ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করবে নির্মূল কমিটি

’৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতির উদ্যোগ ধামাচাপা

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৭ জানুয়ারি ২০২১

’৭১-এর গণহত্যার স্বীকৃতির উদ্যোগ ধামাচাপা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে অনেকটা অতর্কিত মুক্তিকামী মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’র নামে নির্বিচারে গণহত্যায় মেতে ওঠে তারা। বিজয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে ১৪ ডিসেম্বর বাংলার সূর্য সন্তানদের হত্যা করে পাক সেনারা। যুদ্ধের শুরু থেকে শেষাবধি চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। তবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাত্রীকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পালন এবং বাংলাদেশের গণহত্যার ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ২০১৭ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হলেও সরকারীভাবে গৃহীত হয়েছিল। অথচ এ পর্যন্ত ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকেরা বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করাতে হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধাপ অতিক্রম করতে পারেনি বাংলাদেশ। এই প্রেক্ষিতে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য ৩০ লাখ গণস্বাক্ষরযুক্ত আহ্বান জাতিসংঘে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সামাজিক সংগঠন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আগামী মাস থেকে এ কর্মসূচী শুরুর কথা জানিয়েছেন সংগঠনের নেতারা। প্রথমে রাজধানী ঢাকায় আনুষ্ঠানিক গণস্বাক্ষর নেয়া শুরু হবে। এরপর ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি দেশের সকল জেলা উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত নেয়া হবে এ গণস্বাক্ষর। গণস্বাক্ষর নেয়ার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে ফরম তৈরি করা হচ্ছে। জানতে চাইলে নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল বলেন, এ কাজটি সরকারের পক্ষ থেকে করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও এ বিষয়ে চার বছর পেরিয়ে গেলেও কোন অগ্রগতি নেই। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগ না নেয় তাহলে কারা নেবে। আশাকরি সরকার এ ব্যাপারে আন্তরিক হবে। সকলে মিলে জাতিসংঘের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করা গেলে পুরো বিষয়টি আন্তর্জাতিক রুপ নেবে। যা আমাদের দেশের জন্য বড় অর্জন। তিনি বলেন, আগামী মাস থেকে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচী আমরা শুরু করছি। আস্তে আস্তে পুরোবছরে ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে তা শেষ হবে বলেও জানান তিনি। নির্মূল কমিটির সংগঠকসহ বিশিষ্টজনরা বলছেন, স্বীকৃতি আদায়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হলেও আমরা আশাবাদী সামনের দিনগুলোতে এ বিষয়ে আমরা সফল হবো। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সন্ত্রাসী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার সর্ববৃহৎ নাগরিক সংগঠন নির্মূল কমিটি ৩০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে স্বাগত বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে নির্মূল কমিটি আগামী এক বছরে ১৯৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের ৩০ লক্ষ নাগরিকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করে জাতিসংঘসহ সদস্য রাষ্ট্রসমূহের সরকারের নিকট পাঠাবে। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন এবং বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য ২০১৭ সালের মার্চে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হলেও সরকারীভাবে এ পর্যন্ত ’৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে যৌথভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’ শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘পাকিস্তান ও পাকিস্তানপন্থীরা প্রথম থেকেই ’৭১-এর গণহত্যার দায় শুধু অস্বীকার করছে না, বরং এই মুক্তিযুদ্ধকালে তথাকথিত পাকিস্তানীদের হত্যার জন্য বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে দায়ী করছে। নির্মূল কমিটি দীর্ঘকাল পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে ’৭১-এর নৃশংসতম গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে গণহত্যাকারীদের বিচারের পক্ষে দেশে ও বিদেশে জনমত সৃষ্টির কার্যক্রম অব্যাহত রাখলেও সরকার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে অন্তিমে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের মিথ্যা বয়ান সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হবে এবং এরজন্য আমাদের ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবারসহ গোটা জাতির কাছে দায়ী থাকতে হবে।’ মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটা গণমানুষের কাছে পৌঁছাতে পারত না। গণমানুষ যদি আন্দোলিত না হত তাহলে হয়ত আমাদের দল এবং সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে হয়ত এভাবে উদ্যোগ নিত না। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির বিষয়ে নির্মূল কমিটি যে প্রস্তাব করেছে সে প্রস্তাবের সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। দ্রুতই মন্ত্রীপরিষদে নির্মূল কমিটির এই দাবির বিষয়ে আমি কথা বলব। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর আগে বেসরকারী উদ্যোগে ২০০১ সালে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস পালনের দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথমবার তোলা হলেও সরকারী উদ্যোগের অভাবে তা এগোয়নি। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিলে সে সুযোগ হাতছাড়া হয় বাংলাদেশের। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য আমরা জাতিসংঘের ইউনেস্কো এবং গণহত্যার ভুক্তভোগী বিভিন্ন দেশকে চিঠি লিখেছি। বাংলাদেশ স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টিতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা করা হয়। শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, এই সুযোগ হারানোর কারণে এখন আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য। এ স্বীকৃতি অর্জনের পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে গতবছরের ১৪ মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তিনটি প্রস্তাবও দেয়। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন উদ্যোগ নেয়নি বলে দাবি করেন শাহরিয়ার কবির। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশগুলোকে অনুরোধ করা হয়েছে এমন তথ্যও তারা পাননি। শাহরিয়ার কবির বলেন, ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল, তাদের অনুরোধ করলেই দেশগুলো তাদের পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করবে বলে আশা করা যায়। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওনের মতো ছোট ছোট দেশ তাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পেরেছে। সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে নয় মাসের গণহত্যার স্বীকৃতি অবশ্যই পাওয়া যাবে। এরজন্য কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু পাকিস্তান নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়া আমেরিকা ও চীনের সমর্থন আদায়েও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।
×