ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মাদকের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মামুনকে জবাই করে বন্ধুরা

প্রকাশিত: ২২:০৫, ৫ ডিসেম্বর ২০২০

মাদকের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে মামুনকে জবাই করে বন্ধুরা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ইয়াবার টাকার ভাগবাটোয়ারার সূত্রধরে মাদকসেবী সহপাঠী বন্ধুদের হাতেই নির্মমভাবে খুন হয় ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা করা মেধাবী ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মামুন। হত্যাকারীরা সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মেধাবী ছাত্র। হত্যার পর নেশার ঘোরে পৈশাচিক খেলায় মেতে ওঠে মাদকসেবী বন্ধুরা। মাদকের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে মামুনকে অচেতন করে। এরপর সবাই মিলে আনন্দ করতে করতে মামুনকে জবাই করে। জবাই করার পর মাথা কেটে হাতে নিয়ে চলে যায়। আর লাশ ফেলে দেয় রাস্তার ধারের ঝোপে। অনেক দূরে নির্জন জায়গায় গিয়ে সেই মাথা দিয়ে খানিকটা ফুটবল খেলে। এরপর তা ফুটবলের মতো লাথি মেরে ফেলে দেয় ঝোপের ভেতরে। অজ্ঞাত লাশ হিসেবে মামুনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর আলোচিত সেই হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। গ্রেফতার হয়ে খুনী আদালতে মামুন হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। পুরো হত্যাকাণ্ডটিই ঘটেছে শুধুমাত্র মরণনেশা ইয়াবার জন্য। খুনী ইতোমধ্যেই আদালতে হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে। খুনের বর্ণনা শুনলে গা শিউরে ওঠে। এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, দিন দিন মাদকের বিস্তার ঘটছে। বিশেষ করে ইয়াবা। দেশের প্রায় সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ছোবল দিচ্ছে। এরসঙ্গে এক শ্রেণীর ছাত্ররা জড়িত। এখনই মাদকের রাশ টেনে ধরতে না পারলে, ভবিষ্যতে মাদকের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকাসক্ত শিক্ষার্থীদের আরও খুনের ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়া মাদকেরই বলি হয়েছে মেধাবী ছাত্র মামুন। মাদকাসক্ত বন্ধুদের সঙ্গে থেকে সেও মাদকাসক্ত হয়। শেষ পর্যন্ত তাদের মাদকাসক্ত বন্ধুরা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। সেই মাদক আর মাদক বিক্রির সামান্য টাকার জন্য মামুনকে তারই মাদকাসক্ত বন্ধুরা নির্মমভাবে খুন করে। খুনের পর মামুনের মাথা কেটে নিয়ে যায়। পরে অনেক দূরে সেই মাথা ফেলে দেয়। পুরো ঘটনাটিই ঘটেছে মাদকের নেশার ঘোরে। তিনি জানান, ঘটনাটি ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ। ওইদিন বেলা এগারোটার দিকে গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাইপাশ সড়কের পাশ থেকে মাথাবিহীন এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অনেক দূরে ওই ব্যক্তির মাথা পাওয়া যায়। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর তার মাথা কেটে নিয়ে যায়। এরপর সেটি অনেক দূরে নির্জন জায়গায় ফেলে দেয়। পুবাইল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ এস আই মোঃ রফিকুল ইসলাম-৩ লাশের সুরতহালসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ করেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি থানা পুলিশ তদন্ত করে। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর হত্যকারীদের পাওয়া যায় নাই মর্মে আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয় পুলিশ। আদালত মামলাটি স্বপ্রণোদিত হয়ে পিবিআইকে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়। পিবিআইয়ের গাজীপুর জেলার বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, পরবর্তীতে ওই লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়। প্রয়োজনীয় ডিএনএ আলামত সংগ্রহ করে আবার কবর দেয়া হয়। পরিচয় মোতাবেক খুন হওয়া যুবকের নাম আব্দুল্লাহ আল মামুন (২৫)। পিতার নাম মোঃ জামাল উদ্দিন। বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন সফিপুর গ্রামে। সে জয়দেবপুরের সাহাপাড়ার জি/৩৮ নম্বর মিজানুর রহমান খানের বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিল। দীর্ঘ গোয়েন্দা অনুসন্ধানের পর মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুর জেলা পিবিআইয়ের পরিদর্শক কাজী মোঃ রফিক আহমেদ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত মামুনের বন্ধু সৈয়দ নাকিব ইকবাল ওরফে নিলয়কে (২১) গ্রেফতার করে। দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর চলতি বছরের ১৮ নবেম্বর গ্রেফতারকৃত নিলয়কে শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। জিজ্ঞাসাবাদের নিলয় জানায়, তার পিতার নাম সৈয়দ জাকির হোসেন। বাড়ি টাঙ্গাইল সদর জেলার গাড়িন্দা এলাকার উত্তর তারাটিয়া গ্রামে। পরে নিলয় চলতি বছরের ১৯ নবেম্বর গাজীপুরের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ হামিদুল ইসলামের আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দেয়। জবানবন্দীতে নিলয় বলে, সে এমআইএসটি নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র ছিল। নিহত মামুন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। মামুনের মাধ্যমে শুভ, মেরাজ, শাওন ও নজরুল নামের বন্ধুদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তারা এটিআই নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ত। বন্ধুদের মধ্যে নজরুলের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়া থানা এলাকায়। নজরুল পড়াশোনার পাশাপাশি কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে বিক্রি করত। মামুন ইয়াবা বিক্রির টাকার একটি অংশ আত্মসাত করে। এ নিয়ে নজরুলের সঙ্গে মামুনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়। মামুন প্রেম করত ছন্দা নামের এক মেয়ের সঙ্গে। ছন্দাকে আবার শুভ নামের আরেক ছেলেও পছন্দ করত। এ নিয়ে মামুনের সঙ্গে শুভর দ্বন্দ্ব ছিল। এই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় নজরুল। মামুনকে মারার জন্য নজরুল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। ঘটনার দিন ২০১৮ সালের ১২ মার্চ মামুন, শুভ, মেরাজ ও শাওনের সঙ্গে আমি দেখা করি। বিকেল চারটার দিকে গাজীপুরের শিমুলতলী গিয়ে ছন্দার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ছন্দা আসার পর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে জয়দেবপুরের উদ্দেশে বাসে উঠি। বাসে শুভ অনেক আজে বাজে কথা বলে ছন্দাকে। এ নিয়ে মামুনের সঙ্গে শুভর ঝগড়া হয়। ছন্দা রাগ করে বাস থেকে নেমে যায়। এরপর আমরা বাসের মধ্যে মামুনকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করি। বাস থেকে নেমে আমরা অটোরিক্সা করে দক্ষিণখান এলাকার নির্জন জায়গায় গোল হয়ে বসি। সেখানে আমরা গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদক সেবন করি। শুভ মদের সঙ্গে মামুনকে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। মামুন অচেতন হয়ে পড়ে। শুভ মোবাইলে ছবি তুলে মেসেঞ্জারে ছন্দার কাছে মামুনের ওই অবস্থার ছবি পাঠায়। রাত দশটার দিকে আমি মামুনের দুই পা চেপে ধরি। শাওন ও মেরাজ দুই হাত ধরে রাখে মামুনের। এ সময় শুভ ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরি বের করে মামুনকে জবাই করে। জবাই করার পর মাথা আলাদা করে ফেলে। পরে সেই মাথা ও ছুরিটি দূরে ফেলে দেয়। শুভ, মেরাজ, শাওন রক্তমাখা জামাকাপড় ব্যাগে ভরে রাখে। রাত এগারোটার দিকে অটোরিক্সা করে জয়দেবপুর রেলস্টেশনে যাই। সবাই যে যার যার মতো চলে যাই। পরে বিকাশের মাধ্যমে নজরুল আমাকে দশ হাজার টাকা পাঠায়। সেই টাকা তুলে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক সেবন করে খুনী নিলয় আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বলে জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তবে পুলিশের কারণে সে আনন্দ আর বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।
×