ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দেশের আটষট্টি কারাগারে মঞ্চনাটক

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ১৯ নভেম্বর ২০২০

দেশের আটষট্টি কারাগারে মঞ্চনাটক

নাটক তাঁর জ্ঞান, নাটক তাঁর ধ্যান। অধ্যাপক ড. ইস্রাফিল শাহীন উপমহাদেশের বিখ্যাত থিয়েটার ইনস্টিটিউট ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এন এস ডি) থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর কলকাতা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পথ নাটকের ওপর পিএইচ ডি ডিগ্রী লাভ করেন। নাট্য গবেষনার প্রাণপুরূষ এ মানুষটি সবসময়ই চেষ্ঠা করেন নাটককে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে। ইতোমধ্যে তাঁর নির্দেশিত অনেক নাটক দেশ বিদেশের বহু আন্তর্জাতিক ফেস্টিভলে স্থান পেয়েছে। এছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার ওয়ার্কশপ করানোর জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। দেশে নাট্য আঙ্গিনায় অবদানের জন্য পেয়েছেন মুনীর চৌধুরী সম্মাননা। প্রতিভাবান নাট্যব্যক্তিত্ব ইস্রাফিল শাহীন তাঁর গবেষনা কর্মের ধারাবাহিকতায় শুরু করছেন কারাগারে নাটক নির্মান ও প্রদর্শনী। কোন ব্যক্তি অন্যায় কাজ করলে তার দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে তাকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এ শাস্তি মূলত সে যেন তার অপরাধ বুঝতে পারে এবং নিজেকে শোধরাতে পারে। যদিও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারাদণ্ডের অনেক নজির রয়েছে। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এত লম্বা কারাভোগের পুরোটাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে সাধারণভাবে কারাদণ্ড মানেই কয়েদির আত্মশুদ্ধি লাভ। কারাগারে কয়েদির আত্মশুদ্ধির জন্য নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে থিয়েটার একটি অনুষঙ্গ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কারাগারের অভ্যন্তরে থিয়েটার প্রদর্শনী ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং আত্মশুদ্ধির ব্যপারে যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ১৯৫৭ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর সান কোয়েন্টিন কারাগারে থিয়েটার ওয়ার্কশপ হিসেবে স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ প্রদর্শিত হয়েছিল। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে ব্রিটেনে শুধু কারাগারে থিয়েটার ওয়ার্কশপ করার উদ্দেশ্যে ঝঃরৎধনড়ঁঃ ঃযবধঃৎব নামে পেশাদারি থিয়েটার কোম্পানি গড়ে উঠেছিল। আবার রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে ২১ ফেব্রুয়ারিকে উদ্দেশ্য করে ১৯৫৩ সালে কারাবন্দী থাকা অবস্থায় মুনীর চৌধুরী রচনা করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক ‘কবর’ যা জেলখানায় কয়েদিদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে কারাগারে মঞ্চস্থ করেন। থিয়েটার শিল্পের একটি অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। এর যথাযথ উপস্থাপনা মানুষকে খুব দ্রুত পরিবর্তন করতে পারে। থিয়েটারের ইতিহাস ঘাঁটলে এর প্রমাণ পওয়া যায়। যেমন ব্রাজিলের বিখ্যাত থিয়েটার অনুশীলনকারী ‘অগাস্তো বোয়াল’-এর ‘থিয়েটার অব দ্য অপ্রেস্ড’ অন্যতম। এ অনুশীলনে দর্শকের সঙ্গে কুশীলবদের সরাসরি সংলাপ হয় এবং নাটকের বিষয়বস্তু নির্মাণ করা হয় ওই আঞ্চলিক সমস্যা নিয়ে যা নাটক শেষে সমাধানের পথ বাতলে দেয়। নাটক মূলত সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের আনন্দ বিনোদনের জন্য। শিকারযুগে মানুষ যখন শিকার শেষে তা আগুনে পুড়িয়ে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতো তখন তারা সোমরস পান করে বিভিন্ন বাদ্য বাজনা বাজিয়ে নৃত্যগীত করত। রাহুল সাংকৃত্যায়নের ‘ভোল্গা থেকে গঙ্গা’ বইতে ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ ধরনের রীতির উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া গ্রীক থিয়েটারের ইতিহাস সকলেরই জানা। সেই প্রাচীন থিয়েটার গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক হতে হতে আজ বহুমাত্রিকতা লাভ করেছে। আমাদের দেশেও থিয়েটার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থিয়েটার বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার পর থেকে এর বিস্তৃতি আরও ব্যাপক হয়েছে। এবার বাংলাদেশে এই প্রথম কারানাট্য নিয়ে গবেষণা কাজ শুরু করছেন অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীন। কারানাট্য (চৎরংড়হ ঞযবধঃৎব) প্রায়োগিক নাট্যচর্চার একটি বিশেষ ক্ষেত্র। রাষ্ট্রের কারানীতির অধীনে কারাগারের ভেতরে কারাবন্দীদের দিয়ে নাট্যচর্চার এই প্রক্রিয়া কারাবন্দীদের মনস্তত্ত্বে ইতিবাচক উন্নয়ন ও আত্ম-সংশোধনের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে। সঙ্গীত পরিবেশন, নাটক মঞ্চায়ন, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য, গল্প বলা, খেলাধুলা ইত্যাদি পরিবেশনা বন্দীদের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং কারামুক্তির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। কারাগারের বদ্ধ পরিবেশে দলগতভাবে নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একজন অপরাধীর মানবিক গুণাবলীসমূহ বিকশিত হবে এবং আত্ম-প্রতিফলন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কারাবন্দী ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবে যে, সে কী ভুল করেছে এবং কিভাবে নিজেকে শোধরাতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় কারাগারে যাপন করেছেন। তিনি কারাযাপনের অভিজ্ঞতার কথা সুনিপুণভাবে আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশে কারানাট্য চর্চায় অন্যতম অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে জাতির জনকের কারাবাসে অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ গ্রন্থ যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থ থেকে বিভিন্ন দৃশ্য কারাবন্দীদের মধ্যে পরিবেশন করা হবে। কারানাট্য চর্চার নন্দনতাত্ত্বিক রূপরেখা তৈরি ও বিকাশে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও উন্নয়নের ধারায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীনের সরাসরি তত্ত্বাবধান ও কারাবন্দীদের মনস্তত্ত্বে ইতিবাচক উন্নয়ন এবং আত্মশোধন প্রণালীরূপে কারানাট্য এবং কারাগারে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। একই বিভাগের এমফিল প্রোগ্রামে শিক্ষার্থী রাগীব নাঈম, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম সবুজ এবং পিএইচডি প্রোগ্রামের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আহসান খান এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করছেন। এ ছাড়া নির্বাচিত নাট্য কর্মী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন। তিন বছর মেয়াদী এই গবেষণাধর্মী কাজটির জন্য ইতোমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং কারা অধিদফতর অনুমতি প্রদান করেছে। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর জেলহত্যা দিবস। এই দিনে জাতীয় চারজন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি কারাগারের অভ্যন্তরে কারাবন্দীদের দ্বারা অভিনীত এবং পরিবেশন করা হবে। এ বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন অথবা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা প্রকল্প ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজিত হতে যাচ্ছে। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান। এ মাসের শেষ সপ্তাহে এই প্রকল্পের কাজ বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে শুরু হবে। আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশের ৬৮টি কারাগারের অভ্যন্তরে কারাবন্দীদের অংশগ্রহণে মুনির চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এর ব্যবহারিক যাত্র শুরু হবে।
×