ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ু দূষণে মানুষের গড় আয়ু কমছে

প্রকাশিত: ২৩:০৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০

বায়ু দূষণে মানুষের গড় আয়ু কমছে

শাহীন রহমান ॥ সাম্প্রতিক সময়ে বায়ু দূষণ সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমেছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, খোদ রাজধানী ঢাকায় গত ১০ বছরে বায়ু দূষণ বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বায়ু দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু দুই থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কমছে। এছাড়াও এর ফলে নানা ধরনের অসুখের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাই বায়ু দূষণের সবচেয়ে শিকার হচ্ছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডির তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে বায়ু দূষণ ১১ শতাংশ ডায়াবেটিস, ১৬ শতাংশ ফুসফুসের ক্যান্সার, ১৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী ফুসফুসের রোগ, ইসকেমিক হৃদরোগে ১০ শতাংশ মৃত্যু এবং ৬ শতাংশ স্ট্রোকের জন্য দায়ী। বায়ু দূষণে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম। আন্তর্জাতিক গবেষণায় উঠে এসেছে বায়ু দূষণের ফলে দেশটির গড় আয়ু প্রায় দুই বছর কমেছে। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীর পরই বায়ু দূষণে ঢাকার অবস্থান। ঢাকার বায়ুতে ক্ষুদ্র দূষক পিএম২.৫-এর মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের ৮ গুণ এবং জাতীয় মানের চেয়ে ৬ গুণ বেশি। বায়ু দূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের রিপোর্ট অনুযায়ী এই গতবছর নবেম্বর থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত একদিনের হিসেবে বেশ কয়েকবার রাজধানীর ঢাকার নাম এক নম্বরে উঠে আসে বায়ু দূষণের তালিকায়। যদিও করোনার কারণে এই দূষণ অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণ আবারও সহনীয় মাত্রা অতিক্রম করেছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার এক পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা গত ১০ বছরে ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার বায়ু দূষণ মাত্রা কমানোর জন্য জরুরী ভিত্তিতে সময়োপযোগী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা বরাবরই বলছেন, ঢাকার চারপাশে ইটভাঁটির কারণে ঢাকার বায়ু বিষাক্ত কণার উপস্থিতি বেশি। যদিও লকডাউনকালে তা সীমিত মাত্রায় নেমে আসে। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, লকডাউনের সময় ঢাকার বায়ুর মান আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছিল। মানুষের চলাফেরা ছিল না। লকডাউনকালে প্রমাণ হয়েছে ইটভাঁটির কারণেই ঢাকার বাতাস বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি মানুষকে সবচেয়ে বেশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে এই বায়ু দূষণকে। বায়ু দূষণের প্রভাব মানবদেহে প্রত্যক্ষভাবে পড়ছে। বিষাক্ত বাতাস ফুসফুসে ঢুকে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। নীরব ঘাতক হয়ে প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। ঢাকার সড়ক ও ঘরের ভেতরের বায়ু দূষণ নিয়ে সম্প্রতি পরিচালিত দু’টি গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে দেশের শিশুরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও পড়ছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের রসায়ন বিভাগ পরিচালিত যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার রাস্তায় ধুলায় উচ্চমাত্রার সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা ক্রোমিয়াম, নিকেল আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি রয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআইসি) পরিচালিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বায়ু দূষণে বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু প্রায় ২ বছর পর্যন্ত কমছে। তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর আগেও বায়ু দূষণ মানবস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ছিল। শক্তিশালী ও টেকসই পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে করোনা পরিস্থিতির পরেও এ ঝুঁকি থাকবে। যক্ষ্মা, এইচআইভি বা এইডস ও ধূমপানের চেয়েও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আয়ু কমানোতে বেশি প্রভাব ফেলে বায়ু দূষণ। এ দূষণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একটি মারাত্মক উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের প্রায় এক চতুর্থাংশ মানুষ বাস করে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ- বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তানে। যা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুই দশক আগের তুলনায় এখন দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এসব দেশে বসবাসরত মানুষের গড় আয়ু পাঁচ বছর কমেছে। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ঘরের বাইরের দূষিত বাতাস মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। দূষিত বায়ুর মধ্যে থাকলে একজন মানুষের হৃদরোগ এবং ফুসফুসের অসুখ হবার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া স্বাস্থ্যের ওপর এর অন্য নেতিবাচক প্রভাব তো আছেই। গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আরও দেখান যে, বায়ু দূষণের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলো জাতীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে পড়ে। বায়ু দূষণের প্রভাব একেক দেশে একেক রকম হয়। এছাড়া বায়ু দূষণের সঙ্গে ছয় ধরনের রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ ও ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো রোগের সংযোগ নিরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে হৃদরোগের কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়। এরপরেই রয়েছে ফুসফুসের সংক্রমণ। আর বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন বয়স্ক ব্যক্তিরা। সারা দুনিয়ায় বায়ু দূষণে যত মৃত্যু হয় তার ৭৫ শতাংশই ঘটে যাদের বয়স ৬০ এর ওপরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এশিয়ার বায়ুর গুণমান অনেক খারাপ, বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২.৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে। বায়ুতে পিএম ২.৫ উপাদানের কারণে বিশ্বে তিন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ ভারত ও চীনে বসবাস করত।
×