ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানই জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম উপায়

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২০ জুন ২০২১

প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানই জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম উপায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শিল্পখাতে চাহিদামাফিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধানই ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তার অন্যতম উপায়। একই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ও এলএনজি আমদানি এবং উৎপাদনের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-ডিসিসিআই আয়োজিত ‘বাংলাদেশের শিল্পখাতের জ্বালানি উৎসের ভবিষ্যত : এলপিজি এবং এলএনজি’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। ওয়েবিনারের স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, গত ৫ দশকে শিল্পখাতের গতিধারাকে চলমান রাখতে প্রাকৃতিক গ্যাস অন্যতম জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। তবে আমাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের স¤প্রসারণের ফলে জ্বালানির চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধির কারণে প্রায়ই শিল্পখাতে জ্বালানি সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার ঘোষিত ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শিল্পখাতের চাহিদামতো জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে এখাতে পরিকল্পিত উপায়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পখাতে চাহিদামাফিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণে প্রাকৃতিক গ্যাসের অনুসন্ধান বৃদ্ধির পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি ও এলএনজি আমদানি এবং উৎপাদনের ওপর আরও বেশি হারে গুরুত্ব দিতে হবে। বর্তমানে আভ্যন্তরীণ চাহিদার ২ শতাংশ এলপিজির মাধ্যমে মেটানো হয় বলে ডিসিসিআই সভাপতি উল্লেখ করে বলেন, এলএনজির চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে স্টোরেজ সুবিধা নিশ্চিত করা। তিনি দ্রæততার সঙ্গে এলপিজি ও এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনে সরকারের প্রতি আহŸান জানান, পাশাপাশি এখাতের সার্বিক উন্নয়নে একটি সমন্বিত টেকসই কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জোরারোপ করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আনিছুর রহমান বলেন, সরকার গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এবং জকিগঞ্জে সর্বশেষ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, আশা করা যাচ্ছে, সেখান থেকে দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হবে। এর জন্য প্রায় ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। করোনা মহামারিকালীন ১০০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, অনশোরে সক্ষমতা থাকায় বাপেক্সের মাধ্যমে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো অব্যাহত রয়েছে। এলএনজি ব্যবসায় ঝুঁকি কম থাকায় বর্তমানে সকলেই এর দিকে ঝুঁকছে, এলপিজির বাজার প্রায় ১২ লাখ টন এবং ২৯টি কোম্পানি স্থানীয় বাজারে এলপিজি অপারেটর হিসেবে কাজ করছে। তবে ৫৬টি কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ছোট ছোট জাহাজে এলপিজি আমদানি করায় খরচ বাড়ছে, তবে মাতারবাড়িতে এলপিজি টার্মিনালের কার্যক্রম চালু হলে, এ খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। দেশীয় শিল্পখাতে এলপিজির ব্যবহার এখনও অনেক কম, তবে এলপিজি ও এলএনজির টার্মিনাল স্থাপন এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দাম কমানো সম্ভব। তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ লাখ মেট্রিকটন এলপিজি আমদানি হয়েছিল, যার মধ্যে ১ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে শিল্পখাতে এবং সিরামিক, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, স্টিল ও চা শিল্পেই বেশি ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে এলপিজি খাতে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ হয়েছে। সচিব জানান, ব্যবসাবান্ধব হওয়ার জন্য প্রয়োজন হলে নীতিমালা ও আইন সংস্কার করা হবে। তিনি বলেন, এলপিজি অপারেটরদের অনুমোদনের জন্য ১৮ ধরনের লাইসেন্স দরকার এবং বাৎসরিক নবায়ন ফি দিতে হয় ১ কোটির বেশি, যা কমানো প্রয়োজন। গ্যাস সংযোগ নিতে তিতাসে সংস্কার কাজ চালানো হচ্ছে, বর্তমানে শিল্পখাতে গ্যাস সংযোগ নিতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয় না এবং পরিকল্পিত শিল্প অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান সচিব। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য (গ্যাস) মোঃ মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, বর্তমানে আমাদের গ্যাসের রিজার্ভ ৬ টিসিএফ এবং সারাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। তিনি জানান, বর্তমানে ৩৩০০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাসের মধ্যে নিজস্ব উৎপাদিত গ্যাসের ৭৪ শতাংশ আসে নিজস্ব খাত থেকে। বাকি ২৬ শতাংশ আসে এলএনজি থেকে এবং এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩০ সালে দেশীয় উৎপাদন হবে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ এবং আমদানিখাত থেকে আসবে ৮৩ শতাংশ। সেক্ষেত্রে শিল্পখাতসহ সকল খাতে ব্যয় বাড়বে। এমন বাস্তবতায় অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন এবং এক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে বেসরকারী খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়াও অনুসন্ধানের জন্য দীর্ঘময়োদী পরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত আবশ্যক এবং এ কাজে একটা মানসম্মত ডাটা সেন্টার উন্মুক্ত করা খুবই জরুরী বলে অভিহিত করেন। মকবুল এলাহী বলেন, গ্যাস ব্যবহারে মিটার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে, সিস্টেম লস ও চুরি কামানো যেত। যার মাধ্যমে আরও ১০-১২ লাখ মিটার গ্যাস লাগানো যাবে। সেই সঙ্গে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, এলপিজি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব এবং আমাদের দেশে বর্তমানে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন এলপিজি ব্যবহৃত হচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে এলপিজি দাম নির্ধারণে প্রথমবারের একটি সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং জুলাই মাসের ৭-৮ তারিখে এলপিজির দাম পুনর্বিবেচনার বৈঠক শুরু হবে। এলপিজির দাম নি¤œ মধ্যবিত্তের শ্রেণীর নাগালে নিয়ে আসা সম্ভব হলে, ২০২৫ সালে ৩ মিলিয়ন টন এলপিজি বাংলাদেশে বিক্রি হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। পেট্রোবাংলার গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের প্রাক্তন পরিচালক (অপারেশন) ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার সালেক সুফী ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিল্পখাতের ভবিষ্যত জ্বালানি হলো এলপিজি ও এলএনজি। শিল্পখাতে প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকল্পে আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের যৌক্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস অনুসন্ধানে বর্তমানে বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ যুগোপযোগী নয় এবং অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের ৩০তম স্থানে রয়েছে। সহনশীল দামে এলপিজি এবং এলএনজি সরবরাহের লক্ষ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। অধ্যাপক মোঃ শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ সারাবিশ্বে মোট বিদ্যুত উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস হতে আসবে, যেখানে বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য খাত হতে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচার্স এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান আমের আলী হোসেন বলেন, জ্বালানির জন্য শুধুমাত্র একটি উৎসের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়, সে লক্ষ্যে বিভিন্ন খাত হতে জ্বালানি উৎপাদন ও জ্বালানির বহুমুখীকরণের ওপর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন। এছাড়াও তিনি বাপেক্সকে আরও আধুনিকায়ন করা দরকার বলে মত প্রকাশ করেন। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ কম থাকায় সে অঞ্চলে আশানুরূপ শিল্পায়ন হচ্ছে না। অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানির দাম নির্ধারণের বিষয়ে সকলকে আরও প্রতিযোগী সক্ষম হতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে জ্বালানি মূল্যের যৌক্তিকীকরণ ও ক্ষেত্রবিশেষে মূল্য হ্রাসের আহŸান জানান তিনি। বিজিএমইএ-এর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তৈরি পোশাক ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পখাতে গ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং টেক্সটাইল, ডাইং, স্পিনিং প্রভৃতি খাতে দেশের ৭-৮ শতাংশ গ্যাস ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, গত ১০ বছরে আমাদের গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে ৭৫৪ বিলিয়ন কিউটিক ফিট থেকে ৯৭৫ বিলিয়ন কিউবিক ফিটে। ডিসিসিআই পরিচালক আরমান হক, সাবেক পরিচালক নূহের লতিফ খান, আহŸায়ক মালিক তালহা ইসমাইল বারী মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। ডিসিসিআই উর্ধতন সহ-সভাপতি এন কে এ মবিন, এফসিএস, এফসিএ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ডিসিসিআই সহ-সভাপতি মনোয়ার হোসেনসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ উক্ত ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করেন।
×