ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মিহির কুমার রায়

করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় মানবিক দায়বদ্ধতা

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৫ মে ২০২১

করোনা সঙ্কট মোকাবেলায় মানবিক দায়বদ্ধতা

বর্তমানে বাংলাদেশ যখন সাফল্যের সঙ্গে ভ্যাকসিন কার্যক্রম পরিচালনা করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে, ঠিক তখনই বিশ্বজুড়ে একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনার নতুন ধরন। বাংলাদেশেও করোনার নতুন ধরনের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্র, কেরালা ও তেলাঙ্গানায় ‘এন-৪৪০-কে’ ও ‘ই৪৮৪কে’ নামক নতুন ধরনের মিউটেশন পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এ স্ট্রেইন ভারতেই উৎপত্তি লাভ করেছে, যুক্তরাজ্য বা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসেনি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভারতের এ নতুন স্ট্রেইন/ধরনের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রাপ্ত ধরনের চারিত্রিক কিছু মিল রয়েছে। ‘ই৪৮৪কে’ মিউটেশনের উপস্থিতির কারণে ভারতের নতুন ধরনটির মাঝে ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়ানোর কৌশল’ থাকার আশঙ্কা প্রবল। এমতাবস্থায় ভারত এখন বিশ্বের সবচেয়ে করোনা সংক্রমিত দেশ হিসেবে পরিগণিত এবং বাংলাদেশ সরকার স্থল ও আকাশপথে সকল যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করেছে, কেবল নিত্য প্রয়োজনীর দ্রব্যসামগ্রীবাহিত যানবাহন ছাড়া। বাংলাদেশে দুই সপ্তাহ লকডাউন দেয়ার পরও অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষণীয় নয় এবং প্রতিদিন গড়ে এক শ’ জন মৃত্যুবরণ করছে। আক্রান্তের হার এমন যে হাসপাতালগুলো প্যাশেন্ট ভর্তি করাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। করোনার এই দ্বিতীয় বিস্ফোরণ ঠেকাতে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলেও বইমেলা, মার্কেট, গার্মেন্টস, অফিসসহ বড় বড় সেক্টর সব খোলাই ছিল। আন্তঃজেলাগুলোতে বাস চলাচলের সুযোগও ছিল। তার ওপর যত সেক্টরে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল জনগণের খামখেয়ালিপনায় তা ছিল আরও অকার্যকর। এমন পরিস্থিতি দেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়। লকডাউনের প্রকৃত প্রয়োগ না হলে করোনার এই ভয়ানক বিস্ফোরণ যে গণমৃত্যুর জন্ম দেবে তা অতি সহজেই অনুমান করা যায়। অসচেতন জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য প্রয়োজন প্রশাসনের দৃঢ় ভূমিকা। মানুষকে বোঝাতে হবে লকডাউন আমাদের বেঁচে থাকার জন্যই। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে কিছুদিন ঘরে আবদ্ধ থাকতে হবে। লকডাউন অমান্যকারীদের ঘরে পাঠানোর দায়িত্ব প্রশাসনকেই সামলাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন আরোপ করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানায় সরকার। প্রথমত, ১৪ এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত যা পরবর্তিতে ২৯ এপ্রিল ৫ মে পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। এখন আবার ১৬ মে পর্যন্ত তা সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে সরকার রমজানের বাজার তথা জীবন জীবিকার কথা চিন্তা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিংমল, দোকানপাট খুলে দেয়ার অনুমতি দেয়। লকডাউনে জনগণকে ঘরে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য করানো হয়, দিনমজুর ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়, হতদরিদ্র শ্রেণীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হয়, হতদরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের আর্থিক সহায়তা অথবা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে অন্নসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হয়। করোনায় বেঁচে থেকে কেউ যেন ক্ষুধার যন্ত্রণায় না মরে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এই মানবিক কাজে এগিয়ে আসতে হবে। পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের গতি যথাসম্ভব স্থিতিশীল রেখে লকডাউনকে মানুষের অনুকূল উপযোগী করে তুলতে হবে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে করোনার নিরাময়ে সরকার ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ম ডোজের টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু করে এবং তার ২ মাস পরে ৯ এপ্রিল থেকে ২য় ডোজ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে প্রাপ্ত টিকা দিয়ে। চুক্তি মোতাবেক ভারত থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা আসার কথা থাকলেও বাকি ৮০ লাখ ডোজ টিকা আগামী জুনের আগে সরবরাহ সম্ভব হবে না বলে জানা গেছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ডব্লিউএইচও’র অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকে এবার করোনাভাইরাসের টিকা রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’ এবং চীনের ‘সিনোভ্যাক’ ও ‘সিনোফার্ম’ টিকা ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন ছাড়াই টিকা আমদানি করতে পারে এবং টিকাদান কর্মসূচী চালাতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা। ডব্লিউএইচওর অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা সম্ভব না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৮ দেশের জোটের অনুমোদিত টিকাও ব্যবহার করা যাবে। রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা পেতে ইতোমধ্যে সরকার প্রাথমিকভাবে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দেশটি নিজেদের ‘স্পুটনিক ভি’র প্রযুক্তি সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছে। দেশে উৎপাদন করা হলে স্পুটনিক ভি এবং সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা দামেও সাশ্রয়ী হবে। অক্সফোর্ড-এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার চেয়েও খরচ কম হতে পারে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে। চীনের দুটি প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত করোনার টিকা ‘সিনোভ্যাক’ এবং ‘সিনোফার্ম’ সংগ্রহের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। দুটি টিকাই করোনা প্রতিরোধে কার্যকর বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। এই দুটি টিকা এখন পর্যন্ত চীনের ১২ কোটির বেশি নাগরিককে দেয়া হয়েছে। সহ-উৎপাদন ব্যবস্থার আওতায় দেশের স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় রাশিয়া তাদের ‘স্পুটনিক ভি’ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকে। রাশিয়ার উদ্ভাবিত টিকা ‘স্পুটনিক ভি’ কোভিড ১৯-এর বিরুদ্ধে প্রায় ৯২ শতাংশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন’ ‘দ্য ল্যানসেট’-এর গবেষণা জার্নাল। এই জার্নালটির চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং হাসপাতালে ভর্তি কিংবা মৃত্যু থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষা দেয়। যুক্তরাজ্যের প্রস্তুত করা অক্সফোর্ড এ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং বেলজিয়ামে উদ্ভাবন করা জ্যানসেনের টিকা যেভাবে কাজ করে সেই একইভাবে কাজ করে রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিন। কোল্ড-টাইপ ভাইরাস ব্যবহার করে এটি করোনাভাইরাসের শরীরে ছোট একটি টুকরা ঢুকিয়ে দেয়। টিকা নেয়ার পর শরীর করোনাভাইরাসের এ্যান্টিবডি উৎপাদন শুরু করে দেয়। এখন আসা যাক মানবিকতার বিষয়ে যা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। যেহেতু দেশে ‘লকডাউন’-এর মতো চরম ব্যবস্থা সফলভাবে প্রয়োগ সহজসাধ্য নয়, তাই মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করার ওপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা উচিত। এক্ষেত্রে জনগণকে ঠিকমতো উদ্বুদ্ধ করতে সামাজিক সচেতনতা জরুরী যা কেবল পুলিশী ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব নয়। সবচেয়ে ভাল ফল আসবে যদি জনসাধারণকে এরূপ সচেতনতামূলক কাজে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা যায়। প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় দলমত নির্বিশেষে স্থানীয় রাজনৈতিক/সামাজিক কর্মী ও ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে স্বাস্থ্যসচেতনামূলক প্রচার কাজ চালানো গেলে সফলতা অর্জন সম্ভব বলে আশা করা যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো লকডাউনের কারণে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলোতে। দীর্ঘদিন ঘরে বন্দী থেকে বাবা-মা ও আপনজনের সঙ্গে সময় কাটানো হচ্ছে। বন্দীজীবনে অনভ্যস্ত, বিশেষত শহুরে মানুষ হয়ে পড়ছে মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত, ক্লান্ত ও বিরক্ত। বিদেশী এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনার দিনগুলোতে পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতার পরিমাণ আগের চেয়ে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ঝুঁকিতে পড়ছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য যার বড় কারণগুলোর মধ্যে বিরক্তি ও বিষাদগ্রস্ততা ছাড়াও রয়েছে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা, অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, হতাশা ইত্যাদি। জাতিসংঘের দেয়া তথ্যমতে নারীর ওপর বেড়েছে নির্যাতনের হার। এসব পারিবারিক সংঘাত ও বাবা-মায়ের মধ্যে কলুষতা বাজে প্রভাব ফেলছে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যা কাম্য নয়। কিন্তু সব সময় মনে রাখবেন, পরিবর্তনই জীবনের ধর্ম। তৃতীয় বিষয় হলো দেশে টিকা গ্রহণের বর্তমানের গতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হাতে প্রয়োজন মাফিক টিকা রাখতে হবে, টিকাদানের গতিটা আরও বাড়াতে হবে এবং অঙ্গীকারবদ্ধ সূত্রগুলো থেকে টিকা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন নতুন উৎস থেকে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে নজর রাখতে হবে, ভবিষ্যতে দেশে টিকা উৎপাদন সময়ক্ষেপণ হলেও তা গতিশীল করতে হবে। যদি দ্রুত সমগ্র জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় এনে গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অবশ্যই অন্যান্য উৎস থেকে টিকা আনার ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত, সরকার উন্মুক্ত এলাকায় বাজারের কথা বলেছে, তাতে সমস্যা নেই। তবে বাজারে প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেখা গেছে, মাস্ক পরা ফেরিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি ডাক দিয়ে তরিতরকারি এবং মাছ বিক্রি করেন, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বাজারের ওপর চাপ কমে যাবে। তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বাজার-হাট সমস্যার লাঘব হবে। উচ্চবিত্তের বা উচ্চ মধ্যবিত্তের জন্য এখন অনেক অনলাইন শপিং সেন্টার রয়েছে। সংক্রমণের উর্ধগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউন একটি সাময়িক ব্যবস্থা। আমাদের লকডাউনের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে, করোনার বিরুদ্ধে আমরা জিতব যদি নিজেরা সচেতন হই, সতর্ক থাকি। লেখক : অধ্যাপক, গবেষক ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি
×