ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চার আসামি বেকসুর খালাস বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে তা প্রমাণিত এই হত্যাকা- মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে

মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসি ॥ বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলা

প্রকাশিত: ২২:৫১, ১ অক্টোবর ২০২০

মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসি ॥ বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত হত্যা মামলা

মোস্তফা কাদের, বরগুনা থেকে ॥ বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় দিয়েছে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। বুধবার বেলা পৌনে দুইটায় এজলাস কক্ষে বাদী ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোঃ আছাদুজ্জামান। এ মামলার ১০ আসামির মধ্যে রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। মামলার বাকি চার জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দ-প্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। ফাঁসির দ-প্রাপ্তরা হলো রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। এছাড়া এ মামলায় চার আসামিকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়েছে। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন পলাতক আসামি মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল ইসলাম সায়মুন (২১)। রায় ঘোষণার সময় পলাতক আসামি মুসা ছাড়া নয় আসামি আদালতে উপস্থিত ছিল। আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি হাইকোর্টের আদেশে জামিনে ছিল। সকাল নয়টায় মিন্নি ও তার বাবা মোজাম্মেল হক মোটর সাইকেলযোগে আদালতে আসে। অপর আট আসামিকে বরগুনা কারাগার থেকে বেলা বারোটার দিকে দায়রা জজ আদালতের ডকে উপস্থিত করা হয়। বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, সিফাত, টিকটক হৃদয়, হাসান ও মিন্নি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ভিকটিম রিফাত শরীফকে হত্যার অভিন্ন উদ্দেশ্য পূরণ কল্পে ঘটনার তারিখ সময় ও স্থানে এই মামলার ঘটনা ঘটিয়ে তাকে খুন (সঁৎফবৎ) করে পেনাল কোডের ৩০২ ও তৎসহ পঠিত ৩৪ ধারার অধীন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে মর্মে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। উক্ত ৩০২ ধারায় মৃত্যুদ-, অথবা যাবজ্জীবন কারাদ- এবং তৎসহ অর্থদ-ের বিধান রয়েছে। উক্ত ৩৪ ধারা মূলত স্বতন্ত্রভাবে শাস্তির বিধান আরোপকারী কোন ধারা নয়। এটা অপরাধের মূল শাস্তি আরোপকারী অন্যান্য ধারার পরিপূরক। এটা বলা হয়েছে কতিপয় ব্যক্তি মিলে তাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য কোন অপরাধজনক কাজ করলে সেই অপরাধের জন্য তাদের প্রত্যেকে, সে একা উক্ত কাজ করলে যেভাবে দায়ী হতো, ঠিক সেভাবেই দায়ী হবে। তদানুসারে, এ মামলার ভিকটিম রিফাত শরীফকে খুন করার দায়ে উক্ত আসামিরা সমানভাবে দায়ী। প্রকাশ্য দিবালোকে সনাতনী অস্ত্র রামদাও দ্বারা কুপিয়ে সংঘটিত এ মামলার নির্মম হত্যাকা- মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। উক্ত নির্মম হত্যাকা- সংঘটনকারী আসামিরা প্রত্যেকে যুবক। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে যুবসমাজসহ দেশ-বিদেশের সব বয়সের মানুষ তাহাদের উক্ত নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছে। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাদের পদাস্ক অনুসরণ করে দেশের যুব সমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশস্কা থাকবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়। আদালত রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে (১৯) পেনাল কোডের ১৮৬০ এর ৩০২ ও তৎসহ ৩৪ ধারার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে প্রত্যেককে মৃত্যুদ- ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদ-ে দ-িত করে। প্রদত্ত মৃত্যুদ- মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে অনুমোদন হওয়া সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফাঁসির দড়িতে জুলিয়ে রেখে তাদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার নির্দেশ দেয় আদালত। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা আপীল করার ইচ্ছা পোষণ করলে রায় ঘোষণার সাত কার্যদিবসের মধ্যে করতে পারিবে মর্মে আদালত আদেশ প্রদান করে। দ-িত অর্থ আদায়ের জন্য ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোডের ৩৮৬(১)(এ) ধারার বিধানমতে পরোয়ানা ইস্যু ও আদেশ দেয়া হয়। খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের জব্দকৃত মালামাল এবং নিহত রিফাত শরীফের পরিহিত কাপড়-চোপড় ফেরত প্রদানের আদেশ দেয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষে পিপি ভুবন চন্দ্র হাওলাদার এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। অপরদিকে দ-প্রাপ্ত আসামিদের আইনজীবীরা এ রায়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আপীল করার কথা জানান। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারী কলেজের গেটে প্রকাশ্য দিবালোকে ০০৭ নয়ন বন্ড বাহিনীর সদস্যরা স্ত্রী মিন্নির সামনে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে আহত করে। ঘটনার সময় নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিফাত শরীফকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। ঐদিন বিকালে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সে মারা যায়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশ বিদেশে প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় ওঠে। ঘটনার পরদিন বরগুনা থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে এজাহার দায়ের করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। তার দায়েরকৃত এজাহারের ১ নম্বর সাক্ষী ছিল নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। পরবর্তীতে পুলিশ তদন্তে এ হত্যাকা-ের প্ররোচনার সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততা পেয়ে তাকে আসামি করে এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুভাগে বিভক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশীট) দেয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক হুমায়ুন কবির। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। আদালতে মিন্নিসহ ১৫ জন আসামি ফৌঃ কাঃ বিঃ ১৬৪ ধারা মোতাবেক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এরপর ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ৭৬ জন সাক্ষী আদালতে উপস্থিত করে। আদালত তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ করে। আসামিপক্ষের নিয়োজিত কৌঁসুলিরা উক্ত সাক্ষীদের জেরা করেন। চলতি বছরে ১৬ সেপ্টেম্বর এ মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আসাদুজ্জামান রায়ের জন্য বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেন। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজী। তার বাসা বরগুনা পৌর শহরের ধানসিঁড়ি সড়কে আহসান হাবিব দুলাল ওরফে দুলাল ফরাজীর ছেলে। তাকে ৩ জুলাই ২০১৯ গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে সোপর্দ করে। রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নকারী এই রিফাত ফরাজী। নয়ন বন্ডের ঘনিষ্ঠ সহচর রিফাত ফরাজী মূলত এলাকায় ছিচকে চুরি থেকে শুরু করে বরগুনায় অবস্থানরত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের ম্যাচে হানা দিয়ে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে মারধর করে অর্থ আদায় করত। ২০১৯ সালে মার্চ মাসে বন্ড ০০৭ নামের একটি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলে গ্রুপে সদস্য যুক্ত করতে থাকে। রিফাত শরীফকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যার আগের রাতে এই ফেসবুক গ্রুপেই হত্যার সর্বশেষ নির্দেশনা দেয় রিফাত ফরাজী। সেখানে গ্রুপের সবাইকে ২৬ জুন বুধবার সকাল ৯টার মধ্যে বরগুনা সরকারী কলেজের সামনে আসার নির্দেশনা দেয়া হয়। আসামিদের মধ্যে একজনকে সকাল ৯টায় আসার সময় রামদা নিয়েও আসতে বলে। রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার পর পরিকল্পনা মোতাবেক তাকে প্রথম কলার ধরে রিফাত ফরাজী। এরপর নয়ন বন্ডের হাতে দিয়ে সে দৌড়ে দুহাতে দুটি রামদা নিয়ে এসে একটি নয়ন বন্ডকে দেয় অন্যটি দিয়ে নিজেই কোপাতে শুরু করে। পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে হামলা-ভাংচুর, ব্যাংক কর্মকর্তার ছেলেকে কুপিয়ে যখমসহ তার বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যার আগেও ভাংচুর, চাঁদাবাজি, ছিনতাই এবং মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে মোট ৮টি মামলা রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এসব মামলায় কয়েকবার গ্রেফতারও হয়। তবে আইনের ফাঁকফোকরে প্রতিবারই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আবারও সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ে। ধানসিঁড়ি রোড, কেজি স্কুল রোড এবং ডিকেপি রোডের বাসিন্দারা তার এহেন কর্মকা-ে ভীত এবং অন্যদিকে অতিষ্ঠ ছিল। রিফাত ফরাজীর বিরুদ্ধে হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৪ ও ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ২নং আসামি আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি ওরফে রাব্বি আকন। সে বুড়িরচর ইউনিয়নের পশ্চিম কেওড়াবুনিয়া এলাকার ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবুল কালামের ছেলে। বন্ড গ্রুপের অন্যতম সদস্য রাব্বি আকন বন্ড গ্রুপের প্রধান নিহত নয়ন বন্ড সেকেন্ড ইন কমান্ড রিফাত ফরাজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রিফাত শরীফ হত্যার পরিকল্পনায় ও ঘটনাস্থলে সক্রিয় ভূমিকায় ছিল রাব্বি আকন। ঘটনার আগের দিন ২৫ জুন রিফাত শরীফকে হত্যার বিষয়টি রিফাত ফরাজী মোবাইলে রাব্বি আকনকে জানায়। ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৮টার সময় নিহত রিফাত শরীফ কলেজে রওনা করলে রাব্বি আকন সকাল সাড়ে আটটায় রিফাত ফরাজীকে মুঠোফানে খবরটি জানায় এবং কলেজের আসতে বলে। পরবর্তীতে পরিকল্পনা মোতাবেক রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে ধরে মারধর করতে করতে নয়ন বন্ডের হাতে তুলে দেয়। হত্যার সময় যাতে পালাতে না পারে অন্য আসামিদের সঙ্গে রাব্বি আকনও রিফাত শরীফকে ঘিরে রাখে। ঘটনার সময় রাব্বি আকন বেশ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে আদালত তার বিরুদ্ধে ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করে। চার্জ গঠনের পর রাব্বি আকন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছিল। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৩নং আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত। সে বন্ড গ্রুপের অন্যমত সদস্য সিফাত ঘটনার আগের দিন ২৫ জুন বিকেলে বরগুনা সরকারী কলেজে রিফাত শরীফ হত্যা পরিকল্পনার মিটিংয়ে উপস্থিত ছিল। পরিকল্পনা মোতাবেক রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে সিফাতও তাকে ঘিরে ধরে এবং রিফাত ফরাজীর সঙ্গে রামদা আনার জন্য দৌড়ে যায়। পরে ফিরে এসে রিফাত ফরাজীর ও নয়ন বন্ড রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপানোর সময় নিহত রিফাতকে ঘিরে রাখে। সিফাত বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার রায়হানপুর ইউনিয়নের লেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন ওরফে আর্মি দেলোয়ারের ছেলে। বরগুনা পৌরসভার কলেজিয়েট স্কুল এলাকায় বাবা-মার সঙ্গে বসবাস করত। তার বিরুদ্ধে এর আগেও বরগুনা থানায় তিনটি মামলা রয়েছে। রিফাত শরীফ হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করে আদালত। ১ জুলাই ২০১৯ তারিখে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ৪নং আসামি রেজোয়ান আলী খান ওরফে টিকটক হৃদয়। সে বরগুনা সদরের বদরখালী ইউনিয়নের কুমড়াখালী চালিতাতলা এলাকার বাসিন্দা রফিক আলী খান ওরফে রকীবের ছেলে। বন্ড গ্রুপের হত্যাকা-ের সময় টিকটক হৃদয় আসামি রিফাত ফরাজীর সঙ্গে ঘটনাস্থল রেকি করতে থাকে। রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্যরা ঘিরে ধরে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় টিকটক হৃদয় দৌড়ে রিফাত ফরাজীর সঙ্গে কলেজের পূর্ব দিকে রাখা রামদা আনতে যায় এবং ফিরে এসে রিফাত শরীফকে ঘিরে রাখে। ১ জুলাই ২০১৯ তারিখে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে হত্যার পরিকল্পনা ও সরাসরি অংশ নেয়ার অভিযোগে ছিল। মৃত্যুপ্রাপ্ত ৫নং আসামি হাসান। বরগুনা সদর উপজেলার ২নং গৌরীচন্না এলাকার বাসিন্দা আয়নাল হকের ছেলে। বরগুনা পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডে কলেজ সড়কে তালুকদারের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ভাড়া থাকত। রিফাত শরীফ হত্যাকা-ের সময় হাসান ঘটনাস্থল রেকি করা ও রিফাত শরীফ বের হওয়ার পরপরই অন্যদের সঙ্গে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে কোপানোর সময় ঘিরে রাখার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। ১ জুলাই ২০১৯ তারিখে তাকে গ্রেফতার করা হয়। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি বরগুনা পৌরশহরের ২ নং ওয়ার্ডের কড়ইতলা মাইঠা এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জ্যেষ্ঠ কন্যা। পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং হত্যাকা-ের সহায়তা ও সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে মিন্নির বিরুদ্ধে। পুলিশ তদন্তে রিফাত শরীফকে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মিন্নিকে চিহ্নিত করেছে। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের আগে নয়ন বন্ডের সঙ্গে তার রেজিঃ কাবিন মূলে বিবাহ হয়। এ বিবাহ গোপন রেখে পরবর্তীতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে রিফাত শরীফকে বিবাহ করে। এ বিয়ের পরও নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বহাল রাখে। এ ঘটনার জের ধরেই রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করে মিন্নি ও নয়ন বন্ড এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে। মিন্নি, নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা আগের দিন বিকেলে সরকারী কলেজের শহীদ মিনারের কাছে গোপন বৈঠক করে রিফাত শরীফকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। তাদের পরিকল্পনাও ছক মেতাবেক পরের দিন রিফাত শরীফকে হত্যা করা হয়। এছাড়াও রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করার পর নয়ন বন্ডের সঙ্গে ফোনালাপ ও মুঠোফোনে খুদে বার্তা দেয় মিন্নি। নয়ন বন্ডের মায়ের নামে নিবন্ধিত একটি সিম মিন্নি গোপনে ব্যবহার করত। ওই নম্বরের সঙ্গে নয়ন বন্ডের বিভিন্ন সময়ে কল লিস্ট ও কল ডিটেইলস জমা দিয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এছাড়াও আলামত হিসেবে নিহত নয়ন বন্ডের বাসা থেকে মিন্নির স্যালোয়ার কামিজ, আই ভ্রু, মিন্নির ছবি, মাথা আচড়ানো চিরুনি, চিরুনিতে পেঁচানো মিন্নির চুল জব্দ করা হয়। ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই মিন্নি গ্রেফতার হন, ওই বছরের ২৯ আগস্ট মিন্নির জামিন মঞ্জুর করে উচ্চাদালত এবং ৩ সেপ্টেম্বর কারাগার থেকে মুক্ত পায় মিন্নি। মামলার একমাত্র জামিনে থাকা আসামি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিরুদ্ধেও হত্যার পরিকল্পনা ও সরাসরি অংশ নেয়ার অভিযোগে ৩০২ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। এ মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে বরগুনা শহরে ব্যাপক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শহরে মোতায়ন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ। কোর্ট প্রাঙ্গণে ছিল তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শহরের সর্বত্র টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয় এ মামলার রায়। মিন্নিকে মৃত্যুদ- দেয়ার ব্যাপারে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তবে অধিক অংশ মানুষই এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, এ মামলার ১৪ শিশু অপরাধীর বিচার কার্যক্রম চলছে বরগুনা শিশু আদালতে। ইতোমধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ ও ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামি পরীক্ষা ও তাদের বক্তব্য গ্রহণ সমাপ্ত হয়েছে। আগামী ৫, ৬ ও ৭ অক্টোবর যুক্তিতর্ক শুনানির জন্য রয়েছে।
×