ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপি-জামায়াত জোট হেফাজত নেতাদের মন্ত্রী বানাতে চেয়েছিল!

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ৪ ডিসেম্বর ২০২০

বিএনপি-জামায়াত জোট হেফাজত নেতাদের মন্ত্রী বানাতে চেয়েছিল!

শংকর কুমার দে ॥ সাড়ে সাত বছর আগে মতিঝিলে শাপলা চত্বরে সহিংস সন্ত্রাসের ঘটনায় দেয়া জবানবন্দীতে কি বলেছিলেন হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান আমীর জুনায়েদ বাবুনগরী? নিজের দোষ ও দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলেন তিনি। জবানবন্দীতে তিনি বলেছিলেন, সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান করার পরিকল্পনা ছিল হেফাজতের। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ ও অর্থ সহায়াতা দিয়েছিলেন বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সে সময়ের ১৮ দলীয় জোট (বর্তমান ২০ দলীয় জোট) ক্ষমতায় গেলে বাবুনগরী ও হেফাজত নেতাদের মন্ত্রী বানানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন বলে জবানবন্দীতে বলেছেন বাবুনগরী। ডিবি পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, বাবুনগরীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত ৩১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিল ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিমের আদালত। রিমান্ডের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন বাবুনগরী। ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধের দিন সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় হেফাজতে ইসলামের তখনকার মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন আদালতে। তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক ফজলুল হক তাকে দু’দফায় ১৩ দিনের রিমান্ড শেষে ঢাকার সিএমএম আদালতে এনে স্বীকারোক্তি রেকর্ড করার আবেদন করেন। এ সময় বাবুনগরী ছিলেন খুবই অসুস্থ। আদালতের কাঠগড়ায় তাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। রিমান্ড শেষ না হতেই তাকে নাটকীয়ভাবে আদালতে হাজির করা হলে জবানবন্দী দিতে সম্মত হন বাবুনগরী। তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় বাবুনগরীর জবানবন্দী রেকর্ড করে তাকে জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট হারুন অর রশিদ। ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, একই দিন সকালে বাবুনগরী রিমান্ডে থাকা অবস্থায় শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার পক্ষে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে চিকিৎসার আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার সাদাত। বাবুনগরীর আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া আদালতে বারডেম অথবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসপাতালে জীবন রক্ষার্থে জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসার জন্য আবেদন করেছিলেন। জবানবন্দী প্রদানের আগে বাবুনগরীকে চিন্তা ভাবনা করার জন্য ৩ ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছিল। আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে বাবুনগরী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে জড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন বাবুনগরী। ১৩ দফা দাবি আদায়ের জন্য হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা গত ৫ মে অবরোধ শেষে মতিঝিলে অবস্থান নিতে থাকেন। ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচীর দিনে মতিঝিল ইত্তেফাক মোড় থেকে দৈনিক বাংলার মোড় ও ফকিরাপুল এলাকায় জঙ্গী কায়দায় বাঁশের লাঠি, কাঠের লাঠি, লোহার রড ও দেশীয় অস্ত্র, আগ্নেয়াস্ত্রসহ ইট ও বোমা নিক্ষেপ করে যান চলাচলে বাধা ও বোমা ফাটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। বিভিন্ন ভবন ও গাড়ি ভাংচুর এবং ভবন, গাড়িতে ও ফুটপাথের বিভিন্ন দোকানে অগ্নিসংযোগ করে। এক পর্যায়ে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়। তাদের মাইকে চলে যেতে বলা হলেও বারবার তারা পুলিশের বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে। ওইদিন রাত আড়াইটার সময় তাদের ওই স্থান থেকে উচ্ছেদের জন্য পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে আসামিরা পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ওই সময়ে পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসবি) মোঃ শাহজাহানের মাথায় ইট, লোহার রড, চাপাতি দিয়ে আঘাত করে ও মৃত্যু নিশ্চিত করে হেফাজতে ইসলামীর আসামিরা। এসআই শাহজাহানের নামে ইস্যুকৃত পিস্তল ও গুলি নিয়ে যায় তারা। এ সময় সাংবাদিকদের অনেকেই আহত হন। এসআই শাহাজাহানকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ওই সময়ে আরও অন্তত ৭ জন মারা যায় বলে পুলিশ জানায়। এই ঘটনার পরদিন ২০১৩ সালের ৬ মে রাত ৮টার দিকে লালবাগ এলাকা থেকে হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ গ্রেফতার করে। এরপর থেকে তিনি রিমান্ডে আছেন। পৃথক তিনটি মামলায় আদালত তার ৩১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন। মাত্র ১৩ দিনের রিমান্ডের মাথায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়ার পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয় জুনায়েদ বাবুনগরীকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজাতে ইসলামের মহাসচিব থেকে আমির পদে অধিষ্ঠিত হয়ে এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মূর্তি অভিহিত করে টেনে হিঁচড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে নামিয়ে ফেলার হুমকি ও হুঙ্কার দিয়েছেন। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার হুমকি ও হুঙ্কার দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপচেষ্টা করা হলে আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবার চট্টগ্রামে এক মাহফিলে বলেন, ‘যারা ভাস্কর্য তৈরি করবে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়া হবে। আমার বাবার নামেও যদি কেউ ভাস্কর্য তৈরি করে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেব। জুনায়েদ বাবুনগরী ছাড়াও হেফাজতে ইসলামের নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও মাওলানা মামুনুল হক ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে খেলাফত যুব মজলিস ঢাকা মহানগরীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সস্তান হতে পারে না। চরমোনাই’র পীর ও ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম শুক্রবার ভাস্কর্য নির্মাণের স্থল ঢাকার ধোলাইপাড় এলাকায় এক সমাবেশে বলেছেন, ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের চক্রান্ত তৌহিদি জনতা রুখে দেবে। রাষ্ট্রের টাকা খরচ করে মূর্তি স্থাপনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে সরকারকে ফিরে আসতে হবে। সরকার যদি ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন থেকে সরে না আসে, তাহলে কঠোর কর্মসূচী দিতে বাধ্য হব।
×