ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হাওড়ে ভ্রমণে গিয়ে এক পরিবারের ৮ জনসহ ১৭ প্রাণহানি

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ৬ আগস্ট ২০২০

হাওড়ে ভ্রমণে গিয়ে এক পরিবারের ৮ জনসহ ১৭ প্রাণহানি

নিজস্ব সংবাদদাতা, নেত্রকোনা, ৫ আগস্ট ॥ মদন উপজেলার উচিতপুর হাওড়ে ভ্রমণে গিয়ে ট্রলার ডুবে দুই শিশুসহ ১৭ জন মারা গেছেন। নিখোঁজ রয়েছেন আরও একজন। বুধবার দুপুর একটার দিকে উচিতপুর সংলগ্ন রাজালিকান্দা হাওড়ে এ নৌদুর্ঘটনা ঘটে। মৃতরা নেত্রকোনার আটপাড়া, ময়মনসিংহ সদর ও গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। মৃতরা হচ্ছেন- ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কোনাপাড়া গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক মাহফুজুর রহমান (৪৫), তার দুই ছেলে মাহমুদ মিয়া (১২) ও আসিফ (১৫), মাদ্রাসা শিক্ষক মোজাহারুল ইসলাম (৩৮), মাদ্রাসাছাত্র রেজাউল করিম (১৬), দর্জি মোজাহিদ মিয়া (১৭), মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল (৩৫), সাইফুল ইসলাম (৩০), ব্যবসায়ী জাহিদ (২০), মাদ্রাসা শিক্ষক রাকিব (২০), দর্জি জোবায়ের (২২), চরখরিচা গ্রামের কৃষক ইশা মিয়া (৪০), তার ছেলে শামীম হাসান (১০), লক্ষীপুর গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক জহিরুল ইসলাম (৩৫), নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি গ্রামের মাদ্রাসা শিক্ষক শফিকুর রহমান (৪০), তার ছেলে মাদ্রাসা ছাত্র সামাআন (১০) এবং শহীদুল (১০)। এদের মধ্যে আটজন মাহফুজুর রহমানের পরিবারের সদস্য। এছাড়া শফিকুল ইসলামের পরিবারের রয়েছে দুই জন। জানা গেছে, বুধবার দুপুরে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার সিরতা ইউনিয়নের কোনাপাড়া, চরখরিচা এবং গৌরীপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাদ্রাসা শিক্ষকদের একটি সংগঠনের সদস্যরা নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার তেলিগাতি এলাকার জামিয়া আরাবিয়া মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় বেড়াতে আসেন। তাদের সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থীও ছিল। সেখান থেকে তারা ওই মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে উচিতপুরের হাওড় দেখতে যান। দুপুর একটার দিকে তাদের ৪৮ জনের দল উচিতপুর থেকে একটি ট্রলারে করে গোবিন্দশ্রীর দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় রাজালিকান্দা হাওড় নামক স্থানে ঝড়ো বাতাস ও উত্তাল ঢেউয়ের কারণে ট্রলার ডুবে যায়। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখার পর প্রথমে স্থানীয়রা উদ্ধার তৎপরতা চালায়। পরে মদন থানা পুলিশ ও স্থানীয় দমকল কর্মীরা পৌঁছে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। দু’ঘণ্টাব্যাপী উদ্ধার অভিযানে প্রায় ৩০ জনকে জীবিত অবস্থায় এবং দুই শিশুসহ ১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে আরেক শিশুর সন্ধান এখনও মেলেনি। এদিকে উদ্ধারের পর বিকেলে সব লাশ মদন থানায় এনে জড়ো করা হয়। খবর পেয়ে মৃতদের স্বজনরা সেখানে গিয়ে লাশ শনাক্ত করেন। শনাক্ত করার পর জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম, পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সী, উপজেলা নির্বাহী অফিসার বুলবুল আহমেদ তালুকদারের উপস্থিতিতে লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, লাশ পরিবহন এবং দাফনের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যেকের স্বজনদের কাছে আপাতত ৭ হাজার করে নগদ টাকা সহায়তা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মঈন উল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে মোবাইল ফোনে এ প্রতিনিধিকে জানান, ‘আমরা জানতে পেরেছি ট্রলারটি রাজালিকান্দা হাওড়ে গেলে ঝড়ো বাতাসের কবলে পড়ে এবং হাওড়ে তখন প্রচন্ড ঢেউ উঠে। এ সময় ট্রলারে পানি উঠতে শুরু করলে যাত্রীরা হৈ-হুল্লুড় শুরু করেন। এ অবস্থায় এক পর্যায়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। তবে বিষয়টি আরও তদন্ত করে দেখা হবে।’ মানিকগঞ্জে নিখোঁজ দুই শিশুর লাশ উদ্ধার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, দৌলতপুরের চরমাসতুল এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনায় বুধবার সকালে নিখোঁজ দুই শিশুর লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ নিয়ে নৌকাডুবিতে পাঁচ জনের মৃত্যু হলো। মঙ্গলবার দুপুরে এই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। মৃতরা একে অপরের আত্মীয়। তারা ঈদ উপলক্ষে আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে এসে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারালো। মৃতরা হলেন, আব্দুল হকের ছেলে জিয়াউল হক জিয়া (১৩), মেয়ে রোকসানা (১৭) ও মিথিলা (৬), আব্দুল হকের শ্যালিকা হনুফা বেগম (৩০) ও তার ছেলে শান্ত (১২) দৌলতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হাসমত আলী জানান, নৌকাডুবিতে মঙ্গলবার ৩ জনের লাশ ও বুধবার নিখোঁজ দুজনের লাশসহ পাঁচ জনের লাশ উদ্ধার হলো। হাতিয়ায় জেলের মৃতদেহ উদ্ধার ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, লঘুচাপে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় উল্টে একটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে যায়। এতে ১৮ মাঝিমাল্লা জীবিত উদ্ধার হলেও মাইন উদ্দিন (৩৮) নামে একজনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। বুধবার বিকেলে ঘটনাটি ঘটে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বুড়িরচর ইউনিয়নের ধানারদোল ঘাটের সন্নিকটে মেঘনা নদীতে। দৌলতপুরে পানিতে ডুবে মা-ছেলেসহ তিন জনের মৃত্যু ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে পৃথক ঘটনায় পানিতে ডুবে মা-ছেলেসহ তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সোনাতলা সাহেবনগর এলাকায় বন্যার পানিতে ডিঙ্গি নৌকা ডুবে মা সেলিনা খাতুন (৩০) ও তার ছেলে সিয়ামের (১১) মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সেলিনার বাবা রসুল ম-ল (৬২) ও সেলিনার ছোট ছেলে সাগর (৯) সাঁতরিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। অপরদিকে পুকুরের পানিতে ডুবে তামান্না (১০) নামে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। বুধবার বেলা ১১টার দিকে উপজেলার প্রাগপুর ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত তামান্না আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ গ্রামের রফিকুল ইসলামের মেয়ে এবং ধর্মদহ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। শোকস্তব্ধ ময়মনসিংহের কোনাপাড়া ॥ স্টাফ রিপোর্টার ময়মনসিংহ থেকে জানান, স্বজনহারাদের মাতমে শোকস্তব্ধ ময়মনসিংহ সদরের কোনাপাড়া ও চরখরিচা গ্রাম। বুধবার নেত্রকোনার মদনের হাওড়ে নৌকা ডুবিতে কোনাপাড়া গ্রামের একই পরিবারের আট সদস্যসহ দুই গ্রামের প্রাণ হারিয়েছে ১৭ জন। এখনও নিখোঁজ একজন। নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার তেলিখালী মাদ্রাসা পরিচালক মাওলানা শফিকুর রহমানের আমন্ত্রণে আনন্দ ভ্রমণে গিয়ে ময়মনসিংহ সদরের কোনাপাড়া ও চরখরিচা গ্রামের মাদ্রাসার মুহতামিম ও শিক্ষকসহ তাদের পরিবারের শিশু সন্তানসহ প্রাণ হারায় ১৭ জন। বুধবার দুপুরে মোবাইল ফোনে প্রাণহানির এই খবর কোনাপাড়া ও চরখরিচায় এসে পৌঁছালে শুরু হয় স্বজনহারাদের মাতম। বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারিতে এ সময় ভারি হয়ে উঠে কয়েক গ্রামের বাতাস। স্বজন ও এলাকাবাসী কিছুতেই এমন মর্মান্তিক মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছে না। ময়মনসিংহ সদরের কোনপাড়া গ্রামের মারকাজুল সুন্নাহ মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুর রহমানের দুই পুত্র আসিফ (১৫) ও মাহবুব (১২), ভাগ্নে রেজাউল (১৫), ভাতিজা জোবায়ের (২০) ও জোনায়েদ (১৭), ভাতিজি লুবনা (১৩) ও জুলফাসহ (৭) আট সদস্য নৌকাডুবিতে প্রাণ হারান। বাড়িজুড়ে এখন কেবল আহাজারি। ভাতিজা আনিস (২০) জানান, চাচা মাহফুজুর রহমান পরিবারের নয়জন সদস্যকে নিয়ে পিকনিকে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে আটজন লাশ হয়েছেন। পাশের বাড়ির মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা আজাহার আলী ও তার ব্যবসায়ী ভাতিজা জাহিদও এই নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারিয়েছেন। মাওলানা আজাহারের চার মাস বয়সী একটি শিশু সন্তান রয়েছে। এতিম এই শিশুর কী হবে ভাবনায় বুকফাটা আর্তনাদ করছেন তার স্বজনেরা। এরকম আর্তনাদ আর শোকের মাতম চলছে চরখরিচা ও কোনপাড়া গ্রামজুড়ে। স্থানীয়রা জানায়, বুধবার সকাল ৭টার দিকে কোনপাড়া ও চরখরিচা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষক ও তাদের পরিবারের ৩৮ সদস্য নেত্রকোনার মদনের হাওড়ে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুপুরের আগেই সেই আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো। স্বজনদের অপেক্ষা এখন লাশ কখন নিয়ে আসা হবে নিজ গ্রামে।
×