ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বাতাসে এক ঘণ্টারও বেশি সময় সংক্রামক হিসেবে টিকে থাকতে পারে এয়ারকন্ডিশন্ড ঘরে উপসর্গহীন রোগী থাকলেও সংক্রমণের ঝুঁকি আসছে নতুন গাইডলাইন

করোনা কি বায়ুবাহিত?

প্রকাশিত: ২২:২৭, ১৩ জুলাই ২০২০

করোনা কি বায়ুবাহিত?

কাওসার রহমান ॥ কয়েকদিন আগে পর্যন্তও করোনাভাইরাসের উপস্থিতি থাকা কোন সমতলে স্পর্শ করার মাধ্যমেই কেবল কোভিড-১৯ সংক্রমণ হতে পারে বলে ধারণা করছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শুরুর দিকে ধারণা করা হতো, হাঁচি বা কাশির ফলে ছড়ানো ড্রপলেটের (ক্ষুদ্রকণা) মাধ্যমেই করোনাভাইরাস ছড়ানো সম্ভব। সে কারণেই মহামারীর শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা কোভিড-১৯ থেকে সুরক্ষার জন্য হাত ধোয়াকে অন্যতম একটি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু এ্যারোসল বিজ্ঞানীদের ভয়ানক গবেষণা তথ্যে এখন নড়েচড়ে বসেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। তারা স্বীকার করে নিয়ে বলছেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাসের ‘বায়ুবাহিত সংক্রমণের’ আশঙ্কা থাকতে পারে। হু’র ওই স্বীকারোক্তির পরপরই ইমপেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরোলজির চেয়ারম্যান অধ্যাপক উইন্ডি বারক্লে বলেছেন, নোভেল করোনাভাইরাসের কণা বাতাসে এক ঘণ্টা ধরে সংক্রামক হিসেবে টিকে থাকতে পারে। রবিবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি নিয়ে নতুন এ তথ্য জানিয়েছে তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে যে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগের বিস্তারে ভূমিকা রাখতে পারে বায়ুবাহিত রুট। তিনি বলেন, অবশ্যই, করোনা বিস্তারের আরও অন্যান্য রুট রয়েছে। তবে নতুন এই স্বীকারোক্তির অর্থ হচ্ছে- সম্ভবত কিছু পরিস্থিতিতে এই রুটে বাতাসের মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। বারক্লে বলেছেন, ভাইরাসটি বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে। এমনকি কোনও ব্যক্তি নিঃশ্বাস ছাড়লে তার থেকে কিছু দূর পর্যন্ত এই ভাইরাসটি ভেসে চলতে পারে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষায় দেখা গেছে, নোভেল করোনাভাইরাস বাতাসে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সংক্রামক হিসেবে টিকে থাকতে পারে। তাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পরিবর্তে বদ্ধ ঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা করাটাই ভাইরাসের বিস্তার রোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে মানুষের ভিড় বেশি, ঘর বন্ধ কিংবা যেখানে বাতাস চলাচলের ভাল ব্যবস্থা নেই- সেসব জায়গায় বাতাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না, এমন কথাই এখন বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বা কথা বলার সময় মুখ থেকে বের হওয়া অতি ক্ষুদ্র কণার মাধ্যমেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে। আর এই ধরনের সংক্রমণের প্রমাণ সম্পর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে বদ্ধ জায়গায় কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, সেই সংক্রান্ত গাইডলাইনে পরিবর্তন আসতে পারে। রোজই বাড়ছে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা, নতুন করে আক্রান্ত অঞ্চলে শুরু হয়েছে লকডাউন। এরইমধ্যে বিশ্বের কিছু সেরা চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্রের এ্যারোসল বিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে এই ভয়ানক তথ্য। তাদের আশঙ্কা, বিশ্বজুড়ে ত্রাস সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯ ভাইরাস বাতাসে ভেসে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত। ভার্জিনিয়ার এ্যারোসল বিশেষজ্ঞ লিন্ডসে মারসহ ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী এই মর্মে এক খোলা চিঠি লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানকে। বিজ্ঞানীদের এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্ব মহামারী ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে নতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা। কিন্তু তা হলে এতদিন ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেসব নিয়ম জারি করেছেন তা কি সঠিক নয়? প্রশ্ন তুলছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞরা। ড্রপলেট সংক্রমণ বাতাস দিয়েই ছড়িয়ে পড়ে। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই এই কথা বলে আসছেন তারা। হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় যে ড্রপলেট নিঃসৃত হয় তা বাতাসে ভেসে কিছু দূর পর্যন্ত যায় এ কিন্তু কোনও নতুন কথা নয়। ড্রপলেট হল মানুষের মুখ বা শ্বাস নিঃসৃত স্যালাইভা যার মধ্যে নানান ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা ফাঙ্গাস থাকে। খালি চোখে এই ড্রপলেট দেখা যায় না। কোভিড-১৯ ভাইরাস আক্রান্তদের শ্বাসপ্রশ্বাস, কথা বলা বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই অদৃশ্য ড্রপলেট বাতাসে মিশে যায়। সুস্থ মানুষের শ্বাসের সঙ্গে জীবাণুরা শ্বাসনালীতে প্রবেশ করলে তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়েন। চীনের উহানে নোভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানার সময় থেকেই এই ড্রপলেটের মাধ্যমে অসুখ ছড়িয়ে পড়ার কথা বলা হয়। তবে তিন ফুট বা ছয় ফুটের কথা বলে মানুষকে সঠিক তথ্য জানানোর ব্যাপারে কিছু ত্রুটি আছে। কেননা ড্রপলেট কত দূর বাতাসে ভেসে যেতে পারে বা কতক্ষণ বেঁচে থাকে সে বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা করে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা উচিত ছিল। এয়ার বোর্ন ভাইরাস ঠিক কী ॥ বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোনও ভাইরাস যদি কোনভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে তাকে এয়ার বোর্ন ভাইরাস বলা যায়। এইচআইভি ভাইরাস এই পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু হাম, অর্থাৎ মিসল ভাইরাস এয়ার বোর্ন। কেননা এই জীবাণুরা প্রায় ২ ঘণ্টা বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে। তেমন কণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বায়ুবাহিত সংক্রমণ হয়ে থাকে। অতি ক্ষুদ্র এসব ড্রপলেট বড় পরিসরের জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে, কোভিড-১৯ আরএনএ ভাইরাস যে বাতাসে ভেসে বেশি দূর যেতে পারে না সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত। কিন্তু তারা প্রমাণ পেয়েছেন, অতিমারী সৃষ্টিকারী ভাইরাস বাতাসে প্রায় তিন ঘণ্টা সক্রিয় থাকে। আর এই তথ্যই ভাঁজ ফেলেছে এ্যারোসল বিজ্ঞানীদের কপালে। সেই কারণেই চিকিৎসকেরা নোভেল করোনা রুখতে নতুন স্ট্র্যাটেজি তৈরির কথা চিন্তা করছেন। বাতাসে কতক্ষণ এটি টিকে থাকে ॥ গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিমভাবে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া করোনাভাইরাস তিন ঘণ্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে এই পরীক্ষাটি ল্যাবরেটরিতে করা হয়েছে, আর বাস্তব জীবনে পরিস্থিতি ল্যাবরেটরির চেয়ে ভিন্ন হতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাই বাস্তব জীবনে ভাইরাস বেঁচে থাকার সময়ে তারতম্য হতে পারে। বাতাসের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোকে ‘সুপারস্প্রেডিং’ হিসেবে বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের মাউন্ট ভারমন শহরে একজন নারী ৪৫ জনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই নারী সংক্রমিতদের সঙ্গে একই গায়ক দলের অংশ হয়ে অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিলেন। সংক্রমিতদের মধ্যে অনেকেই সামাজিক দূরত্ব মানা সংক্রান্ত কোন নিয়ম ভাঙ্গেননি। চীনের গুয়াংজুতে জানুয়ারিতে একই ধরনের একটি ঘটনার কথা জানা যায়। ওই ঘটনায় একজন ভাইরাস বহনকারী ব্যক্তি রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে নয়জনকে সংক্রমিত করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ওই ঘটনায় সংক্রমিতদের একজন ভাইরাস বাহকের চেয়ে ছয় মিটার দূরে অবস্থান করছিলেন। এ্যারোসল আর ড্রপলেট তফাৎ শুধু আকারে ॥ বাতাস বাহিত হয়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে এ্যারোসল আর ড্রপলেটের প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্ক চলছে। আসলে দু’টি একই বস্তু, এপিথেলিয়াল কোষে ভেসে বেড়ানো জীবাণু। ড্রপলেটের আকৃতি এরোসলের থেকে বড়, তাই এর সংক্রমণ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে ড্রপলেট আকারে বড় বলে সংক্রমিত মানুষের হাঁচি-কাশি বা কথা বলার সঙ্গে দ্রুত নিচের দিকে নেমে যায়। আর এই কারণেই মহামারীর শুরুতে মানুষে মানুষে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, সংক্রমিত মানুষের উপসর্গ না থাকলে এবং হাঁচি-কাশি ছাড়াও তিনি রোগ ছড়াতে পারেন। বদ্ধ ঘরে বা এয়ার কন্ডিশনড ঘরে কোনও উপসর্গহীন রোগী থাকলেও তার মারফত অন্যদের সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি। সত্যি কথা বলতে কি ড্রপলেট বাহিত আর এ্যারোসল বাহিত এই দুটির বিশেষ তফাৎ নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, রাস্তায় কোনও কোভিড আক্রান্ত মানুষের যদি হাঁচি কাশি হয় এবং রাস্তার অন্যপ্রান্তে থাকা মানুষটি যদি তার থেকে সংক্রমিত হন তাহলে কখনোই ফুট বা ইঞ্চি দিয়ে ভাইরাসের এ্যারোসল বা ড্রপলেটে ভেসে বেড়ানোর ব্যাপারটা বেঁধে দেয়া ঠিক নয়। বদ্ধ রেস্তরাঁয় গিয়ে এভাবেই চীনের একটি পরিবারের সদস্যরা কোভিড আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে বাতাসে নোভেল করোনাভাইরাস উড়ে বেড়াচ্ছে এমন কোনও প্রমাণ বিজ্ঞানীদের হাতে নেই। দুই শতাধিক বিজ্ঞানীর চ্যালেঞ্জ ॥ দুই শতাধিক বিজ্ঞানীর চ্যালেঞ্জের মুখে গত ৯ জুলাই প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনায় স্বীকার করা হয়, কোভিড-১৯ এর কিছু বায়ুবাহিত সংক্রমণের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এখনই করোনাভাইরাসকে চূড়ান্ত অর্থে বায়ুবাহিত রোগ বলে ঘোষণা দিতে রাজি নয় তারা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মনে করছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে জরুরী ভিত্তিতে আরও গবেষণা করতে হবে। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলে স্বাস্থ্যবিধির গাইডলাইনেও পরিবর্তন আনবে তারা। সম্প্রতি ৩২টি দেশের ২৩৯ জন বিজ্ঞানী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে একটি উন্মুক্ত চিঠি লেখেন। সেখানে বায়ুবাহিত সংক্রমণের বিষয়টিকে মাথায় রেখে করোনাভাইরাস গাইডলাইন হালনাগাদ করার আহ্বান জানান তারা। ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করা রসায়নবিদ এবং কোলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোসে জিমেনেজ বলেন, ‘এমন না যে এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিরুদ্ধে আক্রমণ। এটি একটি বৈজ্ঞানিক বিতর্ক। আমরা এটি জনসম্মুখে নিয়ে এসেছি, কারণ আমাদের মনে হয়েছে বেশ কয়েকবার বলার পরও তারা আমাদের কথা শুনছে না।’ এর আগে গত ৭ জুলাই জেনেভায় প্রেস ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণবিষয়ক টেকনিক্যাল প্রধান বেনেডেত্তা এ্যালাগ্রাঞ্জি বলেন, করোনাভাইরাসের বায়ুবাহিত সংক্রমণের প্রমাণ হাজির হচ্ছে তবে এখনও তা চূড়ান্ত নয়। তিনি বলেন, জনসমাগম স্থলে নির্দিষ্ট পরিবেশে, অতিরিক্ত মানুষ, বদ্ধ, আলো-বাতাস প্রবেশের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকার মতো পরিবেশে বায়ুবাহিত সংক্রমণের বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও এখন প্রমাণ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। এরপর ৯ জুলাই প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন সংক্রমণ নির্দেশনায় বলা হয়, রেস্তরাঁ, ফিটনেস ক্লাসের মতো কিছু কিছু আবদ্ধ জনাকীর্ণ জায়গায় করোনায় সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। এগুলো এ্যারোসল ট্রান্সমিশন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো দ্রুত তদন্ত করার পাশাপাশি তা কোভিড-১৯ ছড়ানোর ক্ষেত্রে কতটা ভূমিকা রাখছে তাও মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আর এই ধরনের সংক্রমণের প্রমাণ সম্পর্কে যদি নিশ্চিত হওয়া যায়, তাহলে বদ্ধ জায়গায় কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, সেই সংক্রান্ত গাইডলাইনে পরিবর্তন আসতে পারে। নতুন নির্দেশনা মোতাবেক মানুষের উচিত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি ভিড় এড়িয়ে চলা এবং ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখা। এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শুধু স্বীকার করেছিল, সুনির্দিষ্ট মেডিক্যাল প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস। ভার্জিনিয়া টেক-এর এ্যারোসল বিশেষজ্ঞ লিনসে মার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে ওই প্রতিবেদনটি দিতে উৎসাহিত করেছিলেন। তবে খোদ লিনসে মারও এখন মনে করেন, বাতাসের মাধ্যমে করোনা ছড়ানো সম্ভব। লিনসে মনে করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ্যারোসল ও ড্রপলেটের পুরনো একটি ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করছে। তারা ড্রপলেটের আকার এবং কতটুকু তারা যেতে পারে তার ওপর বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। সংস্থাটির দাবি, এ্যারোসল হলো যেসব কণার আকার ৫ মাইক্রনের নিচে। একমাত্র ছোট কণাগুলোই বাতাসে অনেক্ষণ ভেসে থেকে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে বলে মনে করে তারা। তবে লিনসে মনে করেন, এর চেয়ে বড় কণাও সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াবাহিত যেসব কণা বাতাসে কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে, তেমন কণা নিশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করার মাধ্যমে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার বায়ুবাহিত সংক্রমণ হয়ে থাকে। অতি ক্ষুদ্র এসব ড্রপলেট বড় পরিসরের জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে থাকতে পারে। বায়ুবাহিত রোগের উদাহরণ হলো যক্ষ্ম, ফ্লু এবং নিউমোনিয়া। তবে লিনসেসহ অন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আকার নয়, বরং কিভাবে সংক্রমণ ছড়াল তার ভিত্তিতে ড্রপলেট ও এ্যারোসলের মধ্যে পার্থক্য করা উচিত। কোনও ভাইরাস যদি শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় ব্যক্তির দেহে প্রবেশ করে, তবে তা এ্যারোসল। আর তা যদি আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার কারণে ছড়ায় তবে তা ড্রপলেট। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এ্যান্থনি ফাউচি ৯ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সার্স কভ-২ বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর প্রচুর প্রমাণ এখনও নেই। তবে আমি মনে করি, বাতাসের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়ানোর ধারণা করাটা যৌক্তিক।’ তা হলে কোভিড এড়াতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে ॥ একটি রোগ যেভাবে সংক্রমিত হয়, তার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয় সেটির সংক্রমণ কীভাবে থামানো যাবে। কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বর্তমান গাইডলাইনে অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ছাড়াও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীদের অনেকে এখন বলছেন, এই কাজগুলো জরুরী হলেও বাতাসে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দিতে শুধু এই পদক্ষেপগুলোই যথেষ্ট নয়। নোভেল করোনা প্রতিরোধ করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ হলো- ১. মাস্ক ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। নাক-মুখ ঢেকে মাস্ক পরতে হবে। কাপড়ের তিন লেয়ার মাস্কই যথেষ্ট। স্বাস্থ্যকর্মীদের এন ৯৫ মাস্ক বাধ্যতামূলক। বাড়িতে কাছের মানুষদের সঙ্গে থাকলে মাস্ক পরার দরকার নেই। তবে বাড়ির কোনও মানুষের সংক্রমণ হলে সকলেরই উচিত মাস্ক পরা ও অন্যদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা। ২. নিয়মিত মাস্ক পরিষ্কার করা উচিত। ৩. শপিং মল, বাজার, দোকান বা সুপার মার্কেটে না যাওয়াই ভাল। ৪. বদ্ধ ঘরে থাকবেন না। অফিসে গেলে যথাযথ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মেনে চলার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। অফিসে এয়ার পিউরিফায়ার এবং ভাইরোলজিক্যাল ফিল্টার থাকলে ভাল হয়। ৫. টি জোন, অর্থাৎ চোখ, নাক ও মুখে হাত দেবেন না। হাত দেয়ার দরকার পড়লে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে নিতে হবে। কিংবা সাবান দিয়ে ভাল করে ২০ সেকেন্ড ধরে রগড়ে হাত পরিষ্কার করে ধুয়ে নিন। ৬. পাবলিক টয়লেটের বদ্ধ বাতাসে এ্যারোসলে ভাইরাস থাকার ঝুঁকি খুব বেশি। তাই ব্যবহার করবেন না। ৭. বাড়ির জানলা-দরজা খোলা রেখে বাতাস চলাচল করতে দিন। ৮. মিটিং, মিছিল বা জমায়েতে এ্যারোসল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি। এই সব জমায়েত নিষিদ্ধ করা দরকার। ৯. নিজেরা সচেতন না হলে দুর্ভোগ হবে নিজের ও পরিবারের মানুষদের, সুতরাং ফাঁকি না দিয়ে যথাযথ নিয়ম পালন করে কোভিডের মহামারী রুখুন।
×