ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

স্মারক বক্তৃতায় মুনতাসীর মামুন

’৭১-এ গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল

প্রকাশিত: ২৩:৪০, ১৩ এপ্রিল ২০২১

’৭১-এ গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যারও একটি রাজনীতি ছিল। কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য পাকিস্তানের মিত্র এবং মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। কিন্তু তখন পাশ্চাত্য বা যুক্তরাষ্ট্রের জনমত ছিল গণহত্যার বিপক্ষে এবং তা এত জোরালো ছিল যে, পরে তারা নতি স্বীকার করতেও বাধ্য হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ‘বিজয়গাথা’ নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিরোধিতা ও বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি আড়াল চলে গেছে। এ কারণে স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও জাতি হিসেবে আমরা গণহত্যার দায়ে পাকিস্তানী বাহিনীর বিচার ও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও আদায় করতে পারিনি। শনিবার রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে ‘গণহত্যার রাজনীতি’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এসব কথা বলেন। তিনি আলোচিত বিষয় নিয়ে ৪৬ পৃষ্ঠার গবেষণালব্ধ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। ড. এএর মল্লিক এ্যান্ড আরএন মল্লিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফ্রান্ড এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ আবদুল্লাহ জামালের সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেন আহ্বায়ক ও এশিয়াটিক সোসাইটির সেক্রেটারি মোঃ আবদুর রহিম। বক্তৃতায় মুনতাসীর মামুন আরও বলেন, প্রত্যেক গণহত্যার একটি রাজনীতি আছে। অবশ্য একে রাজনীতি না বলে অপরাজনীতি বলাই শ্রেয়। দীর্ঘদিন পর গণহত্যার এই অপরাজনীতি আবারও আলোচনায় এসেছে। আমরা চাই অন্তত বাংলাদেশে একাত্তরের গণহত্যার অবসান ঘটে এবং ইতিহাসের সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাহলে আর যাই হোক পরাজিতের অপরাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে না। কারণ এই রাজনীতি ইতিহাস থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়েছে, অপরাধের রাজনীতি নয় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে এবং এ প্রেক্ষিতে জাতির নৈতিকতা নামের বস্তুটিকেও নষ্ট করেছে। তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার পর গণহত্যার বিষয়টি বিশ্বে উপেক্ষিত হলো এই কারণে যে, এটি সামনে এলে বিচারের বিষয়টি জোরালো হয়। নৈতিকভাবে তা অস্বীকার করাও কঠিন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এতে সাহায্য করেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সামরিক শাসিত সরকারসমূহ মূলত পাকিস্তারের এজেন্ডাই পালন করতে চেয়েছে। যে কারণে তারা গণহত্যার চেয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে জোর দিয়েছে। কারণ গণহত্যার বিষয়টি এলে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ইসলামী ও জঙ্গী মৌলবাদীদের এ দেশে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। গণহত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা বর্ণনা করে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা যে গণহত্যা ও নির্যাতন চালিয়েছিল বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। গণহত্যার মধ্যে অন্তর্গত বিভিন্ন মানুষকে অকারণে হত্যা, জাতিগত বিদ্বেষ, রাজনৈতিক বিশ্বাস বা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হত্যা। হানাদারদের কারণে মানুষকে বাস্তুত্যাগ করতে হয়েছে। আশ্রয়ের খোঁজে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় পাবার পরেও মহামারী ও নানা কারণে মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন। এসবই গণহত্যা। দেশের ১৮টি জেলায় চার হাজার ১৯০টি গণহত্যার তথ্য তুলে ধরে মুনতাসীর মামুন বলেন, খুলনার চুকনগরে একটি গণহত্যায় ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। এসব গণহত্যার জরিপ নিখুঁত এমন দাবি করা সমীচীন নয়। অনেক গণহত্যা, বধ্যভূমি বা গণকবর এতদিন পর বিস্মৃতির আড়ালে চলে গেছে। তবুও ১৮টি জেলায় গণহত্যার যে তথ্য এসেছে, একইভাবে ৬৪ জেলায় হিসেব করলে সংখ্যা কেমন দাঁড়াতে পারে তা অনুমেয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে তর্ক-বির্তাক হচ্ছে-এমন মন্তব্য করে মুনতাসীর মামুন বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছে। বিএনপি চেয়াপার্সন যিনি একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে বন্দী ছিলেন তিনিও ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক কি হতে পারে। আবার বঙ্গবন্ধুর সহচর ডাঃ কামাল হোসেনের জামাতা যিনি এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে প্রশংসাভাজন হয়েছিলেন সেই ডেভিড বার্গম্যানও বিদেশী পত্রিকায় ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি আরও বলেন, বিএনপি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সমর্থন করেনি। যে কারণে গণহত্যার বিষয়টিও তারা খাটো করে দেখেছে। তিনি এ সময় গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও বেশি গবেষণা ও প্রবন্ধ প্রকাশেরও আহ্বান জানান। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতন নিয়ে যত বেশি তথ্যসমৃদ্ধ প্রকাশনা বের হবে ততই পাকিস্তানী বাহিনীর বিচারের দাবি জোরালো হবে। এটি গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ভূমিকা রাখবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
×