ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তারা বর্তমানে লিবিয়ায়

ছয় মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ১৪ জানুয়ারি ২০২১

ছয় মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিস

শংকর কুমার দে ॥ দেশের ভয়ঙ্কর ছয় মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করেছে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা, ইন্টারপোল। পুলিশের কাছে এই ছয় মানব পাচারকারীর পরিচয় ‘গেমিং হোতা’। দেশের ভেতরে ওরা মোস্ট ওয়ান্টেড। ওরা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য। বর্তমানে তারা পলাতক হয়ে অবস্থান করছে লিবিয়ায়। ইন্টারপোলের মাধ্যমে ওদেরকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো তো হয়েছেই, এ ছাড়াও লিবিয়া সরকারের কাছে তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্রায় এগারো মাস আগে গত বছরের ২৮ মে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী পাচার হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহত হওয়ার ঘটনায় এ পর্যন্ত মামলা হয়েছে ২৬টি। এজাহারভুক্ত আসামির সংখ্যা ২৯৯ জন। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছে ১৭১ জন। এর মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে ৪২ জন। গ্রেফতারদের দেয়া জবানব›ীদর ভিত্তিতেই গেমিং হোতা ছয় মানব পাচারকারীর নাম পাওয়ার পর ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, লিবিয়ায় পলাতক ছয় আসামি হলো- ইকবাল জাফর, তানজিরুল, স্বপন, শাহাদাত হোসেন, নজরুল ইসলাম মোল্লা ও মিন্টু মিয়া। তাদের মধ্যে নজরুলের বাড়ি মাদারীপুর। বাকি পাঁচ জনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। তাদের সবার বিরুদ্ধে বিদেশে পাচার, আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়, এমনকি হত্যার অভিযোগও রয়েছে বলে ইন্টারপোলের নোটিসে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি বলছে, ভাগ্য বদলাতে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাত্রায় দালালচক্রের ফাঁদে পড়ে প্রতিনিয়ত নিরুদ্দেশ হচ্ছে অগণিত বাংলাদেশী তরুণ-যুবক। নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়েও এদের অধিকাংশ মারা যাচ্ছে। মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের পর লিবিয়া থেকে ইতালির উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরে কোনরকম একটি কাঠের নৌকায় তুলে দিয়ে দায় সারে দালালরা। এ কাজটাকে তারা বলে ‘গেমিং’। ইন্টারপোলের রেড নোটিস যাদের বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে তারা এই ‘গেমিংয়ের’ হোতা। এমন আরও অন্তত ২০ ‘গেমিং’ হোতার তথ্য পাওয়া গেছে। বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা গেলে তাদের বিরুদ্ধেও নোটিস জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে। লিবিয়ায় মানব পাচার মামলার ছয় পলাতক আসামির সন্ধান চেয়ে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করেছে বাংলাদেশ পুলিশ। আন্তর্জাতিক সংস্থায় নোটিস দেয়ার পর ছয় মানব পাচারকারী সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের পুলিশ যোগাযোগ করে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় জনশক্তি পাঠানো বন্ধ থাকার কারণে বিগত বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে লিবিয়া উপকূল থেকে নৌকাযোগে ইউরোপে প্রবেশ করছে অনেক বাংলাদেশী। আদম ব্যবসায়ীরা তাদের নিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানে যাওয়ার সময় প্রায়ই নৌকাডুবির দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মালয়েশিয়ায়ও আবার সাগরপথে মানব পাচার শুরু হয়েছে। পাচারকারী চক্রের টার্গেট গ্রুপ এবার রোহিঙ্গা। পাশাপাশি কিছু বাংলাদেশী নাগরিককেও রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাছ ধরার নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যাচ্ছে। পাচারকারী চক্রের প্রলোভনে বহু মানুষ বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে উত্তাল সাগর। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছে। তাছাড়া থাইল্যান্ডে কয়েকটি বড় গণকবর পাওয়া যায়। তারপর সরকারের পক্ষ থেকে মানব পাচার বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিলেও কিছুদিন মানব পাচার বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়। লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশী নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর থেকে মানব পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, একশ্রেণীর দালালের মাধ্যমে অভিবাসন প্রত্যাশীরা বেশি বেতনের চাকরির লোভে বিদেশ যাচ্ছে। তাতে বৈধ শ্রমবাজারের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। সেখান থেকে উত্তরণ না ঘটাতে পারলে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব/সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছে। সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ আইন করলেও তার তেমন প্রয়োগ হচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে না পারলে বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজার হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। সমুদ্রপথে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়ায় অনিয়মিত অভিবাসন দেশের সার্বিক অভিবাসনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি পাচার ও অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মানুষের ধারণা স্পষ্ট না হওয়ার কারণে সীমান্তবর্তী এলাকায় ভিকটিমরা উদ্ধার হলেও পুলিশ পাচারের মামলা রুজু না করে পাসপোর্ট আইনে মামলা করে। মানব পাচার প্রতিরোধে সচেতনতার পাশাপাশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সময়োপযোগী ও সর্বজনীন আইন প্রণয়ন জরুরী। এ ছাড়া দায়েরকৃত মামলার ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হয় না। আদালতের স্বল্পতা ও দীর্ঘসূত্রতা, ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পাচারের মামলার বিচার কার্যক্রম অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। ওই কারণেই পাচারকারীরা আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে পাচারকারীরা মানব পাচারে সাহস পেত না। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের-সিআইডি অনুরোধে ইন্টারপোলে এই রেড নোটিস জারির সুপারিশ করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) শাখা। এনসিবি বলছে, রেড নোটিস জারি হলো এক মাসের বেশি হয়েছে। এখনও কোন তথ্য পাইনি। এমনকি মানব পাচারকারীদের অবস্থানও জানা সম্ভব হয়নি। তবে ওই ৬ পলাতকের মধ্যে কিশোরগঞ্জের তানজিদ এখন ইতালিতে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×