ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

৫ বছরে সারাদেশে ১৬ হাজার ৯৭৪ হত্যাকাণ্ড

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের কারণ

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের কারণ

শংকর কুমার দে ॥ বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক খুনের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। আপনজনরাও ঘটাচ্ছে অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। মা খুন করছে সন্তানকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়ন কক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাঙ্কে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে খুনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে যা পূর্ব পরিচিতদের দ্বারাই ঘটছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের ঘটনার কারণ বলে পুলিশের দাবি। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারাদেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন। প্রতি বছর দেশে গড়ে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জন খুন হচ্ছেন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকা-ই বীভৎস ও রোমহর্ষক। পরকীয়া, জমি সংক্রান্ত বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড়, পূর্ব শত্রুতা নানা কারণেই নৃশংস খুনের ঘটনা বাড়ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের পিক টাইমে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়েছিল। জীবনযাত্রা আগের অবস্থায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিচিত্র ধরনের অপরাধের নৃশংসতা, বীভৎসতা, রোমহর্ষক ঘটনা বাড়ছে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মাঝে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে জিঘাংসা বা প্রতিশোধ পরায়নের পর বীভৎস, নৃশংস, বিকৃত খুনের ঘটনার বেশিরভাগই ঘটছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের দাবি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। এসব খুনের ঘটনার বিবরণ শুনলে ভয়ে চোখ বুজে আসে, গা ছম ছম করে। নির্মম ও হৃদয় বিদারক খুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে গলাকেটে হত্যা করে লাশের টুকরো করা, শ্বাসরোধে হত্যার পর মাটিচাপা দেয়াসহ বিভিন্ন নৃশংস ঘটনা ঘটছেই। আবার অনেক ঘটনা হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলেও চালানো হচ্ছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে লকডাউনের সময় দেশে অপরাধের মাত্রা শূন্যের কোঠায় পৌঁছলেও আবারও অপরাধের মাত্রা বেড়েছে। সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন জটিলতা ও টানাপোড়েনের কারণে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকা-ে ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মাত্র তিনদিন আগে রাজধানীর খিলগাঁও থানার পূর্ব নন্দিপাড়া ছয় নম্বর গলির দুই ভবনের মাঝে ফাঁকা স্থান থেকে মাথাবিহীন এক ব্যক্তির (৩০) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নিহতের লাশটি উদ্ধার করা হয়। নিহতের লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। নিহতের পরনে কালো রঙের জিন্স প্যান্ট ও চামড়ার বেল্ট ছিল। হতভাগ্যের পরিচয় উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। নিহতের লাশটি পচে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তি লাশটি দেখতে মর্গে এসেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার পরিচয় কেউ নিশ্চিত করেননি। পুলিশের ধারণা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ওই ব্যক্তির মাথা ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এরপর মৃতদেহটি গোপন করার উদ্দেশ্যে ঘটনাস্থলে ফেলে গেছে। তার পরিচয় না পাওয়ায় ডিএনএ প্রোফাইলিং করার জন্য ফরেনসিক বিভাগের কাছে পাঠিয়েছে পুলিশ। আর পরিচয় নির্ণয়ের জন্য সিআইডি ক্রাইম সিন-এ ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর পৃথক ঘটনায় পুলিশ গলাকাটা দুই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে। এর মধ্যে নগরীর সবুজবাগ থানা এলাকার নন্দীপাড়ায় জান্নাতুল ফেরদৌস (২৫) নামে এক গৃহবধূকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মনির (৩০) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। আটক ব্যক্তি বাসায় চুরি করতে এসেই এই হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। ঘটনার দিন সোমবার রাত ৯টার দিকে নন্দীপাড়া লাল মসজিদ সংলগ্ন সাততলা বাড়ির চারতলায় ঘটেছে এ ঘটনা। রাজধানীর অদূরে ঢাকার আশুলিয়ায় এক নারীর (৩২) লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পলাশবাড়ী এলাকা থেকে নিহতের লাশ উদ্ধার করে। তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ওই নারীর পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশ জানায়, নিহত নারী সবুজ নামে একজনের সঙ্গে পলাশবাড়ী এলাকার খোকন মিয়ার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। সবুজের ঘর থেকে দুর্গন্ধ বের হলে খোকন মিয়া বুধবার রাত ১২টার দিকে আশুলিয়া থানায় খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে লাশ উদ্ধার করে। পরে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি পারাবত-১১ নামে একটি লঞ্চের কেবিনে এক নারীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। সোমবার ভোরে লঞ্চটি বরিশাল নদী বন্দরে পৌঁছার পর মধ্য বয়সী ওই নারীর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে পুলিশ। নিহত নারীর সঙ্গে থাকা সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশ শনাক্ত করতে পারলেও তাকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারেনি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। লঞ্চটি বরিশাল নদী বন্দরে নোঙ্গর করলে ওই নারীর সঙ্গে থাকা পুরুষ ব্যক্তি নিহত নারীর ব্যাগ, মাস্ক এবং ওড়না নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে দ্রুত নেমে যায়। তার মুখম-লে মাস্ক পরিহিত ছিল। অন্য সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরও কেবিনে থাকা নারী না নামায় কেবিন বয়রা তাকে ডাকাডাকি করে। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তারা নৌ পুলিশে খবর দেয়। ওই নারীর সঙ্গে থাকা পুরুষ ব্যক্তি এই হত্যাকা-ের জন্য দায়ী বলে সন্দেহ করছে পুলিশ। নৌ পুলিশ, থানা পুলিশ এবং সিআইডির ক্রাইম সিন বিশেষজ্ঞ দল ওই নারীর মৃতদেহসহ খুঁটিনাটি সব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। নিহত নারীকে ধর্ষণ শেষে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। ওই নারীর সঙ্গে থাকা ব্যাগ, মাস্ক এবং ওড়নাও সন্দেহভাজন ওই ব্যক্তি নিয়ে গেছে এবং ওই নারী বরিশাল অঞ্চলের নয় বলে জানিয়েছেন কোতোয়ালি মডেল থানার পুলিশ কর্মকর্তা। রাজধানীর সবুজবাগে সিনিয়র জুনিয়র দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে ১৫ বছরের এক কিশোর খুন হয়েছে। উঠতি বয়সী কয়েকজনের মারামারির এক পর্যায়ে জব্বার নামে ওই কিশোর খুন হয়। এ ঘটনার নিহতের বড়ভাই বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছে। সবুজবাগের রাজারবাগ কারখানায় প্রিন্টিংয়ের কাজ সেরে বাসার সামন আসে জব্বার। প্রথমে ইমনের সঙ্গে তর্কাতর্কি, এরপর ঘটনাস্থলে আসে ইমনের ভাই ইয়াসিন। এক পর্যায়ে ইয়াসিন পকেট থেকে ছুরি বের করে আঘাত করে জব্বারকে। এ ঘটনার একদিন পর গত মঙ্গলবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় জব্বার। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন তার পরিবার। গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর পরীবাগে ছুরিকাঘাতে জখম হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান ডন (৪৫) মারা যান। ঘটনার দিন সকালে বাংলামোটরের পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) মৃত্যু হয় তার। জানা গেছে, গত ৩০ আগস্ট সন্ধ্যায় পরীবাগে বিটিসিএল অফিসের সামনে তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। গুরুতর আহতাবস্থায় মিজানুরকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাকে পদ্মা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করেন স্বজনরা। তার বন্ধু বাবুল মিয়া জানান, মিজানুরের বাসা মগবাজারের চেয়ারম্যান গলিতে। পরীবাগে বিটিসিএল অফিসের পাশে তার হোটেল ও এ্যাম্বুলেন্সের ব্যবসা রয়েছে। কথাকাটাকাটির তার পূর্ব পরিচিত ও বন্ধুরা এক পর্যায়ে মিজানুরের বুকের ডান পাশে ও তলপেটে ছুরিকাঘাত করেন কুট্টি। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজধানীর দারুস সালাম থানা পুলিশ ময়লার ডাস্টবিন থেকে গত ১১ সেপ্টেম্বর বিকেলে একটি খ-িত পা উদ্ধার করে। দারুস সালাম টাওয়ারের পাশে একটি ডাস্টবিন থেকে পাটি উদ্ধার করা হয়। পুলিশের জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯-এ ফোন পেয়ে তা উদ্ধারের পর ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। পুলিশের ধারণা কোন হাসপাতালে অপারেশনের রোগীর পা কেটে ফেলা হয়েছে। পরে তা ডাস্টবিনে ফেলা হয়। তার পরও পুলিশের প্রতি কোন অভিযোগ না হয়, সেজন্য ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য মর্গে পাঠানো হয়। রাজধানীর বাইরে হবিগঞ্জের চুনারঘাটে স্ত্রীর চাপে প্রেমিকাকে হত্যা করে লাশ টিলায় ফেলে দেন আফসার মিয়া ও তার স্ত্রী রিপা বেগম। স্ত্রীর সামনেই প্রেমিকাকে ধর্ষণও করেন তিনি। ঘটনার দিন বুধবার আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে এ তথ্য জানিয়ে ঘটনার রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রেকর্ড করা হয়। আদালতে দেয়া জবানবন্দীতে প্রেমিকাকে ধর্ষণ করার পর হত্যা কারে লাশ টিলায় ফেলে দেয়ার মতো নৃশংস ঘটনার বর্ণনা উঠে আসে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, যার মনে ক্ষোভ যত বেশি, তার দ্বারা হত্যাকা-ের নৃশংসতা তত বেশি হয়। তিনি বলেন, মানুষের চাহিদা, আকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে। তাছাড়া আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এমন খুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বীভৎস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। তার মতে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বীভৎসতা বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনী কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে। প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে মানসিক, আর্থিক স্বার্থ, দ্বন্দ্ব-বিরোধ রয়েছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞাদের দাবি। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, নৃশংস খুনের ঘটনা বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইন্টারনেটের অপব্যবহার অন্যতম হতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হলে একটা মানুষ খারাপ কাজ করতে একটু ভাবে। তারা খারাপ কাজ পরিহার করে মানবিক আচরণগুলো করে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে মানুষের মনে নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়তে পারে। তিনি বলেন, যেসব খুনের ঘটনা ঘটছে পুলিশ তা তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা।
×