ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বায়িং হাউজের আড়ালে ভয়ংকর মাদক আইস বেচাকেনা

প্রকাশিত: ১৯:২৫, ১৮ জুন ২০২১

বায়িং হাউজের আড়ালে ভয়ংকর মাদক আইস বেচাকেনা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ টেকনাফ থেকে ভয়ঙ্কর মাদক ‘আইস’ সংগ্রহ করে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতো একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এরা বায়িং হাউজের আড়ালে এই মাদক কেনাবেচা করতো। তারা রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরায় বায়িং হাউজের নামে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে দিনরাত সেখানে মাদক সেবন ও অনৈতিক কার্যক্রম চালতো। সেখানে প্রায় ৫০ জনের মতো আইসসেবন করতেন। এরা মাদক সেবনের পর উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতো। এরকমই একই ভয়ংকর মাদক ও সন্ত্রাসী চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, মূল হোতা মোঃ তৌফিক হোসাইন(৩৫), মোঃ জামিরুল চৌধুরী ওরফে জুবেইন(৩৭), মোঃ আরাফাত আবেদীন ওরফে রুদ্র(৩৫), মোঃ রাকিব বাসার খান(৩০), মোঃ সাইফুল ইসলাম ওরফে সবুজ(২৭) ও মোঃ খালেদ ইকবাল(৩৫)। এ সময় তাদের কাছ থেকে আইস, ইয়াবা, বিদেশী মদ, গাঁজা এবং ১৩টি বিদেশী অস্ত্র এবং রেপলিকা অস্ত্র ও অন্যান্য ইলেকট্রিক শক যন্ত্র, বিপুল পরিমান, মাদক সেবনের সরঞ্জামাদিসহ ল্যাবরেটরি (মেথ ল্যাব) সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়। শুক্রবার বিকালে রাজধানীর কারওরান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, মাদক সেবনের পর উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতো। পরে তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায় করতো। তিনি জানান, গ্রেফতারকৃতরা বেশিরভাগই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গ্রেফতারকৃত জুবেইন লন্ডন থেকে বিবিএ, তৌফিক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, খালেদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমবিএ, রুদ্র ও সাইফুল এইচএসসি পাস করার পর ড্রপ আউট, খালেদ একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রাথমিকভাবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। তবে গ্রেফতারকৃত রুদ্রের নামে তিনটি মাদক মামলা এবং গ্রেফতারকৃত জুবেইনের নামে একটি হত্যা মামলা রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানানন, গ্রেফতারকৃতরা একটি নির্দিষ্ট সিন্ডিকেটের সদস্য। ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে রাজধানীতে মাদক সরবরাহ করতেন তারা। টেকনাফ থেকে মাদক সংগ্রহ করতেন। পরবর্তী সময়ে রাজধানীতে সরবরাহ করা হতো উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের কাছে। এছাড়া রাজধানীর মিরপুর গুলশান উত্তরা থেকে আইস সংগ্রহ করে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতেন তারা। রাজধানীর উত্তরায় অভিযান পরিচালনা করে পরবর্তীতে আরও জানতে পারে, একটি বাইয়িং হাউজের আড়ালে চলছিল আইস কেনাবেচা এবং সেবন। শুধু মাদক বিক্রি নয়, বিক্রির পর সেবনের স্থানের ব্যবস্থা করতো এই চক্রটি। যেসব তরুণ-তরুণীরা তাদের ব্যবস্থাপনার এসব জায়গায় মাদক সেবন করতে আসতেন। তাদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হতো বলেও জানতে পেরেছে র‌্যাব। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান, তরুণ-তরুণীদের আইস এবং ইয়াবা সেবন করিয়ে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে পরিবারের কাছে থেকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতো এই চক্রটি। সিন্ডিকেটের বাইরে আইস সরবরাহ করা হতো না বলেই ক্লায়েন্টদের প্রতিনিয়ত নজরদারিতে রাখতেন তারা। র‌্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, এই চক্রের আইস মাদক ব্যবসার অর্থ যোগানদাতা হিসেবে ছিলেন গ্রেফতারকৃত জামিরুল চৌধুরী ওরফে জুবেইন। আর গ্রেফতারকৃত তৌফিক মূলত সমন্বয়ের কাজ করতেন। রুদ্র ল্যাবের কেমিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। সবুজ আইস সংগ্রহ ও সরবরাহের কাজ করতেন। এছাড়া মাদক বিপণন বহন করার ক্ষেত্রে রাকিব ও খালিদকে ব্যবহার করা হতো। রাজধানীতে আরও ৫০ জনের মতো আইসসেবী রয়েছেন। এই চক্রটি প্রতিনিয়ত তাদের কাছে আইস পৌঁছে দিতো। গত দু'বছর যাবৎ তারা এই আইস ব্যবসার সাথে জড়িত। এর আগে ১০ বছর ধরে তারা ইয়াবার সাথে জড়িত ছিলেন। উদ্ধার হওয়া এয়ারগান প্রসঙ্গে র‌্যাব জানায়, মাদকদ্রব্য সেবনের জন্য তারা উত্তরায় একটি বায়িং হাউজের নামে বাসা ভাড়া করে গোপনে মাদক সেবন ও অনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সেখানে আইস সেবনের পর তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তারা এইমিং গেমস খেলতেন। আর এই এয়ারগান দিয়ে চলতো গেমসটি। তবে উদ্ধার এয়ার গানগুলোর বৈধ কোন কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেননি। যদিও এয়ারগান ব্যবহারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। তাদের কাছে এয়ারগানগুলো কীভাবে এলো এ বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর উদ্ধার হওয়া রেপলিকা অস্ত্র দিয়ে তারা বিভিন্ন সময় আগত আইস সেবীদের ভয়-ভীতি দেখাতো। অর্থ যোগানদাতা কে এই জুবেইন ॥ লন্ডন থেকে বিবিএ করা জামিরুল চৌধুরী ওরফে জুবেইনের বসবাস রাজধানীর উত্তরায়। আগে থেকে ইয়াবাসেবী জুবেইন অধিক লাভের আশায় আইস মাদক এর সাথে জড়িয়ে পড়ে। তার একসাথে ১৫ থেকে ২০টি ইয়াবা লাগতো। উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করাই ছিল তার কাজ। এইচএসসি পাস করে কেমিস্ট, বানাতেন ‘ঝাক্কি’ ॥ কোমল পানীয়, আইস ও ইয়াবার সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় বিশেষ ধরনের একটি মাদক ‘ঝাক্কি’। এইচএসসি পাস আরাফাত আবেদীন ওরফে রুদ্র ছিলেন তাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত ম্যাথ ল্যাবের কেমিস্ট। তিনিই বানাতেন এসব সংমিশ্রন। র‌্যাব পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, এরা প্রথমে প্রথমে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। পরে সেই মাদকের সংমিশ্রনে তৈরি করে ‘ঝাক্কি’ নাম দিয়ে সেগুলোও সরবরাহ করতেন মাদকসেবীদের কাছে। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিনিয়ত ইয়াবা সেবনে তারা চরম আসক্তির পর্যায়ে পৌঁছায়। পরবর্তীতে আসক্তির মাত্রা বাড়াতে বিগত চার থেকে পাঁচ বছর যাবৎ তারা আইস গ্রহণ শুরু করে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে উঠতী বয়সী তরুণ-তরুণীদের নেশায় উদ্বদ্ধ করতো। ক্ষেত্র বিশেষে গোপন ভিডিও ধারণ করে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল করত। জিজ্ঞাসাবাদে আরও কিছু সিন্ডিকেট এবং এই মাদকের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তারা সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদান করেছেন। র‌্যাব উক্ত সিন্ডিকেট এবং অন্যান্য আইস গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাড়াশী অভিযান অব্যাহত থাকবে।
×