ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কক্সবাজার সৈকতের সব বর্জ্য স্থানীয়

প্রকাশিত: ১৯:২০, ২৫ জুলাই ২০২০

কক্সবাজার সৈকতের সব বর্জ্য স্থানীয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা সামুদ্রিক কচ্ছপের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। কারও হাত নেই, কারও নেই পা। সাগরে ছেড়ে দিলেও যেতে পারে না; ঢেউয়ে ঢেউয়ে আবার ফিরে আসে সৈকতে। আহত কচ্ছপগুলোর মধ্য থেকে দুটোকে কৃত্রিম লবণাক্ত ডোবা তৈরি করে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর চেষ্টা চলছে। অঙ্গহীন হলেও ওরা এখনও প্রাণে বেঁচে আছে। প্রখ্যাত বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ তার সরেজমিন অভিজ্ঞতায় বলেন, সম্প্রতি আমি ৪টি মৃত কচ্ছপ পেয়েছি। এমনকী সৈকতের যে কুকুরগুলো আছে তারা কচ্ছপ ধরে ধরে খাচ্ছিল। বনবিভাগ, পরিবেশ বিভাগ সবাই উদাসীন। কেউ এগুলোর কোন খবর নেয়নি। কুকুরের খাবারের শিকার হয়ে যে কয়েকটা কচ্ছপ মারা গেছে আমি কয়েকটাকে বিচের বালি গর্ত করে বালিচাপা দিয়েছি। একটা মৃত ডলফিন পেয়েছি; হাঙর পেয়েছি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে বলা হয়েছে বিদেশী জাহাজ হাজার হাজার টন বর্জ্য বাংলাদেশি সমুদ্রসীমায় ফেলে দিয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো সরেজমিন কাজ করে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও পর্যবেক্ষণের আলোকে বুঝলাম স্থানীয় কক্সবাজারের বর্জ্যই সমুদ্রে ফেলা হচ্ছে। ওনারা কী তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এমন কথা বললেন? তিনি বলেন, ‘যেসব বোতল ভেসে এসেছে তার প্রায় সবই বাংলাদেশী কোম্পানির। আর সঙ্গে যেগুলোকে বিদেশী বলা হচ্ছে থাইল্যান্ড বা মিয়ানমার- এগুলো সব বাংলাদেশে পাওয়া যায়। কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেটে এগুলো বিক্রি করে। কক্সবাজারে শুধু শত শত দোকান নয়; শত শত বার্মিজ মার্কেট রয়েছে।’ তিনি বলেন, সম্প্রতি পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, বিদেশী একটা জাহাজ কয়েক হাজার টন বর্জ্য আমাদের দেশের সমুদ্রসীমানায় ফেলেছে। সেই বর্জ্য ও মাছ ধরার জালের সঙ্গে সামুদ্রিক সাপ আর কচ্ছপ উঠে আসে সৈকতে। কিন্তু আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে- সেটা হলো এই সংবাদটা নিছক ভুয়া এবং বানোয়াট। কারণ আমি গত সাতদিন ধরে এগুলো নিয়ে কাজ করছি। সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা শতকরা ৯০ শতাংশ প্রোডাক্ট হচ্ছে আমাদের দেশের। বাটার সেন্ডেল, সানলাইটের গ্যাস লাইট থেকে শুরু করে সব হচ্ছে আমাদের দেশের জিনিসপত্র। আর বাকি যে শতকরা ১০ শতাংশ আছে সেগুলো হলো বার্মিজ এবং থাইল্যান্ডের জিনিস। এই জিনিসগুলো তো কক্সবাজারের বার্মিজ মার্কেটে কিনতে পাওয়া যায়।’ তিনি বলেন, আমার ধারণা সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা সব পণ্যই বাংলাদেশী এবং কক্সবাজার শহরের যে বর্জ্য সমুদ্র ফেলে দেয়া হয় তা। সেগুলোই আবার ভেসে চলে আসছে সৈকতে। এখানে কক্সবাজারে এত ফাইভস্টার হোটেল রয়েছে। হাজার হাজার শুধু মদের বোতল বর্জ্য আকারে কোথায় যায়। স্থানীয় পরিবেশকর্মী বিশ্বজিৎ সেন বাঞ্চু সাগরে বর্জ্য ভেসে আসার কারণ সম্পর্কে বলেন, বর্জ্য সাগরের নয়; মনুষ্য সৃষ্টি। জাহাজ-নৌকা থেকে অহরহ সাগরে বর্জ্য ফেলা হয়। এছাড়াও পাহাড়ী ঢল নামলে শহরের বর্জ্য ভেসে সমুদ্র গিয়ে পড়াসহ কিছু কারণ রয়েছে। জোয়ার এলে সেই অতিরিক্ত বর্জ্যগুলো বিচে ভেসে আসে। ‘কচ্ছপ উদ্ধার’ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি প্রথম দিন নিজে আমার ফার্মের কর্মচারীদের নিয়ে ময়লাগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা আহত ২১টা সামুদ্রিক কাছিম উদ্ধার করে পুনরায় সমুদ্রে ফেরত পাঠিয়েছি। আমরা যেগুলো পেয়েছি তার মধ্যে দুটি জালে আটকা ছিল। সে দুইটাকে আমি জাল কেটে বের করেছি। আর অবশিষ্ট ১৯টি কাছিম বিচে পড়ে ছিল। কোনোটা উপুড় হয়ে পড়েছিল, কোনোটা আহত হয়ে পড়েছিল; কোনটার সামনের ডান-পা নেই; কোনটার সামনের বাম-পা বিচ্ছিন্ন; কোনটার আবার পেছনের একটা পা নেই। তিনি বলেন, ‘এই কচ্ছপগুলোকে যখন আমরা সাগরে ফেরতে দিই এর মধ্যে ৬ থেকে ৮টা কচ্ছপ আবার পানিতে ভেসে সৈকতে এসেছে। কারণ সাঁতার কাটার মতো শারীরিক ক্ষমতা এদের নেই। কারণ ওর সামনের হাত-পাই যদি না থাকে তাহলে কী দিয়ে সাঁতার কাটবে? এভাবে ওরা পানির ঢেউয়ে আবার ভেসে এসেছে। ’ সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলো কথা উল্লেখ করে আদনান বলেন, শত শত স্থানীয় মানুষ ওর ভেতর থেকে মদের বোতল, দামী জিনিসপত্র কুড়াতেই ব্যস্ত। তাদের সামনে যে কচ্ছপগুলো এভাবে উল্টে পড়ে আছে বা তাদের পায়ের সামনেও পড়ে আছে; একটা মানুষের একবারও মনে হয়নি যে, কচ্ছপগুলোকে নিয়ে একটু পানিতে ছেড়ে দেই। ’ তবে কক্সবাজারের একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’ নাম; ওরা বেশ কিছু কচ্ছপ উদ্ধার করেছে। ওরা আলাদা সাইডে করেছে; আমি আলাদা সাইডে করেছি; আমার থেকে প্রায় ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের সৈকতে কচ্ছপগুলোকে উদ্ধার করে পুনরায় সমুদ্রে ফেরত পাঠিয়েছেন বলে জানান এ বন্যপ্রাণী গবেষক। এই যে কচ্ছপগুলো এভাবে আহত অবস্থায় এখানে এল- এর দায় কার? বন বিভাগকে বললে বলে এটা পরিবেশ বিভাগের ব্যাপার। পরিবেশ বিভাগকে বললে বলে যারা সমুদ্র গবেষণার সঙ্গে যুক্ত তাদের ব্যাপার। আহত কচ্ছপগুলো সাগরপাড়েই মরে পড়েছিল। আরও অবাক বিষয় হলো- দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের বিচে কচ্ছপ সম্পর্কে নানা তথ্য সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছে সি টার্টেল এলিয়েন নামে একটি সংগঠন। পুরো এলাকাজুড়ে ‘মেরিনলাইফ এ্যালিয়েন্স’ নামে একটি সংস্থার অসংখ্য সাইন বোর্ড থাকলেও কচ্ছপ উদ্ধার কর্মকান্ডে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। যে কচ্ছপ নিয়ে তারা প্রজেক্ট করেছে; সেই একই জায়গায় কচ্ছপগুলো আহত অবস্থায় পানিতে ভেসে চলে এলো- এখন তারা নীরব কেন? নাকি এই প্রজেক্ট থেকে আর্থিক নানান সুযোগ-সুবিধা নিতেই থাকবে? নিজেদের এছাড়া কোন দায়িত্ব নেই। সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ স্থানীয় সামাজিক কর্মীদের নিয়ে সম্প্রতি সৈকতের সমস্ত বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। সৈকতের নাজিরারটেক পয়েন্ট থেকে হিমছড়ি পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় বারো কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পড়ে থাকা বর্জ্য পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমাদের এ কার্যক্রম আগামীতেও অব্যাহত থাকবে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন আরও বলেন, জেলেদের সাগরে ফেলে দেয়া কারেন্ট জালসহ অন্য নেটে জড়িয়ে সাগরের কচ্ছপগুলোর এই অবস্থা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম হাতে নেব। যাতে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে।
×