ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুটি গল্প ॥ ব্রততী কবি হতে চেয়েছিল

প্রকাশিত: ০০:৩৪, ৫ মার্চ ২০২১

দুটি গল্প ॥ ব্রততী কবি হতে চেয়েছিল

একেই বলে সোনায় সোহাগা, বিধাতা যেন এভাবেই ওদের জুড়ি বেঁধে রেখেছিলেন। রায়হান আর ব্রততীর সংসার সবেমাত্র তিন বছর পেরিয়েছে। রায়হান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করেছে সে প্রায় একযুগ হবে। বর্তমাানে একটি বহুজাতিক কোম্পানির প্রধান সমন্বয়কারী। মাস শেষে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা বেতনে পরিমাণটাও বেশ স্বাস্থ্যবান। বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই, হাল্কা পাতলা, লম্বাটে; অতি মাত্রায় ভাল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠানে তার সুখ্যাতির বিন্দুমাত্র কমতি নেই। ওপরওয়ালা কর্মকর্তাদের নজর কেড়েছেনে শুরু থেকেই। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার বিকল্প মেলা ভাড়। পরিচালনা পর্ষদের কাছে রায়হান সাহেবের কদর সমীহ করার মতো। ০২. বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী চলছে। রায়হান তার বন্ধুর কাছে জলরং ব্যবহারের বিষদ বর্ণনা দিচ্ছিল। শিল্পী যখন ক্যানভাসে জলরং ব্যবহার করে তখন ভুল হলে সংশোধন করার কোন অবকাশ থাকে না। -কথাটা সঠিক নয়। শিল্পীর তুলির আঁচড় সাধারণ মানুষ কতটা বোঝে বলুন। যে ছবি আঁকে তার চিন্তা ও চেতনায় সংশোধনের বিষয়টা থাকাই স্বাভাবিক। রায়হান প্রতিবাদ না করেই বলে ফেলে- ‘ সত্যিই তো আপনি খুব ভাল বলেছেন। ছবি আঁকেন বুঝি!’ - না, সামান্য পড়াশোনা করেছি। পরিচয় পর্বটা এভাবেই শুরু হয়েছিল। ছবি নিয়ে দুজনার মধ্যে বিচ্ছিন্ন কথা বার্তার মাঝে রায়হান ব্রততীর সেলফোন নম্বর সংগ্রহ করতে ভুল করেনি। তারপর যা হওয়ার তাই, আপন মনে নদীর জল গড়িয়ে গেছে অনেকটাই। সুন্দর মেয়ের ফোন নম্বর সংরক্ষণ করে কতক্ষণ নীরব থাকা যায়! বার বার ফোনে বোতাম টিপতে গিয়েও যথাস্থানে সংযোগ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতীক্ষার বাঁধ আকাক্সক্ষার জোয়ারে ভেসে গেছে সাত দিনের মাথায়। - হ্যালো ব্রততী বলছেন? - বলছ্ - আমি রায়হান বলছি। আর্ট গ্যালারিতে আপনার সাথে কথা হয়েছিল, মনে পড়ছে ? - জি। - আপনার সঙ্গে খুব কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিছু মনে করেননি তো? - মনে করলে কি সংযোগটা চালু থাকত? - ভাললাগল আপনার আন্তরিতা এবং সত্যভাষণ। ভাললাগার নৌকার পালে ততক্ষণে বাতাস লেগেছে। পরস্পর ভাব- বিনিময়, পছন্দ- অপছন্দ, ভাললাগা- মন্দলাগা, প্রিয় কবির নাম, প্রিয় বই, ভবিষ্যত পরিকল্পনা এমনতরো আলাপ আলোচনার সিঁড়ি ভেঙেছে দুজন। সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে দুজনাই এক সময় আবিষ্কার করলো অভীষ্ট লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে তারা। রায়হানের মন-প্রাণজুড়ে ব্রততী। ব্রততীর কণ্ঠে এক ধরনের মাদকতা মেশানো যেন। হালকা গড়ন, খুব ফর্সা না হলেও চমৎকার শ্যামলা গায়ের রং, ঝরঝরে লম্বা চুল, সামনের অবাধ্য একগোছা চুল গাল ছুঁয়ে গেলে কি যে চমৎকার লাগে ব্রততীকে তা বলা হয়নি কখনও, কেবলি বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকা- চুলথেকে পায়ের নখ অবধি পাঠ করে নেয়া যেন রায়হানের নিয়ম মাফিক কাজ। সময় গড়িয়ে যায়। ফোনে কথা হয় প্রতিদিন। মাঝে মধ্যে দেখা হলে রায়হানের পক্ষ থেকে কবিতার বই কিংবা আবৃত্তির সিডি ব্রততীর জন্য বাড়তি পাওনা। বাড়তি পাওনাটুকু চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে ব্রততীর সম্মতিতেই প্রস্তাব পাঠায় রায়হান। সুশিক্ষিত, সুদর্শন, ভাল রোজগারে পাত্র হিসেবে রায়হানের শতভাগ উত্তীর্ণতায় বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলে একদিন ঘোমটা টানা বধূর বেশে রায়হানের সংসারের চাবি আঁচলে জড়িয়ে নেয় ব্রততী। ০৩ সুখের চাদরে গুটি-সুটি মেরে ভালই কাটছিল দাম্পত্য জীবন। ব্র্র্র্রততীর কাব্যচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ হয়; স্ত্রীর সুনাম সুখ্যাতি আর প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রততীর কাব্য ভাবনার প্রদীপের শলতায় তেল ঢালে রায়হান। সময়ে অসময়ে ব্রততীকে চমকে দেয়ার মধ্যে কী যে আনন্দ তার। গতকাল অফিস থেকে ফিরেই ব্রততীকে বিব্রত করে তোলে রায়হান। জান আজ না অফিসে ঢুকেই একটা প্রেমপত্র পেলাম। - তাই না কি? দেখি তো কী লিখেছে প্রেমিকা! - অত সহজে কি প্রেমপত্র দেখানো যায়? এর জন্য তো খরচপাতি দরকার! - কী চাই বল। - সামান্য চুম্বন সখি, বাড়তি আর কিছু নয়। - তথাস্তু। প্রেমপত্র দেখার লোভে সময় অপচয় করতে নারাজ ব্রততী। রায়হান সার্টের বুকপকেট থেকে কম্পোজ করা কাগজটি ব্রততীর হাতে তুলে দেয়। ব্রততী পড়তে থাকে- ‘একটি চুমু দারুণ খরা মিটিয়ে দিলো চুপিসারে/ঠোঁটের ভাষা আভাস দিল যাও গভীরে/ চুপিসারে কেউ বোঝেনি, কেউ দেখেনি ওষ্ঠে ধরা চপলতা/ এক পলকে ভাঙলো আহা মুগ্ধচোখে নীরবতা - রায়হান ভাল হচ্ছে না। আমার লেখা কবিতা চুরি করে আমাকেই প্রেমপত্র পাঠানো হচ্ছে? - শোন তোমার জন্য কয়েকটা বই এনেছি। আমি চাই বইগুলো পড়, কেননা তোমাকে অনেক বড় কবি হতে হবে। ব্রততী অবাক বিস্ময়ে রায়হানকে দেখে। স্বামীর উদারতা, একাগ্রতা আর অনুপ্রেরণার কথা মনে করেই চোখ ভিজে আসে। ভেজা চোখেই রায়হানকে জড়িয়ে ধরে বির বির করে বলে- ‘রায়হান তুমি অনেক বড় মাপের মানুষ।’ - না আমি তেমন কিছু নই। স্রেফ তোমার রায়হান। - শতভাগ আমার। আচ্ছা বল তো আমাকে কবি হতেই হবে এমন কথা তো ছিল না! - তোমার পাণ্ডুলিপি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে অনেক সম্ভাবনা তোমার ভেতর। খানিকটা চর্চা করলে অনেক দূর যাবে তুমি। তবে ছন্দ সচেতনতা আবশ্যক বলে আমার মনে হয়েছে তাই তোমার জন্য ‘কবিতার ক্লাস’ ও ‘ ছন্দের বারান্দা’ বইদুটো নিয়ে এলাম। ব্রততী সদ্য পাওয়া বই’র ওপর চোখ বুলিয়ে নিজের অজান্তেই বলে ফেলে - ‘ রায়হান তুমি তো আমাকে ছন্দ বিসারদ বানিয়ে ফেলবে দেখছি।’ - তা নয়, কবিকে ছন্দ সচেতন হতে হয়। কবিতার ছন্দ, প্রকরণগত দিক, পাশ্চাত্য সাহিত্য এসব নিয়ে ব্রততী- রায়হান যে পাল তোলা নায়ে ভেসে বেড়াচ্ছিল তা নয়; আধুনি কবিতা নিয়ে প্রায়শই মতবিরোধ হতো দুজনার। তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরের অভিজ্ঞতা যখন ব্রততী জোড়াল কণ্ঠে উচ্চারণ করতো তখন সাহিত্যের ছাত্র হয়েও রায়হান অনেক কিছু মেনে নিত। মাঝে মধ্যে ক্ষীণ প্রতিবাদ করলেও ধরে নিত আধুনিকতাকে তো অস্বীকার করা যায় না। তবে কবিতায় নারীর শরীরের বর্ণনা রায়হান মেনে নিতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে ব্রততীর স্পষ্ট উচ্চারণ পাশ্চাত্য সাহিত্য গলধকরণ করবো, আধুনিকতার কথা বলব অথচ ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্ব অস্বীকার করব তা কী করে হয়? তাছাড়া নারীর রূপ লাবণ্য, শারীরিক বর্ণনা কাব্যসাহিত্যে উঠে এসেছে সেই প্রাচীন যুগ থেকে, চর্যাপদ থেকে বৈষ্ণব পদাবলী সর্বত্রই নারীর রূপ লাবণ্য, কবির কবিতায় উঠে এসেছে। সব কথার শেষ কথা হলো অকাট্য এতসব যুক্তি-তর্কের মাঝেও রায়হানের বক্তব্য সুস্পষ্ট, আজকাল কবিতায় যেভাবে নারীর শরীর এবং যৌনতার গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে তা শিল্প নয় ‘ অশালীন সস্তা সুরসুরি’। হুমায়ুন আজাদ যখন লেখেন-‘ইশ! এ-ই, আহ, এইখানে, শিউলি বোঁটায়/রাখ ব্যাঘ্রজিভ, কমলোষ্ঠে, চোষো, ভাঙো, ঘন মধু ঝরে/আহ! মধু খাও, প্রিয় মরে যা-চ্ছি! ফোঁটায় ফোঁটায়/ঝরে যাচ্ছি, ঢোকো, মধুময় চাকের ভেতরে।’ যে যাই বলুক, একে আমি কবিতা বলব না। এটা কবিতা নয়; এখানে দৃষ্টিভঙ্গি শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে ওঠেনি। শিল্প সাহিত্যের এমনতর যুক্তিতর্ক নিয়েই ব্রততী রায়হানের সংসারের হাল ধরে এগুচ্ছিল। সংসারের আকাশ ছেয়ে মেঘের উপস্থিতি দুজনেই টের পায়। আকাশ কালো করা মেঘ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বৃষ্টি ঝরিয়েছে, বৃষ্টিস্নাত দুজন। ০৪ আজকাল কবি হিসেবে নাম ডাক বেড়েছে ব্রততীর। সপ্তাহে দুএকটা সাহিত্য সভায় যোগ দিতে হয়, বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লেখা ছাপা হয়, কবি পরিচিতির পাশাপাশি কবি বন্ধুর পরিধিও। পাশাপাশি কর্মস্থলে রায়হানের পদমর্যাদা বেড়েছে, বেড়েছে অফিসের ব্যস্ততা এবং দায়িত্ব দুটোই্। প্রায়শই বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। এসব নিয়ে ব্রততী আজকাল আর মাথা ঘামায় না। বরং শুয়ে শুয়ে রায়হানকে তার সদ্য লেখা কবিতা শোনাতেই ব্যস্ত থাকে। - বল না কেমন হয়েছে কবিতার চরণ দুটি; ‘মরা নদীর শরীরজুড়ে ঢেউ জাগিয়ে/বদ্ধ কপাট খুললে তুমি হাত বাড়িয়ে। - ভাল। -শুধুই ভাল! - তবে কেউ না কেউ হাত বাড়িয়ে আজকাল কপাট খুলছে তাহলে! - রায়হান ভাল হচ্ছে না বললাম। রায়হানের ইঙ্গিতময়তা ব্রততীর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। একনাগারে সে বলতে থাকে- -জান সাহিত্য পাতার সম্পাদক ফারুক ভাই ‘ছোঁয়া’ কবিতাটির খুব প্রশংসা করেছেন। - বেশ ভাল। - ফারুক ভাই বলেছিলেন- ‘প্রণয় বুঝি দুজন মিলে একটি ছায়া/আলিঙ্গনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া।’ এই চরণদুটি না কি কবিতার প্রাণ। বল না তোমার কি তাই মনে হয়? - মোটেই না। - বুঝতে পারলাম না রায়হান। - তুমি এখন অন্য ভুবনের, আমার কথা বুঝে ওঠা কষ্টকর বটে। - এসব আধ্যাত্মিক কথা ভাল্লাগছে না। তোমাকে বলাই হয়নি ঐ যে পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক আতাহার ভাইর কথা বলেছিলাম না, আতাহার ভাই বেশ জোড় দিয়েই বলেছিলেনÑ আমার মতো করে কবিতায় শরীরের কথা সবাই লিখতে পারে না, বেশ শিল্পীত প্রকাশ ঘটে। - থামো তো এসব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। - রায়হান ভাবতে পারছি না, সত্যিই কি তুমি বদলে গেছো, আজকাল আমার কোন প্রশংসাই যেন সহ্য করতে পারছ না। - ব্রততী কোন পুরুষ তোমার শরীরের গন্ধ খুঁজে পাবে আর তা আমার সহ্য করতে হবে, ভাবলে কী করে! - ছিঃ তুমিও। তুমিও হীনমন্যতায়..... - সত্যি বড় বেশি নোংরা, তাও বলি তোমার কবিতায় ভিন্ন পুরুষের উপস্থিতি অস্বীকার করতে পার? -স্পস্ট করে বল রায়হান। আমি সত্যি সহ্য করতে পারছি না। -গেল সপ্তায় ছাপা হওয়া কবিতায় দেখলাম- ‘নগ্ন হাতের কোমল স্পর্শে রাখা যৌবন/উল্টে পাল্টে খেলতেই পার হে স্বজন।’ শুধু কি তাই! - ‘সর্বনাশের আগুন বুঝি ছড়িয়ে গেলো/শরীরজুড়ে আগুন জ্বালা লাগছে ভাল।’ -রায়হান প্লিজ থামো, আমি ভাবতেই পারছি না... -ব্রততী আমাকে বলতে দাও। সাহিত্য সভার নামে তোমার ব্যস্ততা সময়ে অসময়ে বাড়ি ফেরা, আর তোমার কবিতার পঙক্তি আমাকে অন্যকিছু ভাবতে শিখিয়েছে। তুমি যখন লেখো- ‘ভুলেই গেছিস মরণ খেলায় খুললে শরীর/লগ্ন ঝরায় চোখের পাতায় নষ্ট শিশির।’ এর অর্থ কী বল, তুমিই বল। -তোমাকে অনেক বড় মাপের মনে করে ছিলাম। তোমার মূল্যায়ন আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। রায়হান তোমার অপ্রিয় সত্য চিন্তাধারা তোমারই থাক। নতুন করে তোমার স্বরূপ ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এই যা! -আমার যা মনে হয়েছে তাই বলছি, এখানে ভণিতা নেই। যা সত্য তাই বলছি। কথার পিঠে কথা বাড়ায় না ব্রততী। সবকিছু এলো মেল হয়ে আসে। রায়হানের সঙ্গে প্রথম দেখা হবার মুহূর্ত থেকে পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মেলাতে চেষ্টা করে। হঠাৎ রায়হানের এমনতর আচরণের মানে কী হতে পারে? তা হলে রায়হান কি ব্রততীর প্রতিষ্ঠা আর সুনাম সাখ্যাতি মেনে নিতে পারছে না? অযথাই সন্দেহের তীর কেনো ব্রততীর দিকে? মাত্র তিন বছরের সংসার। কী করবে ব্রততী? কী করা উচিত তার। নানান প্রশ্ন তাকে বিব্রত করে তোলে, এর সমাধান কী? এদিকে রায়হানও খুব একটা ভাল নেই। দৈনন্দিন কাজে প্রায়শই ভুল হচ্ছে। অফিসের কর্তাব্যক্তি জরুরী ফাইলে স্বাক্ষর না করে নোটশিটে লাল দাগ দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন রায়হানের টেবিলে। অবশ্য পরবর্তীতে রায়হানকে রুমে ডেকে বলে দিয়েছিলেন- ‘কটা দিন না হয় ছুটি নিয়ে হাওয়া বদল করে আস।আমি এডমিন ম্যানেজারকে বলে দিচ্ছি।’ বসের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার। কিন্তু রায়হান কী করে বসকে বোঝাবে সমস্যা অন্যখানে। সারাক্ষণ ব্রততীর চাইতে ব্রততীর কবিতার লাইন তাকে ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত আর ক্ষত বিক্ষত করে চলছে। সত্যি কি ব্রততী পরপুরুষে আসক্ত? আসক্ত যদি নাই বা হলো তা হলে কী করে লেখে- ‘পথের বাঁকে পথ হারিয়ে সেইতো তুমি এলে/ এলেই যদি একা থাকার কষ্ট কেন দিলে।’ প্রতিটি শব্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রায়হান। সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। একা থাকার কষ্ট বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে সে? শয্যা সঙ্গিনী হয়েও কি সে একা? তাহলে ব্রততী কি রায়হানকে ঠকাচ্ছে? অনেক প্রশ্নের ভিড়ে রায়হান স্থির হতে চেষ্টা করে। পুরো বিষয়টি খোলামেলা আলাপ করবে ব্রততীর সঙ্গে তারপর সিদ্ধান্ত নেবে, হােক সে কঠিন। ০৫. তিন দিন অতিক্রান্ত হলেও কেউ কারো সঙ্গে কথা বলে না। কাজের মেয়েটাই সব সামলায়। সংসারের নিম্নচাপ এড়াতে চায় ব্রততী। ব্রততী তার সিদ্ধান্তে অটল। এভাবে সন্দেহের বীজতলার পরিচর্যা করে কী লাভ? যা হবার তাই হবে। সামনে ঘরের বাইরে নির্মল আকাশ। জানালার গ্রিল ডিঙিয়ে আকাশ খোঁজার কোন মানে নেই্। যেখনে অবিশ্বাস আর সন্দেহ সেখানে পথ চলা অসম্ভব। রায়হান ঘরে ডুকে ব্রততীর উপস্থিতি আঁচ করতে চায়। এ সময় তো তার কোথাও যাবার কথা নয়। তাহলে কি ব্রততী কোন সম্পাদকের সঙ্গে সাহিত্য চর্চায় ব্যস্ত, কোন পত্রিকা অফিসে অথবা কোন সাহিত্য আড্ডায়? ভাবনার মাঝখানে কাজের মেয়ে কমলার ডাকে ফিরে তাকায় রায়হান। -খালাম্মা আপনারে এই কাগজটা দিতে কইছে। -খালাম্মা কোথায়? -কিছু কইয়া যায় নাই। আপনারে কাগজটা দিতে কইছে। রায়হান ধীরে ধীরে ভাঁজ করা কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে। বেডরুমের সাইড টেবিলের পাশে ব্রততীর পাণ্ডুলিপির টুকরো টুকরো পোড়া আর ছেঁড়া কাগজের ছাইÑ রায়হানকে হতবাক করে দেয়। রায়হান ভাঁজ করা কাগজটা মেলে ধরে, ব্রততী লিখেছে- রায়হান, গেলো কটা দিন নিজের সঙ্গে বোঝা-পড়া করতে বেশ সময় লেগেছে। অনেক ভেবে চিন্তে তোমার সমস্ত অভিযোগ মাথা পেতে নিয়েছি। পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থার ধারাটা হঠাৎ করে তো আর বদলে দেয়া সম্ভব নয়! তবুও আমি আমার সবশেষ ঘৃণাটুকু প্রকাশ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বার বার মনে হয়েছে যেখানে শ্রদ্ধা আর বিশ্বাসের ঘাটতি সেখানে সব মিথ্যে, অর্থহীন। সন্দেহের বীজতলা থেকে চাড়াগাছ আর সেই চাড়াগাছটা বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠবার আগেই আমি নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। কবিতা পাগল মন- তোমার অনুপ্রেরণায় লাল নীল ফানুস হয়ে আকাশে উড়তে চেয়েছিল। কিছুটা সময়- তা সম্ভব হলো কই, ফানুস উড়বার যে প্রাণশক্তি সেখানেই ভেজাল! কেবলি সন্দেহ, যেখানে কোন সত্য নেই। ছেঁড়া পাণ্ডুলিপির টুকরো কাগজ আর ছাইভস্ম প্রমাণ করবে তোমার সন্দেহ তোমাকে কোথায় দাঁড় করিয়েছ্ েআগুনে পোড়া ছাই আর ছেঁড়া পাণ্ডুলিপি তোমাকে নিশ্চয়ই নিশ্চিত করবে যে ব্রততী কবি হতে চেয়েছিল অন্য কিছু নয়। কবির কাব্যলক্ষ্মী কিংবা অন্তরে লালিত মানস সুন্দরীকে চিনে নেয়ার সামর্থ্য কজনার থাকে! এ নিয়ে আমার দুঃখ নেই। সন্দেহ মুক্ত থেক। তোমার আকাশে যে কবিতার ঘুড়ি উড়িয়েছিলাম তার আজ সুতো ছিড়ল। ব্রততী। ০৬ মাননীয় পাঠক, ব্রততীর কবি হওয়ার গল্পটা এভাবেই শেষ হতো। কিন্তু সত্যি কি ব্রততী আর কোন দিন কোন কবিতা লিখবে না? ব্রততীর কাব্যলক্ষ্মীর ভাষা আর মানস সুন্দরী কি পুনর্বার জাগিয়ে তুলবে সন্দেহের বিরুদ্ধে? ব্রততী কি প্রমাণ করবে সত্যি সত্যি সে কবি হতে চেয়েছিল। পাঠক, এ প্রসঙ্গে আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
×