ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বীমা নিয়ে দুর্নীতি বন্ধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২ মার্চ ২০২১

বীমা নিয়ে দুর্নীতি বন্ধে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রাহকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেবা দেয়ার জন্য বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বীমা মূলত একটি সেবামূলক পেশা। এ সেবাকে জনপ্রিয় করাসহ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সরকারী-বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। গ্রাহকের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বীমা সেবা প্রদান করতে হবে। সোমবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত জাতীয় বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বীমা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি এড়াতে এ খাতে সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের মানুষের কিছু অভ্যাস আছে। তারা ব্যবসা করতে গিয়ে বীমা হয়তো করেছে, কিন্তু অনেক সময় কোন ক্ষতি না হলেও নিজেরা আর্টিফিসিয়ালি কিছু ক্ষতি করে কিংবা কোথাও একটু আগুন লাগাল বা কোথাও কোন ঘটনা ঘটাল- এভাবে একটা মোটা অঙ্কের বীমার প্রিমিয়াম থেকে টাকা চায়। কিন্তু খোঁজ করে দেখা যায়, যে পরিমাণ অর্থ সে দাবি করছে, সেই পরিমাণ খরচ হয়নি। যারা পরীক্ষা করতে যাবে, তাদেরও আপনাদের ভালভাবে শিক্ষা দিতে হবে। তারা যেন আবার অন্য কোনভাবে ওই অল্প ক্ষতিকে বড় ক্ষতি করে না দেখায়। এরকম কয়েকটি ঘটনা তিনি ‘হাতেনাতে ধরতে পেরেছেন’, সে কারণেই বিষয়টি অনুষ্ঠানে উল্লেখ করলেন জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, কাজেই এখানে যে দুর্নীতিটা, এটাও এখন অনেক কমে গেছে। কিন্তু আরও সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। সে বিষয়টি আপনারা খেয়াল রাখবেন বলে আমি আশা করি, কারণ একটা মানুষের সেবা দেয়া, আর মানুষ একট আমানত রাখছে। সেটাকে আবার অন্যভাবে যেন কেউ ব্যবহার করতে না পারে। সেই বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকার জন্যও আমি অনুরোধ জানাচ্ছি। ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, বীমা হোক সবার’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সোমবার দেশজুড়ে যথাযথভাবে জাতীয় বীমা দিবস-২০২১ পালিত হয়। স্বাধীনতার মহান রূপকার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বীমাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ১৯৬০ সালের ১ মার্চ আলফা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে যোগ দেন। এই দিনটির স্মরণে সরকার প্রতিবছর ১ মার্চ জাতীয় বীমা দিবস পালন করছে। অনুষ্ঠানে বীমা খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্যে চার বিশিষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল এমপি এই চার বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন এবং চার ছাত্রের মাঝে বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমাও বিতরণ করেন। মোট ৫০ হাজার ছাত্রকে এই বঙ্গবন্ধু শিক্ষা বীমা দেয়া হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। এছাড়া ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ বীমা সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন। অনুষ্ঠানে বীমা খাতের ওপর একটি তথ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে দেশে বীমার সম্প্রসারণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, গ্রাহক স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকাকার দেয়ার পাশাপাশি একে জনপ্রিয় ও জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সরকারী ও বেসরকারী বীমা কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। জনগণ যাতে সঙ্কটকালীন বীমা পলিসি খুলে সুবিধা পেতে পারে সে জন্য তথ্য দিয়ে তাদের বীমা সম্পর্কে সচেতন করতে বীমা কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বীমা কোম্পানিগুলোর উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, জনগণ যাতে বীমার বিষয়ে উৎসাহিত হয়, সে লক্ষ্যে তাদের সচেতন করতে আপনাদের আরও ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন বীমা খাতে অনেক আধুনিক পদ্ধতি এসেছে। তাছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ, আপনারা (বীমা খাত সংশ্লিষ্টরা) ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন বীমা সেবা দেয়ার জন্য। যেটা বীমা প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করবে, প্রিমিয়াম দেয়া শুরু থেকে অন্য সর্বক্ষেত্রে। আমরা চাই বীমা সম্পর্কে মানুষ আরও আস্থাশীল হোক। আর অমরা বীমা খাতে আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারি এবং তার ওপর নির্ভর করতে পারি। সেইদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। যাতে বীমার পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের একটা সহায়ক শক্তি হিসেবে বীমা কাজ করে। স্বাস্থ্যবীমা চালু করা আরও একান্তভাবে প্রয়োজন বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যেটা নিয়ে এখনও আমাদের দেশের মানুষ সচেতন না। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের মধ্যে সেই সচেতনতা সৃষ্টি হবে। যার জন্য আমাদের বীমা উন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তা আরও কার্যকর করার দরকার। যাতে বীমার পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষের একটা সহায়ক শক্তি হিসেবে এটা কাজ করে। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ, জীবন বীমা কর্পোরেশন, সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ইন্স্যুরেন্স একাডেমির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অটোমেশনের জন্য ৬৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে এবং তার কাজ চলমান রয়েয়ে বলেও অনুষ্ঠানে অবহিত করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবারের বীমা দিবসে যে প্রতিপাদ্য নেয়া হয়েছে সেটা হলো- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার বীমা হোক সবার’। এই প্রতিপাদ্যটি যথার্থ হয়েছে বলে আমি মনে করি এবং সেজন্য সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাই। কারণ আমাদের অর্থনীতি যত বেশি শক্তিশালী হবে, বিস্তৃত হবে, মানুষ সচেতন হবে- বীমার গুরুত্বটাও কিন্তু ততটা বাড়বে। এই বীমা থেকে যে সুফলটা পেতে পারে মানুষ, এ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমি আশা করি যে, আপনারা যারা বীমার সঙ্গে জড়িত, তারা উদ্যোগ নেবেন মানুষের মাঝে সচেতনতাটা বৃদ্ধি করতে। বীমা নিয়ে কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের মানসিকতা আছে কিছুটা, সেটা হলে অনেকেই বীমার যে প্রিমিয়ামটা দিতে হয়, ওইটুকু টাকা দিতে হয়, সেটাও খরচ করতে চান না। পরে যখন দুর্ঘটনায় পড়েন, তখন এর গুরুত্বটা বোঝেন। বীমা থাকলে যে মানুষ দুঃসময়ে সুবিধা পায়, সে বিষয়টি তুলে ধরে নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দেন সরকার প্রধান। তিনি বলেন, মানুষকে যদি আপনি উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, তাহলে প্রত্যেকটা মানুষ কিন্তু ছোটখাটো ব্যবসা বাণিজ্য যাই করুক, তারা করবে। এ ব্যাপারে আরও প্রজার একান্তভাবে দরকার বলে আমি মনে করি। বীমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটার প্রচারটা খুব বেশি দরকার। গ্রাহকেরা বীমার ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামটা যাতে সঠিকভাবে দেন, সেটাও যেমন প্রয়োজন, আবার বীমার টাকাও যেন সঠিকভাবে পান, সেই বিষয়েও যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। বীমা শিল্পের উন্নয়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরার পাশপাশি অনুষ্ঠানে এ শিল্পের বিকাশে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও বলেন শেখ হাসিনা। বীমা শিল্পে বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাই ১ মার্চকে বীমা দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্তের জন্য। ১৯৫৯ সালের এ দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু বীমা শিল্পের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতেই গঠিত হয় ইন্সুরেন্স একাডেমি। বীমা শিল্পের প্রসারে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্যই তিনি এ একাডেমি গঠন করেন, যা আমাদের দেশে বীমা শিল্পের প্রসার ঘটানোর জন্য এখনও কার্যকর রয়েছে। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পান। একটা শূন্য থেকে তিনি শুরু করেন। একটি রাষ্ট্র গঠনে যা যা প্রয়োজনীয়, তিনি করে গিয়েছেন। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি তিনি তৈরি করে দিয়ে যান এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিও বাংলাদেশ শুরু করে। দেশের মানুষের জীবনে শান্তি নিরাপত্তা ফিরে আসে, মানুষ যখন যুদ্ধের ভয়াবহতা কাটিয়ে ওঠে, ঠিক সেই সময়ে আসে চরম আঘাত- ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট। বীমা শিল্পের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আমরা পুরনো বীমা আইন যেটা ১৯৩৮ সালের ছিল, আমরা সেটা রহিত করে দিয়ে ২০১০ সালে নতুন আইন প্রণয়ন করি। আমরা সময় উপযোগী বীমা আইন প্রণয়ন করি। তৎকালীন বীমা অধিদফতর করে বিলুপ্ত করে দিয়ে বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়, যাতে এটা আরও শক্তিশালী হয়। তিনি বলেন, জাতীয় বীমানীতি ২০১৪ আমরা প্রণয়ন করি এবং তা বাস্তবায়নে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই। বিদেশগামী কর্মী যারা বিদেশে কাজ করতে যায়, তাদের জন্য বিদেশি কর্মী বীমা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি মোকাবেলার হাওর এলাকা, উপকূলভিত্তিক এলাকায় আমরা আবহাওয়াভিত্তিক শস্য বীমা চালু করেছি। তবে আমাদের স্বাস্থ্য বীমাটা আরও ব্যাপকভাবে চালু করাটা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
×