ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

উৎপাদননির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা হবে

স্ব-কর্মসংস্থানে ৭ কর্মসূচী বাস্তবায়ন হবে

প্রকাশিত: ২৩:১৬, ২৪ জুন ২০২১

স্ব-কর্মসংস্থানে ৭ কর্মসূচী বাস্তবায়ন হবে

এম শাহজাহান ॥ চাকরির পেছনে না ছুটে স্ব-কর্মসংস্থানে সারাদেশে ব্যাপক ভিত্তিতে ৭ কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হবে। এ লক্ষ্যে বাড়ানো হবে উৎপাদন। রফতানি বাড়াতে আগামী এক দশকে পুরোপুরি উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতির দেশ হবে বাংলাদেশ। কর্মসূচীগুলো হচ্ছে- নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, অনলাইনভিত্তিক আউট সোর্সিং কাজ, কর্মীর দক্ষতা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা সম্প্রসারণ, কৃষিকাজ যান্ত্রিকীকরণ, এগ্রো প্রসেসিং শিল্প স্থাপন এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। এসব কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারীভাবে আর্থিক সহায়তা প্রণোদনা প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের অধিক তরুণ সমাজ। এসব তরুণদের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিষয়ভিত্তিক কর্মসংস্থানের নীতি অনুসরণ করা হয়েছে এবারের বাজেটে। কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা গেলে আগামী দশ বছরের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাবে বাংলাদেশ। জানা গেছে, মহামারী করোনা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি দ্রæত পুনরুদ্ধার ও কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর এবার মহামারীর তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই বাস্তবতার সামনে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কঠিন সময় পার করছে। বিনিয়োগ কমে আসায় চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে। প্রতিবছর শ্রম বাজারে যুক্ত হচ্ছে ২০ লক্ষাধিক মানুষ। বাড়ছে বেকারের সংখ্যা। অন্যদিকে এলডিসি উত্তরণের পর এবার উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে নির্ধারিত এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ করা হয়েছে। এজন্য দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পাশাপাশি মাথাপিছু আয় বাড়ানো, ব্যাপক ভিত্তিতে কর্মসংস্থানে কৃষি নির্ভর অর্থনীতি থেকে উৎপাদন নির্ভর অর্থনীতি বেগবান করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, জাতীয় পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিকে একটি দৃঢ় শিল্প ভিত্তিসহ ডিজিটালাইজড অর্থনীতিতে রূপান্তর করা। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে আসীন হওয়ার জন্য আমাদের প্রয়োজন হবে একটি শক্তিশালী শিল্প ও উৎপাদন খাত যা উচ্চহারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ধরে রাখার সহায়ক হবে। এর এজন্য প্রয়োজন হবে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তরকে দ্রæততর করা। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হবে। তিনি বলেন, স্ব-কর্মসংস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চাকরির পেছনে না ছুটে নিজে একজন উদ্যোক্তা হওয়া এবং চাকরির বাজার তৈরি করা একটি বড় বিষয়। এজন্য সরকারীভাবে নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে। এ ধরনের কর্মসংস্থান বাড়াতে উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, মোট উৎপাদনে ক্রমে কৃষির অংশীদারিত্ব হ্রাস পেয়ে শিল্পের বিশেষ করে উৎপাদন খাতের অংশীদারিত্ব বাড়ছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধারাবাহিকভাবে কাঠামোগত পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। জিডিপিতে সেবা খাতের অংশীদারিত্ব হলো সর্বাধিক যদিও গত এক দশকে এর অবদান কমে গেছে। আমার গ্রাম আমার শহর ধারণায় গ্রামগুলোকে শহরের সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে আইসিটি ও ডিজিটাল যোগাযোগ পরিকাঠামো স্থাপন, শিক্ষা উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সজ্জিত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পাইটলট হিসেবে ১৫টি মডেল গ্রাম নির্বাচন করা হয়েছে, যা শহরের মতো আধুনিক সুবিধা দিয়ে সজ্জিত হবে। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে- মহামারী কোভিড-১৯ এর অভিঘাত হতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিশীলতা বাড়ানো এবং উৎপাদন প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়। এর পাশাপাশি স্ব-কর্মসংস্থানে সরকারের বেশকিছু উদ্যোগ রয়েছে। স্ব-কর্মসংস্থানে ব্যাপক উদ্যোগ ॥ চাকরি না খুঁজে তরুণরাই বরং চাকরি দেবে এ রকম বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। গত কয়েক বছরের বাজেটে স্টার্টআপ ফান্ড গঠন করা হয়েছে। তহবিল পেয়ে তরুণরা যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন উদ্যোগে। এর বেশিরভাগই অনলাইনভিত্তিক নানা উদ্যোগ। ইতোমধ্যে সরকারী পর্যায়ে প্রায় ২ শতাধিক স্টার্টআপকে ব্যবসা করার জন্য তহবিল দেয়া হয়েছে। প্রতিবছর বাজেটে এ খাতে পরীক্ষামূলকভাবে ১০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা এ তহবিল থেকে ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন। এ খাত সংশ্লিষ্টা বলছেন, করোনাকালে নতুন এসব স্টার্ট আপ নতুন পথ দেখাচ্ছে। ফেসবুকভিত্তিক নানা ই-কমার্স এবং সেবাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভাল করছে। চালু হয়েছে নানা অনলাইন প্রশিক্ষণ। তরুণা অনলাইনভিত্তিক আউট সোর্সিংয়ের কাজ করে টাকা উপার্জন করছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, স্ব-কর্মসংস্থানে মন্ত্রণালয় থেকে ৫ হাজার তরুণ উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যারা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হচ্ছেন। এছাড়া করোনাকালীন এই দুর্যোগের সময় অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার কারণে ডিজিটাল প্লাটফর্মে লেনদেনও বেড়েছে। গত বছর প্রায় ১৫ শতাংশ লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়েছে। আর সাধারণ ছুটির সময়ে তা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সারা বছরই অনলাইন বাণিজ্য এখন চাঙ্গা। বিশেষ করে করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে দেশে দ্রæত ই-কমার্স বাণিজ্যের সম্প্রসারণ হচ্ছে। সরকারের পক্ষ এই ব্যবসায় সম্প্রসারণে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা হবে। তবে বাণিজ্যের নামে আবার প্রতারণা করলে কাউকে ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এদিকটি বিচেনায় নিয়ে শীঘ্রই ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২১ চ‚ড়ান্ত করা হবে। ই-ক্যাব (ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) জানিয়েছে, গত বছর এ খাতে ৫০ হাজার নতুন মানুষের কাজের সুযোগ হয়েছে। ই-ক্যাবের সভাপতি শমী কায়সার সম্প্রতি এ সংক্রান্ত বৈঠকে বলেন, করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে মানুষ যেন ঘরে বসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারে, সে জন্য ই-ক্যাব নানা ব্যবস্থা নিচ্ছে। পণ্য ডেলিভারির সময় ইতোমধ্যে সন্ধ্যা ৬টা থেকে বাড়িয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন ই-কমার্সের কার্যক্রম বড় ও মাঝারি শহরগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে এই সেবা গ্রামাঞ্চলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। ফেসবুকে পেজ খুলেই এখন অনেকেই এ খাতের উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। বাড়ছে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ। ইতোমধ্যে ১১২টি সদস্য প্রতিষ্ঠান বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে। কৃষি উৎপাদন আধুনিকায়ন করা \ কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এ খাতে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের নিয়ে আসার বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এজন্য কৃষি আধুনিকায়নসহ এ খাতের উৎপাদন পণ্য এগ্রোপ্রসেসিং বা প্রক্রিয়াজাতকরণে বিনিয়োগ বাড়াবে সরকার। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ভর্তুকি, প্রণোদনা ও বিভিন্ন সংস্থাকে ঋণ দেয়ার মতো সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয়েছে কৃষি খাতে। সরকার কৃষকদের সার, বিদ্যুত, কৃষি উপকরণ ও উন্নতমানের বীজ কেনাবাবদ ভর্তুকি দেয়। কৃষি খাতে আগামী অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ ভর্তুকি রাখা হয়েছিল। কৃষি ভর্তুকি বাড়ানোর ফলে দেশে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ গবাদি পশুর খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারে ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক সম্প্রতি এ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানে জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক কর্মসূচী ও নীতিগত সহায়তা দেয়া হবে। এ কারণে কৃষি খাতেও কর্মসংস্থান বাড়বে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। দেশের শিক্ষিত তরুণরা এখন চাকরি না খুঁেজ কৃষিকাজে এগিয়ে আসছেন। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিশ্বের বড় বড় কৃষি প্রধান দেশগুলোকে দেশের এগ্রোপ্রসেসিং খাতে বিনিয়োগের জন্য আহŸান জানানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ এ খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে বলে জানা গেছে। কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নে সর্বোচ্চ জোর \ সব ধরনের পণ্য উৎপাদন বাড়াতে কর্মীর দক্ষতা উন্নয়ন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে সর্বোচ্চ জোর দেয়া হবে। সার্বিকভাবে এবারের মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন পরিস্থিতি মধ্যম সারির। এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়েছে। জাতিসংঘের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩তম। গতবার বাংলাদেশ ১৩৫তম স্থানে ছিল। ভারত ও পাকিস্তান এবার দুই ধাপ করে পিছিয়েছে। বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এ প্রসঙ্গে বলেন, কোভিডের আগ পর্যন্ত মানব উন্নয়নে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ভাল করেছে। কিন্তু কোভিডের কারণে এবারের প্রতিবেদনের চেয়ে আগামী প্রতিবেদনটি সব দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানব উন্নয়নের এই তিনটি সূচকই করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষের আয় ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার হলেও শিক্ষা খাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। এছাড়া কর্মীর দক্ষতা উন্নয়নে স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যার মাধ্যমে ২০২৪ সালের মধ্যে ৮ লাখ ৪১ হাজার মানুষকে ১১টি অগ্রাধিকার খাতে দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ দেবে সরকার। এছাড়া জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। স্ব-কর্মসংস্থান বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
×