ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় উপহার

প্রকাশিত: ২০:২৮, ২৪ এপ্রিল ২০২১

করোনায় উপহার

অতিমারির বন্দীদশা! বিদ্যালয় যেতে হয় না! করোনা সংক্রমণের কারণে দীর্ঘ ছুটি। পড়াশোনা বলতে শুধু অনলাইন। মায়ের স্মার্টফোনই ভরসা। ক্লাসের জন্য মা ম্যাসেঞ্জার খুলে দিয়েছেন। লিঙ্কের মাধ্যমে ক্লাস করে প্রত্যয়। সপ্তাহে চারদিন। নিবন্ধন ও মাসিক বেতনসহ সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে বাবা সিউর জি ফাইভ কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দিয়েছেন ছেলেকে। পারিবাবিক শিক্ষার ধারা তো বন্ধ রাখা যায় না! অনলাইনে কোচিং ক্লাস প্রত্যয়ের সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা! অনেকের মতো তথ্য প্রযুক্তির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র প্রত্যয়ও ঢুকে পড়ল! বিভিন্ন সময়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা তাকে নেটে থেকে ক্লাস করতে হয়। সেটা নির্ভর করে জুম লিঙ্ক পাঠানোর ওপর। ভিডিও ক্লাসের জন্য ৯ জনের একটা গ্রুপ করা হয়েছে। মাইশা, রাজীব, ফারহান, সিনথিয়া ও দীপঙ্করের সঙ্গে পরিচয় করে দিয়েছেন ফারজানা ম্যাম। মাঝে মাঝে লিঙ্ক পেতে দেরি হয়। বিদ্যুত চলে গেলে সংযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়! তা ছাড়া ধীরগতির বিরক্তিকর নেট লাইনের সমস্যা তো রয়েছেই। অনলাইন ক্লাসের বদৌলতে সেলফোনের এ্যানড্রোয়েট সেটে নিমগ্ন থাকে সারাক্ষণ প্রত্যয়। ক্লাস, ওয়াসিফ ও রাজবীরের সঙ্গে ভিডিও গেম খেলা। লকডাউনে ঘরবন্দী থাকার কারণে ফোন আসক্তিটা তৈরি হয়েছে তার। এ নিয়ে বাবার বেশ দুশ্চিন্তা! হাতের আঙ্গুলে মায়ের দুটি মোবাইল সেট অতিরিক্ত চাপাচাপির কারণে অকেজো! সময়মতো খাওয়া নেই। নাওয়া নেই। স্নান তাও কাক স্নান! একদিন হলে তো আরেক দিন হয় না! মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক পিতা সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে জানতে পারেন প্রত্যয়ও মোবাইল সেটে ব্যস্ত। ঘরে ঢোকার আগে জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে নিজেকে বিপন্মুক্ত করেন তিনি। রেগে যান। বাবা স্নানাগারে ঢুকতে গিয়ে মায়ের ওপর চড়াও হন। - সারাক্ষণ মোবাইল! তুমি দেখো না। চোখগুলো তো অকালে খাবে! তুমি মেয়ে আরও মুভি দেখো! ওকে কে সামলাবে? - স্কুল-কলেজ বন্ধ অবস্থায় কি করবে ওরা? মা প্রত্যয় ও প্রমিতিকে সামলাতে হিমশিম খান! মাযের প্রশ্রয়! আবদার মিটাতে গিয়ে বাবা ক্লান্ত। - ঘরে তো জ্ঞান, বিজ্ঞান, গল্প ছড়ার বইও আছে। ওসব পড়ে সময় কাটানো যায়। - ওসব গুগলে সার্চ করলেই পাওয়া যায় বাবা! - এই তুমি চুপ কর! কিছুক্ষণ থেমে প্রত্যয় আবার আওয়াজ তোলে। - জানো বাবা, আজ আমি মোবাইল দিয়ে অনেক কিছু করে ফেলেছি! গামছায় চুল মুছতে মুছতে প্রত্যয়ের দিকে তাকান বাবা। - কী কী শুনি। - দিদির সাহায্য নিয়ে অনলাইনে পিজা খাবারের অর্ডার করেছি। - টাকা কে দিল? - খাবার আসলে তুমি দিবা। - এসব বাসি খাবারে করোনা থাকে! মা প্রত্যয়ের পক্ষ নেন। বলেন - আচ্ছা সেটা পরে দেখা যাবে। লকডাউনে সব কিছু বন্ধ থাকার কারণে কলেজের বেতন নেই! লোকও ছাঁটাই হয়েছে। আয় রোজগার নেই! ঘরে থেকে থেকে ছেলেমেয়েরা মুটিয়ে যাচ্ছে। বাবা শান্ত হন। - কী কী করলি সারাদিন? - ইউটিউব চ্যানেল খুলেছি আর... - আর কী? - শিং মামার ছেলে রাজবীরের সঙ্গে ওয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছি। প্রত্যয়কে থামিয়ে দিয়ে মা-বাবাকে বিষয়টি বর্ণনা করেন। - জানো রাজবীর ছেলেটার কোন বন্ধু নেই! অনেকদিন ধরেই আমাদের ছেলে ওর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব। ফুটফুটে ছেলেটার চোখে কী মায়া! আমি বারণ করি না। ওর জন্মদিনে আমাদের সকলকে নিমন্ত্রণ করেছে। - করোনার মধ্যে নিমন্ত্রণ! - সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরোয়া আয়োজন। সীমিত সংখ্যক অতিথি। অতিথিদের একেকজনকে একেক সময় আমন্ত্রণ করেছেন রাজবীরের মা কানাডিয়ান ইংলিশ স্কুলের শিক্ষক নিরুপমা। - উড়াল সেতু দিয়ে উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টর রাজবীবদের বাসায় পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। কেক কাটার সময় সন্ধ্যা ছ’টা। আমাদের নির্ধারিত সময় ওটাই। সাতটায় সেখানে রাতের খাবার খেয়েই ফিরে আসব। তুমি মানা করো না। তা ছাড়া নিরুপমা ম্যামের বোন উর্মির এক মাস বয়সের ছেলে আর্যকেও দেখে আসা যাবে। মা বিরতিহীনভাবে বলতে থাকেন। - করোনার মধ্যে আমি কিন্তু উপহার সামগ্রী কিনতে মার্কেটে যেতে পারব না! - সে তোমায় ভাবতে হবে না! - সারপ্রাইজ দেব বাবা! - কী সেটা? প্রত্যয়ের উত্তর - বললে তো সারপ্রাইজ থাকল না! সারাদিন মোবাইলমুখী পরিবারের একঘেঁয়েমি দূর করতে মায়ের প্রস্তাবে বাবা গররাজী থাকতে পারলেন না। প্রত্যয়, মা, বোন ও দিদাকে নিয়ে বিকেলে রওনা দেন রাজবীরের সপ্তম জন্ম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। কটেজ তিনতলা বাড়ি। দোতলায় ঘরের দরজাকে আড়াল করে শিং মামা ও রাজবীর অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। মামা ও বন্ধুর মুখে সাদা রঙের মাস্ক। মামার হাতে জীবাণুনাশক ওষুধের প্লাস্টিক বোতল। তিনি সবাইকে একে একে জীবাণুমুক্ত করে ঘরের ভেতর ঢোকালেন। নিরুপমা ম্যামের ছবি বাবা দেখেছেন। তার সুন্দর মুখাবয়ব ঢাকা পড়ে গেছে কালো মাস্কে। হাত নেড়ে বললেন তিনি। - ওয়েলকাম ডিয়ার্স! রিয়েলি উই আর গ্ল্যাড টু সি ইউ অল! বেশ বড় বৈঠকখানার ঘরটা সুসজ্জিত। দূরে দূূরে সোফার আসন। দুটিতে গিয়ে রাজবীর ও প্রত্যয় বসলো। প্রত্যয়ের হাতে নানা রঙের কাগজে মোড়ানো উপহার। বন্ধুর হাতে দিতেই তা খুলে ফেলল সে। এক এক করে বের করতে থাকল হাত টিস্যু পেপার, স্যানিটাইজার, নানা রঙের ছোট ছোট সাবান, স্প্রে মেশিন এবং থাইল্যা-থাকে বাবার আনা বেশ কিছু ডার্ক চকোলেট। রাজবীরের শোরগোল! -ওয়াও! ফাইন! ফাইন! বাবা ওদের কাছে এগিয়ে যান। প্রত্যয়কে জিজ্ঞাসা করেন - তা হলো এই তোমার সারপ্রাইজ? - মাথায় নাড়িয়ে প্রত্যয়ের উত্তর - আমি এসব জমিয়ে রেখেছিলাম বাবা। দিদি মিলে উপহার বাক্স তৈরি করেছি। এসব আমাদের করোনায় উপহার। ছেলের উপযুক্ত উপহার দেখে তৃপ্ত হন বাবা! অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×