ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ২৩:০২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ ভাষা সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছিল বাঙালী। তার পর থেকে প্রতিবছর নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। পালিত হয়েছে আজকের এই কারোনাকালেও। গত রবিবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে, সরকারের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যরা ব্যানার দেখিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। একা কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে, বিশেষ করে শিশুসন্তানকে নিয়ে আসেন অনেকে। সবার ফুলে দারুণ সেজে ওঠে স্মৃতির মিনার। মাইকে একুশের কবিতার প্রিয় পঙ্ক্তি। ভাষার গান। পোশাকে শোকের বহিঃপ্রকাশ। বুকে বাঙালীত্বের গৌরব। সব মিলিয়ে অমর একুশে। কিন্তু তার পর? ২২ ফেব্রুয়ারি? ২৩? ২৪? ২৫ ফেব্রুয়ারি? একেবারেই উল্টো ছবি। ফুল হাতে ভিড় করা ভাষাপ্রেমীদের কারও আর দেখা মিলছে না সেখানে। শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে যারা অপেক্ষা করছিলেন তারা একদমই উধাও। কিংবা যারা একুশের দিনে ফুলটুল দিয়ে গেছেন তারাই হয়ত এখন ভুলে গেছেন সব। ফলে বাঙালীর স্ববিরোধিতার পুরোটা দেখা যাচ্ছে শহীদ মিনারে। কী যে বীভৎস এ ছবি! ২১ ফেব্রুয়ারি যে শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল, সেই একই স্থান এখন ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ! দেখে বোঝার উপায় নেই, এটিই সেই শহীদ মিনার! সবচেয়ে কষ্ট হয় যখন দেখি, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, আধুনিক ও পিছিয়ে পড়া সকলেই বিনা দ্বিধায় জুতো পায়ে শহীদ মিনারের বেদিতে উঠে যাচ্ছেন। সদ্য রং করা বেদি ধুলোয় ম্লান হয়ে গেছে এরই মাঝে। এমন কেন আমরা? এত স্ববিরোধিতা নিয়ে মানুষ বাঁচে? একটা দেশ কত কী করে ফেলছে। কত অসম্ভবকে বাস্তবে করে দেখিয়েছে। শহীদ মিনারের পবিত্রতা, ভাবগাম্ভীর্য রক্ষা করতে হবে। হবেই। এটুকু নিশ্চিত করতে পারে না। কী আছে বলার? ভাবতে অবাক লাগে জুতো পায়ে শহীদ বেদিতে দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তিটি ছবি তুলছে, সেও বাঙালী! যারপরনাই প্রাজ্ঞ-বিজ্ঞ চেহারা। কত বিষয়ে আড্ডা জমাচ্ছেন। সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন। দেশ দুনিয়ার সব কিছু বোঝেন তারা। শুধু বোঝেন নাÑ শহীদ মিনারটি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। একদিন নয়, সারা বছরই এ শ্রদ্ধা ধরে রাখা চাই। অমর্যাদা করার ধৃষ্টতা কেউ দেখাতে পারে না। অথচ একেবারে সব বয়সী মানুষ হরদম শহীদ মিনারের মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করে চলেছে। পুরো এলাকাজুড়ে উৎসবের আমেজ। যেন গ্রামীণ কোন মেলা চলছে। চত্বরজুড়ে বসে গেছে হাটবাজার। একদল বাবা, মা তাদের শিশুসন্তানদের শহীদ মিনারে খেলাধুলো করার জন্য নিয়ে আসছেন। প্রতিদিন শহীদ মিনারের বেদিতে চলছে বাইসাইকেল। এমনকি স্কেটিং করছে শিশুরা। কেউ কেউ দয়া করে জুতো খুললেও, সে জুতো রাখছেন বেদির ওপরই। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাড়া সারা বছরই ছবিটি এমন। কারও তাতে কিছু যায়আসে না। কত দায়িত্বশীল সরকার, প্রশাসন, কত শক্তিধর নেতা, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সরকারী দল, বিরোধী দলÑ সবাই একুশের দিনে শহীদ মিনারে এসে পুষ্পস্তবক অর্পণ করছেন। কিন্তু বাকি সময় শহীদ মিনারের মর্যাদা রক্ষায় তারা কোন ভূমিকা রাখছেন না। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোগটির নাম ‘অভ্যস্থতা।’ এই অবমাননা দেখে রাজধানীবাসী, বলা চলে, অভ্যস্থ। হুজুগে তারা ভাল করছেন। হুজুগেই করছেন ততোধিক মন্দ। কিন্তু এভাবে আর কত? কবে, কারা এই লজ্জা থেকে জাতিকে মুক্তি দেবে? হঠাৎই পেয়ে বসেছে মশা ॥ রাজধানীবাসীকে হঠাৎই মশায় পেয়েছে। পেয়ে বসেছে। হঠাৎই বলার কারণ। মাঝে কিছুদিন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে ছিল। এখন আবার জ্বালিয়ে মারছে। সাধারণত ময়লা-আবর্জনার স্তূপ বা ডোবা-নালা বেষ্টিত এলাকায় মশার প্রজনন বেশি হয়। কিন্তু এখন ঢাকার প্রায় প্রতি প্রান্তে মশার উপদ্রব। মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, শান্তিনগর থেকে শুরু করে মহাখালী, ডিওএইচএস, বাড়িধারা, ধানমণ্ডি সবখানেই হুল ফোটাচ্ছে মশা। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অধিবাসীরা তো বলছেন, মশা মনে হচ্ছে উঠিয়ে নিয় যাবে আমাদের! কেন? কোথা থেকে এত মশা? নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। তবে একটি ব্যাখ্যা এ রকম : শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। বাড়তে থাকা তাপমাত্রায় একসঙ্গে অসংখ্য ডিম ফোটাচ্ছে। এ কারণে ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ মাসে মশার ঘনত্ব বেড়ে যায়। এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাও সম্প্রতি সামনে এসেছে। গবেষণাটি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার। তার গবেষণা থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য আমরা পাচ্ছি। সে অনুযায়ী, মশা সত্যি বেড়েছে। শুধু বাড়েনি। গত বছরের তুলনায় মশার ঘনত্ব বেড়ে চারগুণ হয়ে গেছে! ঢাকার উত্তরা, খিলগাঁও, শনির আখড়া, শাঁখারিবাজার, মোহাম্মদপুর ও পরীবাগসহ ছয়টি এলাকার নমুনা নিয়ে গবেষণা করে এমন তথ্য দিয়েছেন তিনি। বাশার বলছেন, গড় ঘনত্ব প্রতি ডিপে ৬০টির বেশি। অন্যান্য সময় ১৫ থেকে ২০টি পাওয়া গেছে। এখন জ্বালাতে আসা মশাদের ৯৯ ভাগই কিউলেক্স। তার মতে, বহুদিন বৃষ্টি না থাকায় নর্দমা, ড্রেন, ডোবা, বিলঝিলের পানি পচে গেছে। আটকেপড়া পানিতেই জন্ম নিচ্ছে কিউলেক্স মশা। মশা নিধনে জরুরী পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন তার পরামর্শ কতটুকু শুনছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। শুনুক বা না শুনুক, মশা থেকে এখনই মুক্তি চায় নগরবাসী। মিলবে তো?
×