ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহামারি পরিত্রাণে মন্ডপে মন্ডপে বিশেষ প্রার্থণা

প্রকাশিত: ১৮:৩৮, ২৩ অক্টোবর ২০২০

মহামারি পরিত্রাণে মন্ডপে মন্ডপে বিশেষ প্রার্থণা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এমনিতেই করোনার চোখ রাঙানির কারণে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে এবারের দুর্গোৎসব। এরসঙ্গে যোগ হয়েছে বাদলা হাওয়া। নি¤œচাপ দুর্বল হওয়ায় সমুদ্রবন্দরে চার নম্বর সংকেত নামিয়ে তিন নম্বর করা হলেও আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া শুকনো থাকবে এমন সুখবর নেই। অর্থাত মেঘলা আবহাওয়ার কারণে হতে পারে বৃষ্টিপাত। ছুটির দিন শুক্রবার ছিল মহাসপ্তমী। পূজোর আয়োজন সবই আছে। ম-পে ম-পে ভক্তদের তেমন একটা ঢল নেই। নেই উৎসবের খুব একটা ধুমধাম। আজেম। তিন ফুট দূরত্বে বসার জায়গা করা হয়েছে ম-পগুলোতে। সংক্রমণ ব্যাধি করোনার কারণে ভক্তদের একটি বড় অংশ ঘর থেকেই দেবী দূর্গাকে প্রণাম জানিয়েছেন। ডিজিটাল পদ্ধতিতে বাসা থেকে অঞ্জলি দিয়েছেন কেউ কেউ। ম-পে ম-পে বিশেষ প্রার্থনা করেছেন ঘাতক এই ব্যাধি থেকে দেশ তথা বিশ^বাসীর মুক্তির। পাঁচদিনব্যাপী শুরু হওয়া সনাতন সম্প্রদায়ের প্রধান এই ধর্মীয় উৎসবের তৃতীয় দিন আজ শনিবার। কল্পারম্ব ও সন্ধিপূজোয় শেষ হবে সার্বজনীন উৎসবের মহাষ্টমী। করোনার কারণে মহাঅষ্টমীর মূল আকর্ষণ কূমারী পুজা এবার হচ্ছে না। লোক সমাগম এড়াতে আগে ভাগেই এই আনুষ্ঠানিকতা বাতিল করা হয়েছে। প্রতি বছর দেবী রুপে একজন কন্যা শিশুকে অষ্টমীতে পুজা করা হতো। রামকৃষ্ণ মিশন সহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি মন্দিরে মহা ধুমধামে কুমারী পুজায় নামতো ভক্তদের ঢল। যা ছিল উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। দেবী দুর্গার আগমন আর গমনের পৃথক পৃথক যানবাহনের উল্লেখ রয়েছে শাস্ত্রে। পৃথক এই যানবাহনের সঙ্গে ফলাফলেরও উল্লেখ থাকে। দেবী কোন যানে কৈলাস থেকে মর্ত্যধামে আসছেন, আর কোন যানবাহনে করে মর্ত্য থেকে কৈলাসে ফিরে যাচ্ছেন, তার উপর নির্ভর করে মর্ত্যবাসীর জীবন কেমন হবে। এবছর দেবীর আগমন হয়েছে দোলা অর্থাৎ, পালকিতে। পঞ্জিকা অনুযায়ী, দোলায় আগমনের ফল ‘মড়ক’। অর্থাৎ, মহামারি। ইতিমধ্যে অদৃশ্য শত্রু করোনার ভয়াল থাবার বিধ্বস্ত সারা বিশ্ব। সংক্রমণের চোখরাঙানি এড়িয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার উৎসব পালিত হচ্ছে। কিন্তু পঞ্জিকা অনুযায়ী, দেবীর আগমনের ফল হিসেবে ‘মড়ক’, মহামারি ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি দেখা দেবে! যা চলমান। শুধু করোনা নয়, পাঁচদফা বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী বন্যা হয়েছে এবার। পঞ্জিকা মতে এবার দেবীর গমন হবে গজে। গজে গমনের ফল হল ‘শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা’। অর্থাৎ, দেবী মর্ত্যধাম ছেড়ে কৈলাস যাওয়ার পর শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে পৃথিবী। তাই দেবীর গজে আগমন বা গমনকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ বন্যার মধ্যেও অনেক এলাকার ফসল ভালো হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকলে শীলকালীন শস্য হয়ত ভালো হবে। বাড়বে উৎপাদন। দুর্যোগ কাঁটিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। করোনার কারণে ম-পে ভক্তদের উপস্থিতি কম হলেও হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় সব ধর্মের মানুষ। একে অন্যকে পূজোর শুভেচ্ছা জানানো, বাসায় আসার আমন্ত্রণ, নাড়– খাওয়ানোর আবদার সহ সামাজিকতার সবকিছুই এখন ফেসবুকের পাতায় পাতায়। আবার উৎসব মানেই নতুন পোশাক পরিচ্ছদ। যারা পছন্দের পোশাকটুকু কষ্ট করে কিনেছেন; একটা সেলফি না দিলে কি হয়। না। হয় না। তাই নতুন সাজ আর পোশাকের সেলফি চলছে তো চলছে। কেউ একা একা দিচ্ছেন। অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে। আবার শহর ছেড়ে পূজোর ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার স্ট্যাটাসও দিচ্ছেন অনেকে। এতে সাড়া দিচ্ছেন বন্ধু ও স্বজন। উৎসবকে কেন্দ্র করে সবার মধ্যে ছোট বড় মিলনমেলা ঠেকানো? যাবেনা। দুর্গাম-পে মুখে মাস্ক পরা নারীদের একটি ছবি শেয়ার করে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ‘সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা’ জানান। শুভেচ্ছার সঙ্গে ছবিতে তিনি যে স্বাস্থ্যসচেতনতার বার্তাটিও দিলেন তা সহজেই অনুমেয়। ইনস্টাগ্রামে মহাষষ্ঠীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা মীম। ষষ্ঠীর দিনে পরিবারের সঙ্গে পূজা দেখতে বেরিয়েছিলেন অভিনেত্রী স্পর্শিয়া। দুর্গাম-পের সামনে পরিবারের সঙ্গে তোলা একাধিক ছবি ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করেছেন তিনি। বর সৃজিত মুখার্জির সঙ্গে ষষ্ঠীর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন মিথিলাও। এবার পূজা উপলক্ষে বাংলাদেশ থেকেই উল্লেযোগ্য সংখ্যক পূজার গান প্রকাশ পেয়েছে। গান গেয়েছেন সন্দীপন দাস, সমরজিৎ রায়, অবন্তী দেব সিঁথি, সিথি সাহা, কিশোর দাস, পুলক অধিকারী, মুক্তা মজুমদার, হৈমন্তী রক্ষিত দাস, অলক কুমার, চম্পা বণিক, দেবলীনা সুর, অপূর্ব অপু, মন্টি সিনহা, কে ডি উজ্জ্বল, মারলিন, অনন্যা আচার্য্যসহ অনেকেই। করোনার নানা বিধিনিষেধের মধ্যে ঢাকার ম-পগুলোর চিত্র আসলে কেমন ছিল। রাজধানী শহরের শারদীয় দূর্গোৎসবের মূল কেন্দ্রের একটি ঢাকেশ^রী মন্দিরে মহানগর পূজো ম-প। সকাল থেকে ভক্তদের ভীড় শুরু হয় এখানে। মাখে অনেকের মাস্ক। হাতে হাতে ভোগ, নৈবর্ত্য, ফুল আর বেলপাতা সাজিয়ে নিয়ে আসেন অনেকে। যে যার সাধ্যমত দেবী দূর্গাকে ভোগ দিয়ে সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেছেন। অঞ্জলিতে অংশ নিয়েছেন অনেক ভক্ত। আয়োজকরা জানিয়েছেন, অন্যবারের তুলনায় এবার ম-পে উপস্থিতি যেমন কমেছে তেমনি প্রাঙ্গণজুড়ে নেই উৎসবের আমেজ। বৃষ্টির কারণে আশপাশের রাস্তায় রকমারী পণ্যের পসরাও খুব একটা নেই। যে কটা আছে সেখানেও ক্রেতা সংকট। ঢাকে কাঠির বাদ্য ভক্তদের মন ম-পে টানলেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে আসতে পারছেন না। আরতিতেও নেই আগের মতো ভীড়। বাতিল করা হয়েছে সব ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একই চিত্র দেখা গেছে বেশিরভাগ ম-পে। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ি রাত নয়টার মধ্যে ম-প বন্ধের নির্দেশ থাকলেও সন্ধ্যার পর অনেক পূজো ম-পে শুনশান নীরবতা দেখা গেছে। খিলক্ষেত এলাকায় লেকসিটি কনকর্ডের পূজো ম-পে বিকালের পর থেকে ভক্তদের দেখা যায়নি। একই চিত্র কমলাপুর স্কুল, বাসাবো বালুর মাঠ, রাজারবাগ কালীবাড়ি, রমনা কালীবাড়ি সহ পূরনো ঢাকার ম-প গুলোতেও। ঢাকেশ^রী মন্দিরে অঞ্জলি শেষে বিশ্বের শান্তি এবং মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা করেন পুরোহিত রঞ্জিত চক্রবর্তী। এ সময় তার সঙ্গে অংশ নেন ভক্তরাও। পুরোহিত বলেন, আমরা যেন একটি সুন্দর প্রভাতে আবার সবাই একত্রিত হতে পারি, আমরা যেন আবার সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারি। আজ মাতৃম-পে মহাসপ্তমী পূজা। যেহেতু এবার মা দোলে চড়ে এসেছেন ফলে কিঞ্চিৎ পরিমাণে অশুভের আশংকা রয়েছে। তবে আমরা মায়ের চরণে বহু ধরনের ভেষজ দ্রব্য অর্পণ করে প্রার্থনা করেছি, যুগে যুগে যেভাবে অশুভ শক্তির বিনাশ করেছে, এবারও সেভাবে অশুভ শক্তির বিনাশ করে সবাইকে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ দিও। তিনি বলেন, যেহেতু মা এবার গজে চড়ে যাবেন, সেহেতু একদিক থেকে যেমন দুঃখ দিয়েছেন, ফলে যাবার সময় সবকিছু সুজলা সুফলাভাবে ভরে দেবেন। মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট কিশোর রঞ্জন মন্ডল বলেন, মায়ের চরণে অঞ্জলি দেয়া, মাকে হৃদয়ে ধারণ করা, এর যে অনুভূতি তা কখনোই আসলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এটা সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের এবং সুখানুভূতির। তিনি বলেন, এবার পূজা ম-পে সে ধরনের কোনো উৎসবের আয়োজন নেই। সকলেই সাত্ত্বিকভাবে পূজা পালন করছেন। এখানে যারা এসেছেন সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। আমরা আশা করছি আগামী কয়েকদিনও এভাবেই চলবে। তিনি জানান, সকালে প্রথম অঞ্জলি প্রদানের পর ধীরে ধীরে আরও বেশ কয়েকটি অঞ্জলি প্রদান করা হয়। এরপর দুপুর ১২টা ১ মিনিটে মহামারি করোনা থেকে রক্ষা পেতে ম-পে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ প্রার্থনা। পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা জানান, সন্ধ্যার মধ্যেই আরতি সম্পন্ন করে দর্শনার্থীদের মন্দিরে আসতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। রাত নয়টার পর মন্দির বন্ধ করে দেয়া হবে। আর কোনো দর্শনার্থীদের মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। এর পাশাপাশি ভক্তরা যেন তাঁদের বাড়ি থেকে অঞ্জলি দিতে পারেন, সে জন্য অনেক মন্দিরের তরফ থেকে ডিজিটাল ব্যবস্থা করা হবে। মন্দিরে নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা প্রবেশের ব্যবস্থা রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে, মাস্ক ব্যবহার করে ভক্তদের অঞ্জলিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে তারা বলেন, বিজয়া দশমী হবে ২৬ অক্টোবর, তবে এবার বিজয়ার শোভাযাত্রা হবে না। মন্দিরগুলো তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় প্রতিমা বিসর্জনের ব্যবস্থা করবে। নেতারা জানান, এবার সারা দেশে মোট ৩০ হাজার ২৩১টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর পূজা হয়েছিল ৩১ হাজার ৩৯১টি। এবার ১ হাজার ১৮৫টি পূজা কম হচ্ছে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে পূজার সংখ্যা কমেছে বলে তাঁরা মনে করেন।তারা জানান, স্বাস্থ্যবিধি মানার তাগিদ থেকেই মূলত এবার ঢাকায় কুমারীপূজা হবে না। তবে সপ্তমী তিথিতে দুপুর ১২টা ১ মিনিটে সব মন্দিরে কোভিড পরিস্থিতি থেকে মুক্তি এবং সবার আরোগ্য কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া মহামারি থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য মন্দিরে মন্দিরে প্রার্থনা করা হবে।
×