ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহ বুলবুল

এক ক্রসরোডে দুই দুঃখের পথিক

প্রকাশিত: ২৩:৫৮, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

এক ক্রসরোডে দুই দুঃখের পথিক

১৯৫৩ সালের ৭ জুলাই। শীতের এক পড়ন্ত বিকেল। বুয়েন্স আয়ার্সের রেটিরো স্টেশন। বন্ধু কালিসা ফেরারকে সঙ্গী করে ট্রেনে চড়েন সদ্য পাস করা আর্জেন্টাইন ডাক্তার আর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সেরনা। ইকুয়েডরে এসে পথ পরিবর্তন করে পনামা, কোস্তারিকা আর নিকারাগুয়া পেরিয়ে লক্ষ্যস্থল গুয়াতেমালায় আসেন ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এখানেই ভবঘুরে আর্জেন্টাইন ডাক্তার আর্নেস্তোর সঙ্গে পেরু থেকে নির্বাসিতা হিলদা গাদেয়ার প্রথম পরিচয়। হিলদা বেনিতা গাদেয়া আকোস্তা। ডাক নাম হিলদা। পেরুর লিমা থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত বিপ্লবী মেয়েটি বিশ্বময় আরও বেশি নন্দিত কারণ সে লাতিন আমেরিকার নিষ্পেষিত খনি শ্রমিকদের প্রিয় কমরেড চে গুয়েভারার প্রথম স্ত্রী। গেরিলা চে’র প্রথম কন্যা হিলদিতার মা। পেরুভিয়ান লড়াকু মেয়ে হিলদা বেনিতা গাদেয়া আকোস্তার জন্ম ১৯২৫ সালের ২১ মার্চ পেরুর রাজধানী লিমায়। শৈশব থেকেই গতিময় এবং অনন্য মেধার অধিকারী মেয়েটি তৎসময়কার অন্য যে কোন মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি সে সম্পাদক, সহযোগী হিসাব রক্ষক এবং অনুবাদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং এসব করেই ১৯৪৬ সালে তাঁর গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন হয়। সময়ের হাত ধরে হিলদা গাদেয়া নিজেকে নির্মাণ করেছেন একজন বিজ্ঞ পেরুভিয়ান অর্থনীতিবিদ, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা এবং মানবতবাদী লেখিকা হিসেবে। লিমাবাসী মেয়েটির রাজনৈতিক চেতনা এবং নের্তৃত্ববোধের জাগরণ শিক্ষাজীবন থেকে। হিলদার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন ছিল ভিক্টর রাউল হায়া দে লা তরে প্রতিষ্ঠিত পেরুভিয়ান আপ্রিস্তা পার্টি দ্য আমেরিকান পপুলার বিভুল্যাশনারি এ্যালায়েনস (এপিআরএ) যোগদান। পরবর্তীতে হিলদা গাদেয়া এপিআরএ’র অর্থনীতিবিষয়ক জাতীয় কমিটির সচিব নির্বাচিত হন। এপিআরএ’র ইতিহাসে হিলদা গাদেয়া ছিলেন সর্বপ্রথম নারী সচিব। ১৯৪৮ সালের ২৭ অক্টোবর সেনা অভ্যুথানের মাধ্যমে জোসে বুস্তামন্তে রিভারোকে হটিয়ে ম্যানুয়েল এ ওদরিয়া পেরুর ক্ষমতা দখল করলে হিলদা কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন এবং পরে আশ্রয় নেন লিমায় অবস্থিত গুয়াতেমালা দূতাবাসে। ১৯৪৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর হিলদা একজন নির্বাসিতা বিপ্লবী নারী হিসেবে মাতৃভূমি পেরু ছেড়ে আশ্রয় নেন গুয়াতেমালায়। তখন গুয়াতেমালা ছিল নির্বাসিত জীবনের সহজ ঠিকানা। বিপ্লবী স্বামী চে গুয়েভারাকে নিয়ে হিলদা গাদেয়ার লেখা স্মৃতিচারণমূলক বই ‘মাই লাইফ উইথ চে’ এর সূচনা পর্বের লেখক হিলদা গাদেয়ার ছোট ভাই রিকার্দো গাদেয়ার লেখা ও মিরনা এলিগিয়া তরেস রিভারসের স্মৃতিচারণে হিলদা বলেন, ‘আমি ভেনেজুয়েলা, পেরু এবং হনডুরাস থেকে আগত নির্বাসিত অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি কিন্তু আমি এবং আমার বন্ধুদের জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল আর্নেস্তো গুয়েভারা এবং গ্রাসিয়া বিশেষত বাইরে অপেক্ষমাণ একজনের সাধাসিধে এবং প্রাকৃতিক মনোভাব।’ পরিচয় পর্বের শুরু থেকে আর্নেস্তো এবং হিলদার ছিলো অনেক অনেক সুখস্মৃতি। তারা রাজনৈতিক আলোচনার বাইরে সাহিত্য পাঠ, একান্তে এবং বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যেতেন। হিলদা এবং আর্নেস্তো গুয়েভারার রাজনৈতিক চেতনা এবং মুক্তির জন্য অবধারিত বিপ্লবের চিন্তায় ছিলেন অভিন্ন। ১৮ জুন দুপুর থেকে গুয়াতেমালার নিরীহ মানুষদের ওপর বিমান থেকে বোমা আর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এক সপ্তাহের তা-বে গুয়াতেমালা পরিণত হয় লাশের উপত্যকায়। ১৯৫৪ সালের ২৭ জুন কর্নেল জাকোবো আরবানেজ গুজমান পদত্যাগ করলে কার্লোস ক্যাস্তিলো আরমাস ৭ জুলাই গুয়াতেমালার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন। অভ্যুত্থান বিরোধিতার কারণে দু’মাস বন্দী অবস্থায় থেকে ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে আর্নেস্তো এবং হিলদা আরও ক’জন নির্বাসিতের সাথে মেক্সিকোতে এসে পৌঁছেন। মেক্সিকোতে এসে হিলদা জাতিসংঘের লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলবিষয়ক অর্থনৈতিক কমিশনে অস্থায়ী ভিতিতে যোগ দেন এবং চে হাসপাতালের চাকরি ছাড়াও নানা পেশায় নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জন করতেন। অনেকটা গুছানো এবং উপার্জনক্ষম ডাক্তার আর্নেস্তো ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয়বার হিলদাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। গুয়াতেমালায় ভবঘুরে আর্নেস্তোর ডাকে অর্থনীতিবিদ হিলদা সাড়া না দিলেও মেক্সিকোতে দু’জন নির্বাসিত বন্ধু বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয় এবং ১৯৫৫ সালের ১৮ আগস্ট রাউল কাস্ত্রোর সার্বিক তত্ত্বাবধানে আর্জেন্টিনার ডা. আর্নেস্তো চে গুয়েভারা দে লা সেরনার সঙ্গে বয়সে কিছুটা বড় পেরুর নির্বাসিতা মেয়ে হিলদা গাদেয়া আকোস্তার বিয়ে হয়। ১৯৫৬ সালে জন্ম নেয় হিলদা চে দম্পতির প্রথম কন্যা সন্তান হিলদিতা। চে তাঁর প্রিয় ফুফু বিয়োত্রিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে সন্তানের নাম রাখেন হিলদা বিয়োত্রিজ গুয়েভারা গাদেয়া। তবে হিলদিতাকে চে আদর করে ‘ছোট মা’ বলে ডাকতেন। সর্বহারা আন্দোলনের কারণে পেরু থেকে নির্বাসিতা হিলদা বিয়ের পর স্বামী সন্তান নিয়ে সাদাসিধে সংসারী হতে চেয়েছিলেন। দু’জনের চাকরি আর হিলদিতাকে নিয়ে বুনতেন একটা নিরিবিলি সংসারের স্বপ্ন কিন্তু কিউবা বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর আর্নেস্তো তখন হিলদার গহীন সুখ আর সংসার থেকে তিল তিল করে দূরে সরে আসা এক প্রতিশোধমুখী গেরিলা যোদ্ধা। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর গভীর রাতে ঘুমন্ত কন্যা হিলদিতার কপালে চুমু দিয়ে গ্রানামা যুদ্ধে বেরিয়ে পড়েন চে। সর্বহারা আন্দোলনের কারণে নির্বাসিত অথচ নিতান্তই সংসারী মেয়ে হিলদা বুঝতে পারতেন স্বামী চে তাঁর আঁচল হারা। তথাপি এই অমোঘ টান থেকে ফিরে আসার পথ জানা নেই। শুধু কিউবার বিপ্লব জানবে স্বামীহারা এক পেরুবাসী নারীর করুণ আহাজারি। ইতোমধ্যে পেরুর রাজনৈতিক আকাশ থেকে কালোমেঘের ঘনছায়া সরে গেলে ১৯৪৮ সালের সেনা অভ্যুত্থানের সময় নির্বাসিতদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। আট বছরের দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের দুঃসহ স্মৃতি পেছনে রেখে সন্তান হিলদিতাসহ ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে আবারও পেরুর লিমায় বাবা মায়ের কাছে ফিরে আসেন হিলদা। ১৯৫৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। গেরিলা বাহিনী নিয়ে চে তখন সিয়েরামায়েস্ত্রার পর্বত অঞ্চলে যুদ্ধরত। এ সময় লিমা থেকে আসে হিলদার চিঠি যাতে স্বামীর পাশে থেকে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিপ্রায় ছিল। ইতোমধ্যে চে’র গেরিলা বাহিনী লাস ভিলাস অতিক্রম করে এসকামরে পর্বতমালার দিকে অগ্রগামী। প্রতোত্তরে স্ত্রী হিলদাকে চে জানালেন যুদ্ধ একখন একটা বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে, এটা উপযুক্ত সময় নয় তবে একটা স্থায়ী ঠিকানা হলে তোমাকে অবশ্যই জানাব। ১৯৫৯ সালের প্রথম দিন লাতিন আমেরিকার বুক থেকে জেগে উঠে বিপ্লবের লাল পতাকা। কিউবায় মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিলেন আর্জেন্টাইন ডাক্তার গেরিলা কমান্ডার চে গুয়েভারা। মুক্তির উৎসবে স্বামীর সঙ্গী হতে সন্তান হিলদিতাসহ হিলদা গাদেয়া কিউবায় আসেন ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে। সুখ তো লেখা ছিল না নির্বাসিতা পেরুভিয়ান মেয়েটির কপালে। একদিন চে জানালেন এসকামরে পর্বতমালার গহীন জঙ্গলে দেখা গেরিলা যোদ্ধা আলাইদা মার্চের কথা। হিলদা বুঝলেন সান্তাক্লারার যুদ্ধে নিহত গেরিলাদের দাফন রাতে তাঁর স্বপ্নও দাফন হয়ে গেছে। ১৯৫৯ সালের মে মাসে হিলদা ও চে গুয়েভারা ডিভোর্সের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রেম আর সংসার জীবনের ইতি ঘটান। নিঃসঙ্গতা বুকে চেপে কিউবা ছেড়ে নিজের মাতৃভূমি পেরুতে ফিরে আসেন নির্বাসিতা অথচ দুঃখবাহী মেয়েটি। অবশ্য ১৯৫৯ সালের দিকে চে গুয়েভারার অনুরোধেই হিলদা গাদেয়া কিউবার কৃষি সংস্কার কমিশনে যোগ দেন যার প্রধান ছিলেন চে গুয়েভারা নিজেই। কিউবায় চাকরিকালীন সময় হিলদার বাসা ছিল হাভানার অদূরে মিরামার আবাসিক এলাকায় যেখানে আদরের মেয়ে হিলদিতাকে এক নজর দেখতে প্রায়ই চে গুয়েভারা আসতেন এবং এক কাপ কপি না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করতেন হিলদার কাছেই। কিউবায় হিলদা প্রাক্তন স্বামী মিনিস্টার চে গুয়েভারার খুব কাছে থেকেও অনুভব করেছেন জমানো কষ্টের সমান দূরত্ব। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বলিভিয়ার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধকালে প্রাদো সালমান বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে আহত ও বন্দী গেরিলা কমান্ডার চে গুয়েভারাকে পরদিন ৯ অক্টোবর দুপুর নাগাদ নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ব্যথাতুর মনে ১৯৬৯ সালে হিলদা পুনরায় ফিরে আসেন নিজ দেশ পেরুর লিাময়। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে হিলদা আবারও হাভানায় আসেন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে আহত হন সড়ক দুর্ঘটনায়। হিলদার পাঁজরের তিনটি হাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আহত হিলদার চিকিৎসা করতে গিয়ে ডাক্তার জানালেন সে মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত। কিছুটা সুস্থ হয়ে হিলদা গাদেয়া আবারও পেরুতে ফিরে আসলেও মরণ ব্যাধি ক্যান্সার হিলদার পিছু ছাড়েনি। ১৯৭৪ সালে জানুয়ারির শেষদিকে দিকে হিলদার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসার জন্য হাভানায় ফিরে যান। জমানো কষ্ট আর মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করে ১৯৭৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন পেরুর বিপ্লবী নারী হিলদা বেনিতা গাদেয়া আকোস্তা। চে’র সঙ্গে ডিভোর্স হলেও সন্তান হিলদিতা ছিল চে হিলদা দম্পতির নয়নের মনি কিন্তু জীবনের চিত্রায়ন কখনও সখনও একটু বেশিই নির্মম হয়। বাবা চে’র মতো ৩৯ বছর বয়স আর মায়ের মতোই মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ১৯৯৫ সালে ২১ আগস্ট কষ্টকাতর পৃথিবীকে বিদায় জানান চে হিলদার আদুরে সন্তান হিলদিতা। এ যেন একটা ক্রসরোডে দাঁড়ানো দু’জন দুঃখী পথিকের একবুক অমোঘ বেদনা।
×