সবার মাঝে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আসরের আয়োজক জাপানের সংস্কৃতি বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এবারের অলিম্পিকে ৩৩টি খেলার ৫০টি ডিসিপ্লিনে ৩৩৯টি ইভেন্টে ২০৫ দেশের ১১৩২৬ ক্রীড়াবিদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। টোকিও’র অলিম্পিক স্টেডিয়ামে দর্শক ধারণক্ষমতা ৬৮ হাজার। করোনা মহামারী না থাকলে দর্শক টইটম্বুর গ্যালারিতে হতো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। কিন্তু অদৃশ্য ভাইরাসের শঙ্কায় দর্শকবিহীন মাঠে হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মাঠের লড়াইয়েও স্টেডিয়ামে থাকতে পারবেন না ‘খেলার প্রাণ’ দর্শকরা। গ্যালারিতে বসে দেখার সুযোগ না পেলেও হাজার হাজার উৎসাহী দর্শক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সময় অলিম্পিক স্টেডিয়ামের বাইরে জড়ো হন। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের দর্শকের মতো টিভিতেই তাদের দেখতে হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের কোটি কোটি দর্শক টিভিতে সরাসরি দেখেছেন। দর্শকবিহীন হলেও আমন্ত্রিত অতিথি, কর্মকর্তা ও আয়োজক কমিটির বাছাইকৃতসহ কয়েক শ’ ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। করোনার কারণে কঠোর নিয়ম ও স্বাস্থ্যবিধি তৈরি করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী প্রতিটি দেশের এ্যাথলেটরাই মার্চপাস্টে অংশগ্রহণ করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এটি। আয়োজক কর্মকর্তা-কর্মচারী, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কলা-কুশলীসহ আরও কয়েক হাজার মানুষ জড়িত ছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে। ঐতিহ্যগতভাব অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে বর্ণিল ও জমজমাট। কিন্তু এবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বেশ কিছু গাইডলাইন তৈরি করে আয়োজকরা। অলিম্পিক প্যারেডের সময় এ্যাথলেটদের উপস্থিতি করা হয়েছে ঐচ্ছিক। কর্মকর্তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ জন উপস্থিত থাকতে পেরেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সাংস্কৃতিক পর্বও হয়েছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দিনে মাঠের লড়াই শুরু হয়েছে বাংলাদেশের। আরচারির রিকার্ভের মিশ্র ইভেন্টের চূড়ান্তপর্বে খেলার টিকেট নিশ্চিত করেছে লাল-সবুজের দেশ। এই ইভেন্টে বিশ্বের ২৯টি দেশের তীরন্দাজরা লড়াই করেছেন। এর মধ্যে চূড়ান্তপর্বে খেলার সুযোগ পেয়েছে ১৬টি দেশ। বাংলাদেশ ১৬তম অর্থাৎ সর্বশেষ দল হিসেবে চূড়ান্ত পর্বে খেলার টিকেট কেটেছে। এই ইভেন্টের জন্য অবশ্য আলাদাভাবে কোন বাছাই প্রতিযোগিতা হয়নি। রিকার্ভের এককে অংশ নেয়া প্রতিটি দেশের পুরুষ ও নারী তীরন্দাজর সম্মিলিত পয়েন্ট যোগ করেই সে দেশের চূড়ান্ত স্কোর নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসেবে ছেলেদের এককে খেলা রোমান সানা বাছাইপর্বে পেয়েছেন ৬৬২ পয়েন্ট। ৬৪ জনের মধ্যে রোমান হয়েছেন ১৭তম। আর দিয়া সিদ্দিকীর ৬৩৫ পয়েন্ট। হয়েছেন ৩৬তম। দু’জনের মোট সংগ্রহ ১২৯৭। যা বাংলাদেশের মিশ্র ইভেন্টের পয়েন্ট। এখন কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ র‌্যাঙ্কিংয়ের ২৯ দলের মধ্যে শীর্ষে থাকা দক্ষিণ কোরিয়া। এককে রোমানের প্রতিপক্ষ গ্রেট ব্রিটেন এবং দিয়ার প্রতিপক্ষ বেলারুশের কারিনা দিওমিনস্কায়া। রোমান সানা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার আর কোন দেশের আরচাররা থাকতে পারেননি সেরা ২০-এর মধ্যে। ওয়ার্ল্ড আরচারি ওয়েবসাইটে দেয়া সাক্ষাতকারে রোমান জানিয়েছেন, ‘সবকিছুই পরিকল্পনামতো হয়েছে। যদিও এখানে সামান্য বাতাস ছিল। তবে আর সবকিছু ঠিক ছিল। যেভাবে খেলেছি সেটা ভালই লেগেছে।’ এবারের আসর হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ২৪ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে গত বছর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। অনেক শঙ্কা থাকলেও এক বছর পর গেমস আয়োজন করছে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। কঠোর স্বাস্থবিধি মেনে হচ্ছে এবারের যজ্ঞ। এরপরও করোনা সংক্রমণের ভীতি কাজ করছে সবার মাঝে। ইতোমধ্যে শতাধিক এ্যাথলেট ও কর্মকর্তার আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এমন প্রতিবন্ধকতার পরও শেষ পর্যন্ত সফল আয়োজনে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এশিয়ার দেশ জাপান। টোকিও এর আগে ১৯৬৪ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজন করেছিল। এবার পঞ্চম শহর হিসেবে দ্বিতীয়বার বৃহৎ এ ক্রীড়াযজ্ঞ আয়োজন করছে টোকিও। আর এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র দেশ হিসেবে দ্বিতীয়বার এ কৃতিত্ব দেখাচ্ছে জাপান। এর পাশাপাশি টোকিও এবারের গ্রীষ্মকালীন প্যারালিম্পিকও আয়োজন করবে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে অলিম্পিক শুরু হলেও আধুনিক অলিম্পিকের যাত্রা শুরু ১৮৯৬ সালে গ্রিসে। এরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধের কারণে আয়োজনে ছেদ বাদ দিলে (তিনবার- ১৯১৬, ১৯৪০ ও ১৯৪৪) এখন পর্যন্ত নিয়মিতই হয়ে আসছে ক্রীড়াবিশ্বের সবচেয়ে বড় আসরটি। প্রাচীন অলিম্পিক গেমসের প্রায় ১৫০০ বছর পর অলিম্পিক গেমস আয়োজনের জন্য এগিয়ে আসেন এক ফরাসী যুবক। নাম ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিন। তাঁকেই আধুনিক অলিম্পিকের জনক বলা হয়। পিয়েরে সাত বছর বয়সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছিলেন। তাই তিনি সারাবিশ্বে শান্তির বারতা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ক্রীড়াকে বেছে নেন এবং অলিম্পিক গেমসকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেন। সৌহার্দ্য, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা এবং একটি শান্তির বিশ্ব- এ সবই ছিল কুবার্তিনের চিন্তা-ভাবনায়। এ চেতনার ফসল হিসেবে ১৮৯২ সালে কুবার্তিন ৯টি দেশের ৭৯ প্রতিনিধিকে নিয়ে এক সভা করেন। সেখানে তাঁর মতামত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলে গঠন করা হয় একটি আন্তর্জাতিক কমিটি। যা পরে রূপ নেয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি)। এরপর ১৮৯৬ সালে গ্রিসের এথেন্সের প্যানাথেসিয়াস স্টেডিয়ামে উদ্বোধন হয় প্রথম আধুনিক অলিম্পিক গেমসের। ১৪ দেশের ২৪১ এ্যাথলেট এ গেমসে অংশ নেন। ইভেন্ট ছিল ৪৩টি। সেই থেকে যাত্রা শুরু আধুনিক অলিম্পিকের। ক্রীড়াবিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মিলনমেলায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের লড়াই হবে মূলত যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন ও চীনের মধ্যে। স্বাগতিক হওয়ায় জাপানও এবার নিজেদের ইতিহাসের সেরা সাফল্যের স্বপ্ন বুনছে। যেমনটি ২০০৮ বেজিং অলিম্পিকে চীন করেছিল। ওই আসরে মার্কিন সাম্রাজ্য গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নিয়েছিল এশিয়ার গর্বের প্রতীক চীন। সেবার ৫১ স্বর্ণসহ ১০০টি পদক জিতে সবার সেরা হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি। মোট ১১০টি পদক জিতলেও স্বর্ণসংখ্যা (৩৬) কম হওয়ায় দ্বিতীয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে অবশ্য এই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি চীন। আবারও শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেবার দ্বিতীয় হয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন আর তৃতীয় হয় চীন। পাঁচ বছর পর এবার আরেকবার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হচ্ছে দেশগুলো। বরাবরের মতো এবারও অলিম্পিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে লাল-সবুজের এই দেশ। যেখানে অংশ নিচ্ছেন ছয় প্রতিযোগী। অলিম্পিকের ইতিহাসে এটি ৩২তম আসর হলেও বাংলাদেশের জন্য দশম। ১৯৮৪ সালে লস এ্যাঞ্জেলস অলিম্পিক দিয়ে স্বপ্নের ক্রীড়াযজ্ঞে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ শুরু হয়। আগের আসরগুলোতে পদক দূরে থাক, পদক জয়ের সম্ভাবনাও সৃষ্টি করতে পারেনি বাংলাদেশের কোন এ্যাথলেট। তবে এবার সেই বন্ধ্যত্ব ঘোচানোর স্বপ্ন বুনছেন কয়েকজন। এর মধ্যে অন্যতম তারকা আরচার রোমান সানা।
×