ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাবা-মায়ের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ১৬ জুলাই ২০২০

বাবা-মায়ের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী থেকে ॥ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দেশের প্লেব্যাক সম্রাট ন্ড্রু কিশোর। নয়দিন হিমঘরে থাকার পর বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহীর স্থানীয় খ্রীস্টানদের কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে। সঙ্গীতের টানে রাজশাহী ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন রাজধানীতে। কিন্তু কখনও জন্মস্থান রাজশাহীর কথা ভোলেননি। ছিলেন রাজশাহীর মাটি ও মানুষের সংস্পর্শেই। যখনই সময় পেয়েছেন, ছুঁটে এসেছেন রাজশাহীতে। তার শেষ ইচ্ছে ছিল রাজশাহীর মাটিই যেন হয় তার শেষ ঠিকানা। তাই তার শেষ ইচ্ছেই বাবা-মায়ের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো এই কণ্ঠ স¤্র্রাটকে। মৃত্যুর আগে নিজের দেখিয়ে যাওয়া স্থানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। একটি ছোট্ট ক্রিসমাস-ট্রির নিচে এখন চিরনিদ্রায় শায়িত এন্ড্রু কিশোর। আর কোনদিনই তার কণ্ঠে শোনা যাবে না, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো ওগো মাটি, এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না, আমি ওই না ঘরে থাকতে একা পারবো না গো পারবো না...।’ অথবা ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ ইত্যাদি হৃদয়স্পর্ষী গান। তবে তিনি তার গানে অমর হয়ে থাকবেন দেশের কোটি মানুষের প্রাণে। সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গত ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহী মহানগরীর মহিষবাথান এলাকায় থাকা বড় বোন ডাঃ শিখা বিশ্বাসের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশের প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। এরপর তার মরদেহ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। ছেলে-মেয়ের অপেক্ষায় ১৫ জুলাই এন্ড্রু কিশোরের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ করে পরিবার। বুধবার সকাল ৯টার পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হিমঘর থেকে কফিনে করে সিটি চার্চে নিয়ে আসা হয় দেশবরেণ্য এই সঙ্গীত শিল্পীর মরদেহ। সেখানে প্রার্থনা শেষে রাজশাহী সিটি চার্চের বাইরে কিছু সময়ের জন্য রাখা হয় কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কফিন। সর্বসাধরণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য সামনেই তৈরি করা হয়েছিল অস্থায়ী মঞ্চ। সেখানে বেলা ১১টা পর্যন্ত রাখা হয়েছিল এন্ড্রু কিশোরের মরদেহবাহী কফিন। এর ওপর সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। প্রথমেই শ্রদ্ধা জানান, রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান। এছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী শ্রদ্ধা জানান। রাজশাহী সিটি চার্চে প্রার্থনা ও শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তার মরদেহ সমাহিত করার জন্য পাশেই থাকা সমাধিস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাকে সমাহিত করা হয়। শিল্পীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বরিশাল থেকে ফাদার বিশপ সৌরভকে নিয়ে আসা হয়েছিল শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য। বেলা পৌনে ১১টা পর্যন্ত চলে এই প্রার্থনা অনুষ্ঠান। এরপর কিছুক্ষণের জন্য চার্চের বাইরে তৈরি করা একটি মঞ্চে রাখা হয় সকলের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। শেষ বিদায়ের ওই মঞ্চটি স্ত্রী-সন্তানরা নিজ হাতে করেছিলেন। এরপর রাজশাহী শহরের কাজিহাটায় থাকা বাংলাদেশ চার্চের সিমেট্রিতে শিল্পীর পছন্দের স্থানেই তাকে সমাহিত করা হয় বেলা ১২টা ১০ মিনিটে। এ সময় রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান তার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। রাজশাহী সিটি চার্চের প্রার্থনা ও শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে এন্ড্রু কিশোরের সহধর্মিণী লিপিকা এন্ড্রু, তার বড় মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা, ছেলে জয় এন্ড্রু সপ্তক, বড় বোন ডাঃ শিখা বিশ্বাস, বড় বোনের স্বামী ডাঃ প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, ভক্ত অনুরাগী ছাড়া এন্ড্রু কিশোরের শুভাকাক্সক্ষীরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে চার্চে দু’ঘণ্টার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার এবং রাজশাহী কলেজ শহীদ মিনারে তার মরদেহ রাখার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতিতে ঘাটতি থাকায় এবং করোনা পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে শিল্পীর মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান বাতিল করে পরিবার। এন্ড্রু কিশোরকে যে সিমেট্রিতে সমাহিত করা হলো সেখানে তার বাবা ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মা মিনু বাড়ৈকেও সমাহিত করা হয়েছিল। তবে কিশোরের সমাধি হলো তার দেখিয়ে দেয়া জায়গায়। যেখান থেকে পরিবারের সদস্যদের সমাধি পাশেই। শিল্পীর বড় বোনের স্বামী ডাঃ প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাস বলেন, ‘প্রতি বছর ১ নবেম্বর খ্রীস্টানরা সমাধিস্থলে যান এবং প্রয়াত স্বজনদের আত্মার মুক্তির জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন। ২০১৭ সালের এমন এক দিনে এন্ড্রু কিশোর আমাকে নিয়ে সিমেট্রিতে গিয়েছিল। প্রার্থনা শেষে সিমেট্রিটা ঘুরে দেখেছিল। পরে একটা মনোরম স্থান পছন্দ করে আমাকে বলেছিল যে, সে যখন মারা যাবে, তখন যেন তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয়। সেই জায়গাতেই তার সমাধির ব্যবস্থা করা হয়। সিমেট্রিতে ঢুকে হাতের বা পাশেই সেই জায়গা। শেষ ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানিয়ে সেখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে তাকে। আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় একসঙ্গে মোমবাতি প্রজ্ব¡ালন করা হয়।’ রাজশাহীতে জন্ম নেয়া এন্ড্রু কিশোর প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এই শিল্পী ক্যান্সারে ভুগছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে তিনি সিঙ্গাপুরেই ছিলেন চিকিৎসার জন্য। কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি চিকিৎসার পরও দ্বিতীয় দফায় তার দেহে ক্যান্সার বাসা বাঁধে। ফলে চিকিৎসকরা হাল ছেড়ে দেন। তাই শিল্পীর ইচ্ছায় তাকে দেশে আনা হয় গত ১১ জুন। এরপর ২০ জুন তিনি রাজশাহীতে বড় বোনের বাসায় গিয়ে ওঠেন। ওই বাড়িটির একটি অংশেই রয়েছে ক্লিনিক। সেখানেই জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত সেবা চলছিল এন্ড্রু কিশোরের। প্রিয় এই শিল্পীকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন রাজশাহী-২ আসনের এমপি ফজলে হোসেন বাদশা, রাজশাহীর বিভিন্নœ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও শিক্ষকরা। ঢাক থেকে এন্ড্রু কিশোরকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছিলেন জনপ্র্রিয় সুরকার ইথুন বাবু। এন্ড্রু কিশোরের নামে সড়ক ও সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা মেয়র লিটনের ॥ বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী প্লে-ব্যাক স¤্র্রাট এন্ড্রু কিশোরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। বুধবার দুপুরে খ্রীস্টানদের কবরস্থানে এন্ড্রুু কিশোরের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান মেয়র। শ্রদ্ধা জানানো শেষে রাসিক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন সাংবাদিকদের বলেন, গুণী শিল্পীর জন্য আমাদের যা করণীয়, তা করা অবশ্যই উচিত। এন্ড্রু কিশোরের নামে শুধু রাজশাহী নয়, ঢাকাতেও সঙ্গীত চর্চাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করা যেতে পারে। এজন্য করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে আমি ঢাকায় গিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। মেয়র আরও বলেন, আমি মেয়র হিসেবে রাজশাহীতে এন্ড্রু কিশোরের নামে একটি সড়কের নামকরণ ও একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, আমি ও স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ভাই আমরা দু’জনে মিলে এন্ড্রু কিশোরের রাষ্ট্রীয় পদক পাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করব। এ বিষয়ে আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না।
×