ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিয়ার স্বামীর সন্ধানে সিআইডি

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২২ অক্টোবর ২০২০

সাদিয়ার স্বামীর সন্ধানে সিআইডি

আজাদ সুলায়মান ॥ পাত্র চেয়ে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত সাদিয়া জান্নাতের স্বামী এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত একমাসেও তার স্বামী মোহাম্মদ এনামুল হাসান ওরফে জিহাদকে গ্রেফতারের করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। এদিকে সাদিয়ার প্রতারণার শিকার বেশ ক’জন যুবক তাদের পাওনা টাকা আদায় করতে পারছে না। জানা গেছে, বিয়ের পর বিদেশে নিয়ে যাবার আশ্বাসে প্রতারণার ওই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বাকি সদস্যদেরও চিহ্নিত করেছে সিআইডি। বিদেশে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রলোভনে বেকার যুবকরা ভালমন্দ কিছুই যাচাই না করেই প্রতারিত হয়েছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরাও এহেন প্রতারণায় সর্বস্ব খুইয়েছে। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর সিআইডি এই প্রতারক চক্রের হোতা সাদিয়াকে গ্রেফতার করে। যার কাজই ছিল অত্যন্ত সূকৌশলে বেকার যুবকদের বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা করা। সাদিয়া জান্নাতুল ফেরদৌসের (৩৮) ফ্যাশন আর ভাব ভঙ্গিমা দেখলে মনে হবে-একেবারে কানাডার ইমিগ্রেন্ট ও সুশিক্ষিত এক নারী। গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা, মাথায় সোনালি চুল। পোশাকেও কেতাদূরস্ত। নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক। সঠিকভাবে বাংলা বলতেও কষ্ট হয়। সেজন্য একজন ট্রান্সলেটরও রাখেন সঙ্গে। অথচ তিনি লেখাপড়া জানেন না। সিআইডি জানিয়েছে, জান্নাতুল ফেরদৌসের প্রতারণার ফাঁদে এমন কিছু যুবক ধরা খেয়েছেন যারা তার চেয়েও ট্যালেন্ট। স্টাইলিশ ফ্রড বলতে যা বোঝায় তিনি তাই। তার টার্গেট শুধু বেকার নয়- প্রতিষ্ঠিতরাও। যারা বিকৃত রুচির কারণেও তার মতো নারীর সংস্পর্শ চান। এ পর্যন্ত তিনি শতাধিক পাত্রের সঙ্গে দেখা করেছেন। সবই রাজধানীর বিভিন্ন নামীদামী রেস্টুরেন্টে। প্রথম দেখাতেই তার অফার-যাবার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা তৈরি এবং কানাডায় থাকা তার সম্পূর্ণ ব্যবসার অর্থ দেশে ফেরত আনার সবই তিনি বহন করবেন। জান্নাতের সহযোগীরাও তারই মতো। বেশ ক’জন সহযোগী রাজধানীতে সক্রিয়। গত এক যুগে শতাধিক ব্যক্তির সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে ৩০ কোটিরও বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক সাদিয়া। তার রয়েছে রাজধানীসহ অন্যান্য এলাকায় অন্তত ২০ কোটি টাকার সম্পদ। সাদিয়ার প্রতারণামূলক সব কাজে সহায়তা করতেন তার দ্বিতীয় স্বামী মুহাম্মদ এনামুল হাসান ওরফে জিহাদ। এছাড়াও চক্রের আরও এক নারীসহ চার ব্যক্তি জড়িত রয়েছে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে গুলশানে অভিযান চালিয়ে এ চক্রের মূলহোতা সাদিয়া জান্নাত ওরফে জান্নাতুল ফেরদৌসকে গ্রেফতারের পর প্রতারিত হওয়া অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের কার্যালয়ে যোগাযোগ করেন। এরপর গত ৯ অক্টোবর রাতে এক অভিযানে চক্রের অপর সদস্য মোঃ ফিরোজকে গ্রেফতার করা হয়। সে এ চক্রের মূলহোতা সাদিয়ার গাড়িচালক ছিলেন। এছাড়াও ফিরোজ চক্রের অফিস ম্যানেজমেন্ট, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তবে এ চক্রের অন্যতম সদস্য সাদিয়ার স্বামী এনামুল হাসান ওরফে জিহাদ এখনও পলাতক। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের মূলহোতা সাদিয়া ও তার গাড়িচালক ফিরোজ জানান, সাদিয়া কুমিল্লার দেবিদ্বার গ্রামের এবং জিহাদ বরিশালের মুলাদীর বাহাদুরপুর গ্রামের বাসিন্দা। সাদিয়া ও এনামুলের প্রথমে ফেসবুকে পরিচয় হয়। আলাপচারিতায় ঘনিষ্ঠ হলে তারা বিয়ে করেন। এরপর দু’জনে মিলে একটি প্রতারক চক্র গড়ে তোলেন। চক্রে পাত্রী সাজতেন সাদিয়া। এছাড়াও আরও এক নারী পাত্রী সাজতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে একজন মামা, ম্যানেজার, কাজী, একজন ট্রান্সলেটর থাকতেন। এ বিষয়ে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ মোঃ রেজাউল হায়দার বলেন, সাদিয়া খুব ভয়ঙ্কর প্রতারক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এ পর্যন্ত চক্রের মূলহোতা ও তার গাড়ি চালককে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। তারা রিমান্ডে অনেক তথ্য দিয়েছে। এ চক্রে সাদিয়ার স্বামীও জড়িত। আমরা জড়িত বাকি সদস্যদের নাম পেয়েছি। চক্রের সব সদস্যকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জানা গেছে, সিআইডি সাদিয়ার কাছ থেকে একটি ডায়েরি উদ্ধার করেছে। যাতে লেখা রয়েছে শুধু বিয়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করে কার কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন-এসব তথ্য। এছাড়া ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয়, মোবাইল ফোন নম্বর লিখে রাখতেন ওই ডায়েরিতে। প্রতারণার নিরাপদ কৌশল হিসেবে কখনই এক সিম দিয়ে দুবার কথা বলতেন না। ফোনেই কিছু মানুষকে টার্গেট করতেন। টাকা হাতিয়ে নেয়ার পর ওই মোবাইল ফোন ও সিম নম্বর সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতেন। এমনই একজন ভুক্তভোগী শেরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন। তিনি বিবাহিত ও দুই সন্তানের বাবা। পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। তবুও তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সাদিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাদিয়া তাকে দেখে পছন্দ করার পর ভুক্তভোগীর পাসপোর্ট নিয়ে নেন। খরচ বাবদ দুই লাখ টাকা নিয়ে কিছুদিন পর কানাডার ভুয়া ভিসা দেন। এরপর বিভিন্ন খরচ দেখিয়ে তার কাছ থেকে সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। মোশারফের ভাষ্যমতে- সাদিয়া কম কথা বলেন। আলট্রা স্মার্ট। আমি বিবাহিত এবং দু’টি সন্তান রয়েছে জেনেও তিনি আমাকে শর্ত দিয়েছিলেন যে, তোমাকে আমি বিয়ে করে কানাডায় নিয়ে যাব। কিন্তু কখনও তোমার স্ত্রী ও সন্তানদের ছাড়তে পারবে না। কিন্তু সুন্দর কথা বলে আমার সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় এ প্রতারক। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করেন আরেক জন। তিনিও প্রতারণার শিকার হন। তার ঘটনাটি ছিল একটু ভিন্ন। তিনি অপকটে স্বীকার করে বলেন, আমার বড় ছেলে কানাডায় যেতে খুব আগ্রহী ছিল। আমরা কোন সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তাই এ বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করি। আমাদের ধারণা ছিল এ স্কোপের মাধ্যমে আমরা কানাডায় চলে যেতে পারব। সপরিবারে কানাডা পাঠানোর কথা ছিল। সাদিয়ার কথামতো- সপরিবারে কানাডায় যেতে মাথাপিছু পাঁচ লাখ টাকা করে মোট ত্রিশ লাখ টাকা লাগে। গত এক বছরে আমি বিভিন্ন সময় তাদের ষোল লাখ টাকা দিয়েছি। তবে সব টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে নিয়েছিল ওরা। এরপর হঠাৎ তাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ব্লক, মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ। গুলশানের ডিপ্লোম্যাটিক জোনে যে বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল, সেটিও ভুয়া। গ্রামের ঠিকানাও ভুয়া। এখন বুঝতে পারি কত বড় সর্বনাশের ফাঁদে পড়েছি। এ বিষয়ে সিআইডি জানিয়েছে, সাদিয়ার দ্বিতীয় স্বামীকে গ্রেফতার করা না গেলে মোশাররফের মতো আরও অনেক নিরীহ লোক প্রতারণার শিকার হবে।
×