ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

কাঁদো বাঙালী কাঁদো ॥ বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন

প্রকাশিত: ২২:২৩, ১৫ আগস্ট ২০২০

কাঁদো বাঙালী কাঁদো ॥ বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন

‘আমি ফেরেশতা নই, শয়তানও নই, আমি মানুষ, মানুষের যা ভুলত্রুটি তা আমারও থাকতে পারে। কিন্তু আমি মানুষকে ভালবাসি, দেশকে ভালবাসি। আমার চরিত্রের শক্তি মানুষকে ভালবাসা, দুর্বলতাও মানুষকে ভালবাসা।’ এই কথা ক’টি যিনি বলেছিলেন তিনি একটি রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির পিতা এবং ভবিষ্যত নির্মাতা। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বিশ শতকে একটি অসাম্প্রদায়িক নেশন স্টেট তৈরি করেছেন। তার নাম বাংলাদেশ। তিনি একটি বিলুপ্তপ্রায় জাতিসত্তা পুনর্নির্মাণ করেছেন। সেই জাতি বাঙালী (নাগরিকত্ব বাংলাদেশী)। তিনি এই বাঙালী জাতির জন্য একটি ভবিষ্যত নির্মাণ করে গেছেন। তার নাম একটি অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা। এই ভবিষ্যতে আমরা এখনও পৌঁছাইনি। নানা বাধা-বিঘ্ন, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার সংগ্রামে অবতীর্ণ রয়েছি। বলা হয়ে থাকে আমেরিকার প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট তার দেশ ও জাতিকে একটি দর্শন উপহার দিয়ে যান। যেমন ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট তার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন নিউ ডীলের দর্শন। জন এফ কেনেডি দিয়েছিলেন নিউ ফ্রন্টিয়ারের দর্শন। এমনকি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার বিদ্যাবুদ্ধি অনুযায়ী জাতিকে একটা দর্শন উপহার দিয়েছেন, তা যতই বহির্বিশ্বে নিন্দিত হোক, তার নাম ফার্স্ট আমেরিকার দর্শন। বঙ্গবন্ধুও বাঙালী জাতিকে একটি স্বপ্ন দর্শন উপহার দিয়ে গেছেন। সেটি হচ্ছে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক একটি অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী তৈরি করার দর্শন। যে জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালী। ব্রিটিশ কলামিস্ট সিরিল ডান তার এক কলামে লিখেছিলেন, ‘বিশ শতকে শেখ মুজিবই বাঙালীর একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, শরীরে, জন্মসূত্রে, ভাষায় ও কালচারে, নৃতাত্ত্বিকভাবে খাঁটি বাঙালী। তাঁর বক্তৃতা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। কেন শোনে? কারণ তাঁর বক্তৃতায় অসত্য প্রতিশ্রুতি থাকে না। মিথ্যা অঙ্গীকার থাকে না। মানুষের মনের দুঃখকে, বঞ্চনাকে, অভাব ও অভিযোগকে তিনি ভাষা দিতে জানেন। সেই দুঃখ ও দুর্দশার প্রতিকারের পথও দেখাতে পারেন। তাই তিনি দশ কোটি বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা।’ সিরিল ডান এই মন্তব্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনকালে, ১৯৭১ সালে। তারপর বহু দশক অতিক্রান্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু চার দশকের বেশি হয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন সম্ভবত ১৮ কোটি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালে। তখন ভারত ও বাংলাদেশ অবিভক্ত। তুরস্কের ইসলামী খেলাফত ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদীরা ধ্বংস করে দিয়েছিল। ভারতের মুসলমানেরা কংগ্রেসের সহযোগিতায় খেলাফত আন্দোলন শুরু করার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। আর কংগ্রেস ব্যস্ত অসহযোগ আন্দোলনে। শিশু মুজিব সম্ভবত অসহযোগের আবেগ ধারণ করেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খেলাফত তাঁকে প্রভাবিত করেনি। পরিণত বয়সে তিনিও অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছেন। অতীতমুখী খেলাফতের রাজনীতি তাঁকে আকৃষ্ট করেনি। অতীতমুখী ওয়াহাবি আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি থেকে ধর্মীয় দ্বিজাতিভিত্তিক পাকিস্তান আন্দোলনের সৃষ্টি। লক্ষ্য করার বিষয় শেখ মুজিব প্রথম জীবনে মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক সহযোগী ছিল মুসলিম লীগের ভেতরের প্রগতিশীল অংশ। প্রথম সুযোগেই তিনি ছাত্রলীগকে এবং তারপর মওলানা ভাসানীর সহযোগিতায় আওয়ামী লীগকে অসাম্পদ্রায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। শেখ মুজিবই উপমহাদেশে প্রথম নেতা, যিনি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কোন দলের পতাকা থেকে চাঁদ-তারা বাদ দেন এবং ধর্মীয় স্লোগানের পরিবর্তে জয় বাংলা সেøাগান প্রবর্তন করেন। দলীয় সভা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা সঙ্গীত পরিবেশন দ্বারা। তিনি সাহসের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আমি একজন খাঁটি মুসলমান। কিন্তু পরিচয়ে আমি প্রথমে বাঙালী এবং শেষও বাঙালী।’ বাংলাদেশের মানুষকে তিনি একটি আধুনিক, স্পষ্ট, বাস্তব রাষ্ট্রদর্শনই উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁকে হত্যা করে সেই দর্শনের বিনাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি। ঝাপির ভেতর থেকে বিষাক্ত সাপ যেমন বারবার ফণা তোলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতেও তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত সাপ বারবার ফণা তুলছে। এই সর্প-দংশন থেকেই জাতিকে রক্ষা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর হাতেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাতি। কখনও তা ঝড়ো হাওয়ায় নিভু নিভু হয়। কিন্তু তারপরই প্রবল তেজে জ্বলে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে এক অমৃত কুম্ভের সন্ধান দিয়ে গেছেন। নিজে নীলকণ্ঠ হয়ে সব বিষ ধারণ করেছেন। তিনি নেই। বাংলাদেশ আছে। বাঙালী জাতি আছে। স্বাধীন বাংলাদেশই তার সবচাইতে বড় স্মৃতিসৌধ। এই স্মৃতিসৌধ ভাঙ্গার চেষ্টা বহুবার হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে। কিন্তু এই সৌধ ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। ভবিষ্যতেও সম্ভব হবে না। Bangladesh has come to stay- বাংলাদেশ স্থায়ী হওয়ার জন্যই এসেছে। এ বছর ২০২০ সালে পালিত হচ্ছে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী। বছরটি তাই ঘোষিত হয়েছে মুজিববর্ষ হিসেবে। সারাবিশ্বে তাঁর এই জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এই যুগস্রষ্টা মানুষটিকে সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি সম্ভবত বঙ্গন্ধুর বেলাতেই সবচাইতে বেশি প্রযোজ্য- ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।’ লন্ডন, ১৪ আগস্ট, শুক্রবার, ২০২০।
×