ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আর কোন জিকে শামীম নয় ॥ গণপূর্তের দৃশ্যপট পাল্টেছে

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০

আর কোন জিকে শামীম নয় ॥ গণপূর্তের দৃশ্যপট পাল্টেছে

ফিরোজ মান্না ॥ আর কোন জিকে শামীম তৈরি হতে দেবে না গণপূর্ত অধিদফতর। বেপরোয়া ঠিকাদার গ্রুপ এখন আর অধিদফতরে মহড়া দিয়ে ঢুকতে পারে না। আগে সশস্ত্র ক্যাডার নিয়ে বেশ কয়েকজন ঠিকাদার গণপূর্ত ভবনে ঢুকে যেতেন। এখন সেই দৃশ্য বদল হয়েছে। ফলে বিতর্কিত ঠিকাদার জিকে শামীম তৈরি হওয়ার সুযোগও কমে গেছে। পূর্ত ভবনে ঠিকাদারদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি ‘সার্কুলার’ জারি করা হয়েছে। ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে কোন কর্মকর্তা বিতর্কিত ঠিকাদারের লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারবেন না। জিকে শামীমের আরও ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘জয়েন্ট ভেন্সারে’ কাজ রয়েছে। এই ১০ প্রতিষ্ঠানের লোকজন এখনও প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গণপূর্ত বিভাগ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। তাদের কোন লোকজন সাক্ষাত করতে চাইলে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত বিভাগ এ তথ্য জানিয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, জিকে শামীমের মতো দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারের কর্মকা-ে সরকার বিব্রত। সরকার এ ধরনের দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারকে কঠোর হাতে দমন করেছে। জিকে শামীম যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। যাতে আর কেউ এ ধরনের কর্মকা- করার সাহস না পায়। আমরা গণপূর্ত অধিদফতরকে দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এসডিজি অর্জনে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষনা দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়তে হবে। আমরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেই কাজ করছি। আমরা চাই না আর কোন জিকে শামীমের জন্ম হোক। জিকে শামীমের মতো আরও কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গণপূর্ত অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, গণপূর্ত ভবনে কাউকে কোন প্রকার অনিয়ম দুর্নীতি করতে দেয়া হবে না। প্রভাবশালী যেই হোক তার কোন অনিয়ম পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে কোন প্রকার ছাড় নেই। ঠিকাদারদের একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এটা শুধু ঠিকাদার না কোন কর্মকর্তাও যদি কোন প্রকার অনিয়ম করেন তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। অতীতে এখানে অনেক ঘটনার জন্ম হয়েছে। আর কোন ঘটনা যাতে না ঘটে তার জন্য যা কিছু করার-করা হবে। এখানে কোন প্রভাব খাটাতে দেয়া হবে না। এদিকে গণপূর্ত বিভাগের জনসংযোগ প্রচার ও লিয়াজো উইংয়ের আহ্বায়ক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ পারভেজ খাদেম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধান প্রকোশলী মোঃ আশরাফুল আলম সাংবাদিকদের তথ্য দেয়ার জন্য গণপূর্ত বিভাগের ৭ সদস্যের একটি জনসংযোগ ও প্রচার সেল গঠন করে দিয়েছেন। আমরা প্রচার সেলের মাধ্যমে গণপূর্তের সব তথ্য সরবরাহ করে আসছি। প্রচার সেলের তথ্য অনুযায়ী জিকে শামীমের ‘জিকে বিল্ডার্সের’ বাতিলকৃত কাজের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। জিকে বিল্ডার্সের ১৭ কাজ বাতিল করেছে গণপূর্ত বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ সচিবালয়ের অভ্যন্তরে ৬২ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ২০তলা ভবনে বৈদ্যুতিক অভ্যন্তরীণ স্যানেটারি কাজ, ৩২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সচিবালয়ে ২টি বেজমেন্টসসহ ২০তলা অফিস ভবন নির্মাণ, ৩১৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয়ে এনবিআর ভবন নির্মাণ, ৯ কোটি ২১ লাখ টাকা ভ্যয়ে নিটোর, (৬ তলা হাসপাতাল র‌্যাম্পাসহ নির্মাণ) শেরেবাংলা নগর, ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা (বাউন্ডারি ওয়াল মূল ভবনের কাজ), ১২ কোটি ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নিটোর (১২ তলা ভবনের বিউটিফিকেশন কাজ), ২০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মহাখালী এ্যাজমা সেন্টার নির্মাণ কাজ, ১২০ কোটি ৫৮ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ভার্টিক্যাল এক্সটেনশন কাজ, ১৬৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল নির্মাণ, ৪৩৭ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) হেড কোয়ার্টার নির্মাণ, ৪৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকার বেইলি রোডে পার্বত্য ভাবন নির্মাণ ও ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে পার্বত্য ভবনের স্যুট ও ডরমেটরি ভবন নির্মাণ। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্স নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২ তলা চেয়ারম্যানের বাস ভবন নির্মাণ কাজ। সূত্র জানিয়েছে, জিকে শামীমের কোম্পানি জিকে বিল্ডার্সের সরকারের ৫৩টি ভবন নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করছে। এর মধ্যে ১৭টিতে তার কোম্পানি এককভাবে কাজ ছিল। বাকিগুলো যৌথভাবে করছে। যে পরিমাণ কাজ করছেন তারচেয়ে বেশি টাকা নেয়নি। জিকে শামীমের যৌথভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার আরও ৪০টি প্রকল্পের প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে পদ্মা এ্যাসোসিয়েট, এনডি ইঞ্জিনিয়ারিং, হাসান এ্যান্ড সন্স, খান এ্যান্ড সন্স, হুদা কনস্ট্র্রাকশন, মাহবুব ব্রাদার্সসহ আরও কয়েকটি ঠিকাধারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ফলে জিকে শামীম জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার গণপূর্ত ভবনের প্রভাবশালী ঠিকার হয়েই উঠবে বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে সে জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে অসুস্থতার নামে আরাম আয়েশে দিন কাটাচ্ছেন। গতবছর র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয়ে মুদ্রা পাচার আইনসহ একাধিক মামলায় কারাবন্দী যুবলীগ নেতা হিসেবে আলোচিত জিকে শামীমের ঠিকাদারি কোম্পানির অধীনে বন্ধ হওয়া প্রকল্পগুলো নতুন করে টেন্ডার করা হয়েছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর আজিমপুরে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য কোয়ার্টার নির্মাণ প্রকল্প জিকে শামীম থেকে বাতিল করে তারই ‘পার্টনার’ পদ্মা এ্যাসোসিয়েটকে দেয়া হয়েছে। এই কাজ জিকে শামীম থেকে বাতিল করে কোন লাভ হয়নি। কাজটি আসলে ঘুরে ফিরে জিকে শামীমের কাছে রয়ে গেছে। তবে প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, প্রেফতার হওয়া ঠিকাদার জিকে শামীমের প্রতিষ্ঠান ‘জেকেবি এ্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড’ কোম্পানির সঙ্গে ১৭টি বড় প্রকল্পের চুক্তি বাতিল করেছে গণপূর্ত অধিদফতর। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা অনুযায়ী এসব প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। এরইমধ্যে পুনরায় দরপত্র প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিভিন্ন কাজের বর্তমান অবস্থা পরিমাপ করে ম্যাজিস্ট্রেটও নিয়োগ করা হয়েছে। প্রকল্প বাতিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জিকে শামীম মুক্ত হয়েছে গণপূর্ত অধিদফতর। জিকে শামীমের আর কোন দোসর যদি থেকেও থাকে তারও কোন জায়গা হবে না এখানে। আমরা অতীতের কলঙ্ক মুক্ত করতে কাজ করছি। গণপূর্ত অধিদফতর নিয়ে অনেক বদনাম হয়েছে। এখন সেই বদনাম মুছে দেয়া হবে। প্রধান প্রকৌশলী বলেন, অধিদফতরকে জতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গণপূর্ত অধিদফতর নিরাপদ, অভিঘাত সহনশীল এবং টেকসই ভবন নির্মাণের জন্য সব সময় সচেষ্ট রয়েছে। এতে এসডিজি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে পর্যায়ক্রমে জেলা শহরে সরকারী অফিসভবন ও আনুষঙ্গিক সুবিধাসমূহ বৃদ্ধি করা হবে। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ এবং জেলা পর্যায়ে অফিস ভবন নির্মাণে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্য নির্মাণ সামগ্রীর সর্বোত্তম ব্যবহারসহ দেশীয় প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল দ্বারা নির্মাণ শিল্পকে যুগোপযোগী ও টেকসই উন্নয়নের ধারায় পরিচালনা করা হবে। সরকারে এই লক্ষ্য অর্জনে গণপূর্ত বিভাগে কাজ করে যাচ্ছে এখানে কোন প্রকার অযাচিত হস্তক্ষেপ মেনে নেয়া হবে না। আমরা চাই, গণপূর্ত অধিদফতর সব সময় টেন্ডার সিন্ডিকেট মুক্ত থাকবে। সেটি নিশ্চিতেই আমরা কাজ করছি। গণপূর্ত অধিদফতরের একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জনকণ্ঠকে বলেন, জিকে শামীম কারাগারে বন্দী থেকেও তার অপকর্ম বন্ধ করেনি। মিথ্যা তথ্য দিয়ে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে। অপরদিকে সরকারের নির্দেশে জিকে শামীমের হাজার হাজার কোটি টাকার জব্দ করা ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলে দিতেও প্রাণপন চেষ্টা চালাচ্ছে। জিকে শামীমের প্রভাবশালী এই চক্রটি গণপূর্ত ভবনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। গণপূর্ত বিভাগ থেকে হারানো জৌলুশ ফিরে পেতে যারপরনাই চেষ্টা চালাচ্ছে কুক্ষাত এই অপরাধীর সহযোগীরা। আবার তার প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল আলমকে যে কোন মূল্যে সরিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। চালাচ্ছে নানা অপপ্রচার। জেলখানার পরিবর্তে অসুস্থতার নামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিআইপি কেবিনে বসে জিকে শামীম সবকিছু পরিচালনা করছে। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী শক্ত হাতে তার সব ধরনের অপকর্ম রোধ করে দিয়েছে। এখন তার লোকজন ভবনে আসতে হলে আগে থেকে অনুমতি নিতে হচ্ছে।
×