ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চার রোহিঙ্গা আটক

এক কাপড়ে আসা রোহিঙ্গার কক্ষে ৫৪ ভরি স্বর্ণ

প্রকাশিত: ২১:০৮, ৫ মে ২০২১

এক কাপড়ে আসা রোহিঙ্গার কক্ষে ৫৪ ভরি স্বর্ণ

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ ক্যাম্পে আশ্রিত এক রোহিঙ্গার কক্ষে অর্ধ লক্ষাধিক ভরি স্বর্ণালঙ্কার, অর্ধ লাখ নগদ টাকা, কম্পিউটার ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা চুরি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তোলপাড় চলছে। পুলিশ ২০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার ও জড়িত থাকার দায়ে চার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। স্থানীয়রা জানান, একটি মাত্র রোহিঙ্গা পরিবারের কাছে কি করে এত স্বর্ণালঙ্কার থাকতে পারে? ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটার চালানোর সরকারীভাবে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও এসব তারা রাখে কোন সাহসে? ওই রোহিঙ্গা কি মিয়ানমারে থাকতে ধনী ছিল? রোহিঙ্গারা শুধু প্রাণে বাঁচতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে উখিয়া টেকনাফে। কিন্তু তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে সাময়িক সময়ের জন্য আশ্রয় নিয়ে ধারণা করছে- মিয়ানমারে তাদের আর ফিরে যেতে হবেনা। তাই দেদারছে চালিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা ও স্বর্ণ চোরাচালান কারবার। টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি কক্ষে গচ্ছিত ৫৪ ভরি স্বর্ণ, নগদ ৫০ হাজার টাকা, ইন্টারনেট সংযোগসহ একটি কম্পিউটার এবং একটি ক্যামেরা চুরি হয়েছে। অভিযোগ পেয়ে এপিবিএন পুলিশ ২০ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার ও চার রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। নয়াপাড়া ক্যাম্পে ব্লক-ই, শেড-৯০৮/২, এমআরসি- ৬০১০৮ তে আশ্রিত আবুল কাশেমের পুত্র মোঃ সুলতান (৩৫) এর কক্ষ থেকে এসব স্বর্ণালঙ্কার চুরি হয়। সূত্র জানায়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা যখন রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছিল, তখন রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে তারা প্রাণে বাঁচতে এক কাপড়ে পালিয়ে আসে বাংলাদেশ সীমান্তে। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে শুধু প্রাণে বাঁচতে আকুতি জানায় রোহিঙ্গা নেতারা। তখন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে সীমান্ত খুলে দেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে পরবর্তী তিনমাসে দলে দলে রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেয় উখিয়া টেকনাফের বনভূমি পাহাড়গুলোতে। নতুন করে প্রায় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। ওইসময় তারা কোটি কোটি টাকা মূল্যের বনজ সম্পদ (গাছ-পাহাড় ও টিলা) ধ্বংস করে ঝুপড়ি তৈরি করে বসতি গেড়ে বসে। সরকার ও বিভিন্ন দাতা সংস্থা তাদের ভরণপোষণ ও চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছে এ পর্যন্ত। তবে রোহিঙ্গারা উদ্বাস্তু হিসেবে শিবিরে বসবাস না করে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন স্থানে। শিবির অভ্যন্তরে মার্কেট দোকান ইত্যাদি গড়ে তোলে ব্যবসা বাণিজ্যে মেতে উঠেছে। ওপারে গিয়ে নিয়ে আসছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। আনছে স্বর্ণের চালানও। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নজরে পড়লে কিছু কিছু চালান জব্দ ও রোহিঙ্গাদের আটকও করা হচ্ছে। যদিও উদ্বাস্তুদের ব্যবসা করার নিয়ম না থাকলেও কিছু সংখ্যক এনজিও রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে উখিয়া টেকনাফে রাখতে পুঁজি দিয়ে দোকান খোলে দিয়েছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গারা চলে গেলে ওইসব এনজিও কর্মকর্তাদের পক্ষে আর বিদেশী ফান্ড এনে ফাইভস্টার হোটেলে আরাম-আয়েশ করা যাবেনা ধারণায় রোহিঙ্গারা যা চাইছে, তা দিচ্ছে তারা। ওই এনজিওগুলোর কুপরামর্শে রোহিঙ্গারা সহজে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইছেনা বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। বিশ্লেষকরা জানান, উদ্ধার হওয়া ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার সরকারী কোষাগারে জমা করে শিবিরে যৌথ অভিযান চালানো প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্প থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, ইয়াবা ডনদের গ্রেফতার ও শিবির অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের মালিকানাধীন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবেনা। তা হলে রোহিঙ্গারা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গার ভিড়ে প্রশাসনের লোকজন নগণ্য বললে চলে। সীমান্তরক্ষীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে সুবিধামত সময়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে ফের শিবিরে ঢুকে পড়ছে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গন্তব্যস্থানে। এসব বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আরও কঠোর হতে হবে বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা। সূত্রমতে, উখিয়া টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে বিক্রি করে ওই টাকায় অস্ত্র কিনছে। ইয়াবাসহ মিয়ানমারের হরেক রকমের পণ্য এনে শিবির অভ্যন্তরে তাদের দোকানে পসরা সাজিয়ে রাখে। ওইসব দোকানের আড়ালে দিব্যি ইয়াবা কারবার করে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা জোগাড় করছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা কুতুপালং শিবিরে অস্ত্র বানানোর কারিগর ভাড়ায় এনে অস্ত্র মজুদ করেছে। খবর পেয়ে র‌্যাব সদস্যরা সম্প্রতি কুতুপালং শিবির লাগোয়া পাহাড়ে অভিযান চালায়। অস্ত্রের কারখানা থেকে ৪টি অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির উপকরণসহ কারিগরকে গ্রেফতার করেছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা নেতা জানায়, তাদের কাছে বর্তমানে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারই হচ্ছে প্রাণের চেয়েও দামী পণ্য। কারণ প্রত্যাবাসনে সাড়া না দিয়ে কোন সময় কোন দিকে পালিয়ে যেতে হয় বলা মুশকিল। তবে এটাই সত্য যে বাংলাদেশের যে কোন জায়গায় গেলে নগদ টাকার অবশ্যই দরকার। এই জন্য রোহিঙ্গারা নগদ টাকা ও স্বর্ণ জোগাড় করতে মরিয়া। ক্যাম্প প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শনিবার (১ মে) দুপুরে মোঃ সুলতানের কক্ষে গচ্ছিত ৫৪ ভরি স্বর্ণসহ অন্য মালামাল চুরি হয়। যদিও রোহিঙ্গা সুলতানের পরিবারের দাবি চুরি যাওয়া ওইসব স্বর্ণ তাদের চার ভাইবোনের। স্বর্ণ, নগদ টাকা, কম্পিউটার ও ক্যামেরা চুরির বিষয়ে ক্যাম্পের এপিবিএন পুলিশকে অভিযোগ করলে প্রথমে চোর সন্দেহে ব্লক-এফ/৮ সৈয়দুর রহমানের পুত্র আব্দুল্লাহকে আটক করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে সে চুরির কথা স্বীকার ও এক পর্যায়ে নিজ কক্ষ থেকে ২ ভরি স্বর্ণ বের করে দেয়। এই চুরির ঘটনায় ব্লক-ডি, শেড-৭৩৫/৪, এমআরসি-১২০৬৪ নং এর ফজর আহম্মদের পুত্র নুরুল কবির, ব্লক-এফ/৮, আব্দুল্লাহর স্ত্রী রহিমা খাতুন, ব্লক-ই, এমআরসি- ৬৪৩২ রশিদ আহম্মদের পুত্র জাফর, দুদু মিয়ার পুত্র হারুন, কক্সবাজার সদরের ঘোনার পাড়ার হাজী সৈয়দুর রহমানের পুত্র নুর আলম জড়িত বলে পুলিশকে জানায়। পরে টেকনাফ থানা পুলিশ ও নয়াপাড়া এপিবিএন পুলিশের যৌথ জিজ্ঞাসাবাদে আরও ১৮ ভরি স্বর্ণের কথা জানালে পুলিশ তা উদ্ধার করে। কক্সবাজার ১৬ এপিবিএন অধিনায়ক তারিকুল ইসলাম তারিক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
×