ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাচীন ঢাকার রোগবালাই মহামারী

‘হরিবোল শব্দে বহু মৃতব্যক্তিকে লইয়া যাইতে দেখিতাম’

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৩ জুন ২০২১

‘হরিবোল শব্দে বহু মৃতব্যক্তিকে লইয়া যাইতে দেখিতাম’

মোরসালিন মিজান ॥ করোনাকালের মধ্য দিয়ে আমরা যারা যাচ্ছি, ভাবছি, এমন দুর্দিন আর আসেনি কোনদিন। আসেনি ভাবতেই আসলে ভাল লাগে। তবে বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। বিগত দিনেও বহু রোগ ব্যাধি ও মহামারীর মধ্য দিয়ে গেছে মানুষ। বিশেষ করে প্রাচীন ঢাকার অসুখ বিসুখ ও মৃত্যুর নানা তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়। শত শত বছর আগে ঢাকার অধিবাসীরা বহুবিধ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কোন কোন রোগ মহামারী আকার ধারণ করেছে। না, করোনা তখন ছিল না। কলেরা ম্যালেরিয়া আমাশয় গুটিবসন্ত টাইফয়েডের মতো রোগই মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়িয়ে দিত। পাশাপাশি পৃথিবীর অন্য অনেক শহরের মতো ঢাকা আক্রান্ত হয়েছিল প্লেগ রোগে। বহু মানুষ এ রোগে মারা যায়। সঠিক সংখ্যা? না, এ তথ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে সময়ের এক পরিসংখ্যান মতে, ১৮৮৬ সালে প্লেগে আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ১৮৯৭ সালে আবারও মহামারী আকার ধারণ করে প্লেগ। তবে কিছু রোগ মোটামুটি লেগেই থাকত। এই যেমন কলেরা। প্রবীণদের অনেকেই রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনও কম বেশি বলতে পারবেন। ১৮১৭ সালে ঢাকায় এটি মহামারী আকার ধারণ করে। এর পরও অব্যাহত ছিল। ১৮২৫ সালে রোগে ভুগে মারা যায় ৪২৭ জন। ১৮৫১, ১৮৫৩, ১৮৫৫- ১৮৫৭ সাল নাগাদ কলেরা বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯১০ সালে ঢাকায় কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৪১ জন। প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি ছিল বলেই ধারণা করা হয়। এ প্রসঙ্গে খ্যাতনামা সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ দীনেশচন্দ্র সেনের দেখা ও লেখার কথা না বললেই নয়। কলেরা যখন মহামারী আকার ধারণ করেছিল তখন তিনি ঢাকায়। সময়টিকে তার লেখায় হুবহু খুঁজে পাওয়া যায়। দীনেশচন্দ্র লিখছেন, ‘১৮৮১ সালে ঢাকায় যেরূপ ওলাউঠার (কলেরা) প্রকোপ হইয়াছিল সেরূপ উৎকট অবস্থা বড় দেখা যায় না। প্রথমত: তাঁতিবাজারের পথে যাইতে ‘হরিবোল’ শব্দে বহু মৃতব্যক্তিকে লইয়া যাইতে দেখিতাম, তখন মড়াটা ডানদিকে কি বামদিকে দেখিলাম, তাহাই লইয়া মনে বিতর্ক করিয়া যাত্রার শুভাশুভ নির্ণয় করিতাম।’ আজ এই করোনারকালে শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন হুমকির মুখে পড়েছে তেমনি অবস্থা হয়েছিল প্রাচীন ঢাকায়। সে কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কলেরা তাঁতিবাজার হইতে শুরু করিয়া ধীরে ধীরে বাবুবাজার মুখে রওনা হইল। স্কুলে যাইয়া দেখিতাম ক্রমশঃ ছেলে কমিয়া যাইতেছে, তাহারা ভয়ে ঢাকা ছাড়িয়া যাইতেছে।’ কলেরা মহামারী যে ভয় আতঙ্ক ছড়িয়েছিল তা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকার মতো ক্ষুদ্র শহরে সে যে কি ভয়-তাহাও কলেরা আবার সংক্রামক! সমস্ত শহরটির ওপর একটা মৃত্যুর ছায়া পড়িয়াছিল।’ শঙ্কা কেটে যাওয়ার পর কিছুটা মজার ছলে দীনেশচন্দ্র লিখেন, ‘কলেরায় মরিয়া যাইব এই ভয়ে দিনরাত ঔষধ খাইতাম। সালফিউরিক এসিড ডিল্ পকেটেই থাকিত, শিশির ছিপি খুলিয়া ঔষধ পড়িয়া আমার অনেক আলপাকা ও গরদের জামা জ্বলিয়া গিয়াছে। শুধু সালফিউরিক এসিড নয়, পিপারমেন্ট, বিসমাথ, ভুবনেশ্বর, ক্লোরোডাইন, স্পিরিট ক্যাস্ফার প্রভৃতি খাইয়া এমনই পেটের অবস্থা দাঁড়াইয়া ছিল যে প্রায়ই আমার কোষ্ঠাবদ্ধ হইয়া থাকিত।’ এদিকে, কলেরায় ঢাকায় অবস্থানরত ইংরেজ সৈন্যরাও ব্যাপক হারে আক্রান্ত হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, সৈন্যরা আক্রান্ত হওয়ার পরই মূলত ঢাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে শুরু করে ইংরেজ প্রশাসন। ১৮৫৯ সালে একটি রাজকীয় কমিশন গঠন করা হয়। ১৮৬৩ সালে এই কমিটি একটি রিপোর্টও পেশ করে। পরবর্তিতে ১৮৬৮ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন কর্তৃক বাংলার সেনিটারি কমিশনারকে জেলার জনস্বাস্থ্যের ওপর রিপোর্ট প্রদান করা হয়। অনুমান করা হয়, এর প্রেক্ষিতে ১৮৬৯ সালে জনস্বাস্থ্য কমিশন বাতিল করা হয়। মেডিক্যাল অফিসারের নতুন নামকরণ করা হয় সেনিটারি কমিশনার। সরকারকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়া ছিল তার কাজ। এদিকে, ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি। এ প্রতিষ্ঠান শহরের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখার নিমিত্তে কাজ শুরু করে। প্রাচীন ঢাকাকে একইভাবে নাস্তানাবুদ করেছে বসন্ত। শহরে ১৮৫০ সালে জ্বর ও বসন্তের প্রকোপ দেখা দেয়। ১৯১৯ সালে বসন্তে মারা যায় ৪৬৬ জন। ১৯২৫-২৬ সালে ডায়রিয়া ও আমাশয়ে ৩৪৯ জন মারা যায়। ১৯২৯ সালে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরে মারা যায় ১৪৪ জন। আরও অনেক নগণ্য রোগ ব্যাধিতেও মানুষ মারা গেছে। চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার কারণেই অতি সামান্য রোগে মানুষ মারা যেত। হ্যাঁ, প্রাচীন ঢাকার চিকিৎসা ব্যবস্থা মোটেও ভাল ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কবিরাজী চিকিৎসার ওপর নির্ভর করতে হতো। ক্রমে কিছু পরিবর্তন আসে। কলেরার প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষিতেই ১৮২০ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পরিকল্পনা করেন ঢাকার কালেক্টর ও প্রাদেশিক আপীল বিভাগের বিচারপতি স্যার রবার্ট মিটফোর্ড। সে সময়ের তথ্য বলছে, ঢাকাতে কলেরা ব্যাপকভাবে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন মারা যেত এ রোগে। কিন্তু চিকিৎসা সুবিধা বলতে তেমন কিছু ছিল না। স্যার মিটফোর্ড এই অবস্থা দেখে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেন। মূলত এই মানবিক মানুষটির দানে ১৮৫৮ সালের ১ মে মিটফোর্ড হাসপাতাল আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। হাসপাতালটি ব্রিটিশ শাসিত তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রথম জেনারেল হাসপাতাল। প্রাচীন ঢাকায় জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন ও টিকা কার্যক্রম চালানোর তথ্যও পাওয়া যায়। ১৮৭০ সালে মিউনিসিপ্যালিটি নগর পুলিশকে দিয়ে জন্ম মৃত্যু নিবন্ধন করান। একই সময় সিভিল সার্জনদের মাধ্যমে চলে টিকাদান কার্যক্রম। তবে আজকের ঢাকা যারপরনাই বদলে যাওয়া। প্রাচীন ঢাকার সঙ্গে বর্তমান ঢাকার কোন মিল নেই। চিকিৎসা ব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে। তা হয়েছে। মহামারী থেকে মুক্তি মেলেনি। নতুন ঢাকায় ততোধিক নতুন রোগ হয়ে ধরা দিয়েছে করোনা। আরও অনেক রোগের মতো এই রোগটিও হয়ত গভীর ক্ষত হয়ে ঢাকার বুকে থেকে যাবে।
×