ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির কিছু নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করছে

প্রকাশিত: ২২:২০, ২০ ডিসেম্বর ২০২০

বিএনপির কিছু নেতা মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপির কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব দিয়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ। এ প্রসঙ্গে শনিবার দুপুরে বনানীর বাসায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দল থেকে তাকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপির কিছু নেতা দলে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করতে চাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ উদ্দিন বলেন, কারণ দর্শাও নোটিস পেয়ে হতবাক ও অপমানিত বোধ করে পদত্যাগের কথা ভেবেছিলাম। তবে নোটিসের জবাব দেয়ার পর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কি সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। তিনি বলেন, আমার বিনীত অনুরোধ আমার বক্তব্য স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করা হোক। বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাকে যদি দোষী সাব্যস্ত করা হয়, আমি যে কোন শাস্তি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আছি। আমি দলীয় নেতৃত্বের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধা পোষণ করি। দলের নেতাদের উদ্দেশে মেজর হাফিজ বলেন, দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি কেন আজকে ক্ষমতার বাইরে? কারা এর জন্য দায়ী? মুক ও বধির না হয়ে চিন্তা করেন। দলের ভালর জন্য কনট্রিবিউট করেন। কেবল তোষামোদ করে দায়িত্ব শেষ করবেন না। তিনি বলেন, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা । আমার নেতা জিয়াউর রহমান বলে গেছেন, দলের চেয়ে দেশ বড়। আমার কাছেও আমার দেশ সবচেয়ে বড়। হাফিজ উদ্দিন বলেন, একজন খেতাবপ্রাপ্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিজয়ের মাসে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অসৌজন্যমূলক ভাষায় কারণ দর্শানোর নোটিস পেয়ে হতবাক হয়েছি। একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সারাদিন মরণপণ যুদ্ধের পর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেট শহর দখল করেছিলাম। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে এই নোটিসের কথা শুনলে লজ্জা পেতেন। তিনি বলেন, আমি ২৯ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিএনপিতে আমার যোগদানের তারিখ, ভাইস চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পাবার তারিখ, আমার নামের বানানসহ অনেক ভুলই রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত কারণ দর্শাও নোটিসে দৃশ্যমান। মেজর হাফিজ বলেন, বিএনপিতে যোগদানের পূর্বেই আমি তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। ১৯৯১ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপিতে যোগদান করেছিলাম। আমি বিগত ২২ বছর ধরে দলের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছি। দলের ভাইস চেয়ারম্যানকে একজন যুগ্ম মহাসচিব এমন কঠিন, আক্রমণাত্মক ভাষায় কৈফিয়ত তলব করায় অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছি। হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, আমাকে দেয়া কারণ দর্শাও নোটিসে প্রটোকল ও সৌজন্যের ব্যত্যয় ঘটেছে। ব্যক্তি রুহুল কবির রিজভী একজন ভদ্র, নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী নেতা, তার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক রয়েছে, তার কাছ থেকে এ ধরনের নোটিস আশা করিনি। দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে বলতে চাই আমাকে কখনও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিমের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। হাফিজ বলেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে অনুষ্ঠিত সভায় যোগদানের পূর্বেই পুলিশ আমাকে ঢাকায় বিমান বন্দরে গ্রেফতার করে, এ কারণেই বরিশালে যেতে পারিনি। আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিল বর্তমান সরকার। বিএনপির কোন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে এ ধরনের মারাত্মক অভিযোগ দায়ের করার কথা আমার জানা নেই। এ মামলা ছাড়াও এক ডজন মামলায় আমি দশ বছর ধরে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিয়ে যাচ্ছি। মেজর হাফিজ বলেন, আমাকে দল থেকে যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা সঠিকভাবেই পালন করেছি। তবে কৃষক দলের কেন্দ্রীয় মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক পদের অফার অসুস্থতার জন্য গ্রহণ করতে পারিনি। আমার বর্তমান বয়স ৭৬ বছর ২ মাস, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটি কিংবা স্থায়ী কমিটিতে আমার চাইতে বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা ৪ এর অধিক হবে না বলেই আমার ধারণা। দলের জাতীয় কাউন্সিল দাবি করে হাফিজ বলেন, বিএনপির একজন নগণ্য কর্মী হিসেবে কয়েকটি সুপারিশ পেশ করতে চাই। ২০২১ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই দলের জাতীয় কাউন্সিল আহ্বান করা হোক। এই কাউন্সিলে ভোটের মাধ্যমে দলের স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি এবং সহযোগী সংগঠনের কমিটি গঠন করা হোক। বিগত দিনে দলের বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি বাণিজ্য এবং মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করা হোক। হাফিজ বলেন, বিএনপি থেকে কারণ দর্শাও নোটিস পাওয়ার পর আমার সামরিক বাহিনীর বন্ধুরা যাদের সঙ্গে চাকরি-বাকরি করেছি, তারা সবাই এবং আমার ব্যক্তিগত বন্ধুরা যারা রাজনীতি করে না, তারা সবাই বলে যে, আপনি আজকেই পদত্যাগ করেন। আমি চিন্তাও করেছিলাম। তবে আমার প্রিয় নেতাকর্মীরা আড়াইশ’ মাইল দূর থেকে নদী পার হয়ে লঞ্চে, নৌকায়, মেঘনা নদীর পার থেকে এখানে এসে অনুরোধ করেছে আপনি পদত্যাগ করবেন না, রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন না। তাদের অনুরোধে আমি পদত্যাগ করলাম না। আমি দেখতে চাই, নোটিসের জবাবে আমার দেয়া ব্যাখ্যা দলের নেতাদের কাছে সন্তোষজনক হয় কি না। হাফিজ বলেন, সম্প্রতি আমার নির্বাচনী এলাকায় ছাত্রদলের কমিটি দলের নেতারা ঢাকায় বসে গঠন করেছেন। এ কমিটির আহ্বায়ককেই আমি চিনি না। ছাত্রলীগের কর্মীরাও এ কমিটিতে স্থান পেয়েছে। আমার সুপারিশ বিবেচনা করা হয়নি। এ বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে চিঠি দিয়ে কোন উত্তর পাইনি। হাফিজ বলেন, দেশে গণতন্ত্র আসুক আমি চাই। গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধারের জন্য, জনগণের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য এ সরকারকে বিদায় করতে যে কোন সংগ্রাম করতে আমি সবসময় প্রস্তুত। যদি বিএনপির নেতাকর্মীরা বিশেষ করে ছাত্র যুবকরা রাজপথে নামে তাহলে এ দলের ভবিষ্যত অত্যন্ত উজ্জ্বল। কিন্তু তারা রাজপথে নামে না কেন? অনেক চিন্তা করেছি। বিএনপি নেতাদের উচিত এটা পর্যালোচনা করা। যে দল ক্ষমতায় গেলে শতকরা ৮০টা ভোট পায়, ক্ষমতার বাইরে আসলে রাস্তায় কেন সে দলের ১০০ লোক নামে না। হাফিজ বলেন, আমি অনেক কর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছি। তারা বলে যে, আমি যদি নামি, গুলিটা খাই, আমার পরিবারকে কে দেখবে? আমার লাভটা কী? আমি জীবন দেব, অন্যরা সুবিধা নেবে- এসব কারণে হয়ত তারা রাস্তায় নামে না। তবুও আমি বিএনপির সকল নেতাকর্মীকে আহ্বান জানাব, আগামীদিনে সরকারবিরোধী আন্দোলনের ডাক দিলে, যেই ডাক দেয়, আপনারা এসে এ সরকারকে উৎখাত করবেন। উল্লেখ্য, ১৪ ডিসেম্বর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত একটি কারণ দর্শাও নোটিস দেয়া হয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদকে। নোটিসে জবাব দেয়ার জন্য ৫ দিন সময় দেয়া হয় তাকে। ৫ দিনের মধ্যেই জবাব দেন তিনি। নোটিসের জবাব দেয়ার পর নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের তোষামোদ ছেড়ে মুখ খোলার আহ্বান জানান।
×