ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিতীয় দফায় ২৩ জেলা কবলিত হতে পারে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক প্রস্তুতি প্রধানমন্ত্রী বন্যা উপদ্রুত জেলাগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন

আসছে ভয়াবহ বন্যা

প্রকাশিত: ২২:৪১, ১২ জুলাই ২০২০

আসছে ভয়াবহ বন্যা

শাহীন রহমান ॥ কঠিন সময় মোকাবেলা করছে দেশ। দুর্যোগের ধকল যেন কাটছেই না। গত মার্চ থেকে শুরু হয়েছে করোনা মহামারী। এর প্রাদুর্ভাবের প্রভাব পড়েছে দেশের সব সেক্টরে। লোকজন চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ছেন। এর মধ্যেই ধকল সইতে হয়েছে ঘূর্ণিঝড় আমফানের। তার রেশ এখনও রয়েছে। সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় অনেক এলাকা এখনও পানির নিচে। এই অবস্থার মধ্যে বন্যার ধকল শুরু হয়েছে। গত ২ সপ্তাহ ধরে বন্যায় ভাসছে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। বন্যায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। এর মধ্যেই দেশে আবারও ভয়াবহ বন্যার আভাস দেয়া হয়েছে। করোনা, আমফান ও বন্যার ধকলে এখন বিপর্যস্ত দেশ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী এই সপ্তাহেই বড় ধরনের বন্যার কবলে পড়তে যাচ্ছে দেশ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেছেন, দ্বিতীয় দফায় ২৩ জেলা বন্যার কবলে পড়তে পারে। বন্যা এবার দীর্ঘস্থায়ী হবে। তিনি জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ইতোমধ্যে সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রত্যেক জেলায় ২শ’ টন চাল, ৫ লাখ টাকা, ২ লাখ টাকা শিশু খাদ্যের জন্য, ২ লাখ টাকা গবাদিপশুর জন্য এবং ২ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট পাঠানো হয়েছে। পানি বাড়লেও মাঠ প্রশাসন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যেন জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারে। ২৩ জেলায় আশ্রুয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজকে আশ্রয় কেন্দ্রে হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। করোনায় সামাজিক দূরত্ব এবং মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এদিকে প্রথম থেকেই এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ শক্ত হাতে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে এ বছরের শুরুতেই একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানতে শুরু করে। করোনা ইতোমধ্যে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। এর কবলে পড়ে প্রায় কোটি মানুষ এখন বেকার হয়ে পড়ছে। অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে করে দিচ্ছে। এর মধ্যে উপকূলীয় জেলা ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। এলাকার বহু মানুষ এখন জোয়ারের পানির মধ্যে পড়ে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে বন্যার আঘাত। উত্তরাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ বন্যায় প্লাবিত হয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। প্রথম দফার রেশ কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় দফায় আবারও বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছেন। তারা বলছেন, সরকার প্রথম থেকে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ শক্ত হাতে মোকাবেলা না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই বলেছেন, করোনা বিপর্যয় মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তিনি দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সরকারের পক্ষ থেকেও বন্যা মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বন্যা উপদ্রুত জেলাগুলোকে দেখভাল করার জন্য উর্ধতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। করোনা মহামারীর মধ্যেই এবার স্বাভাবিক সময়ের আগেই দেশের উত্তরাঞ্চল বন্যার কবলে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত প্রতিবছর জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে বন্যা দেখা দেয়। কিন্তু উজানে ভারি ঢলের কারণে এবার গত ২৬ জুন তারিখ থেকে বন্যার কবলে পড়েছে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল। এসব এলাকার বন্যা স্থায়িত্ব ২ সপ্তাহ পার হয়েছে। এখনও বন্যার কাক্সিক্ষত কোন উন্নতি হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী প্রথম দফায় দেশের ১৪ জেলা বন্যার কবলে পড়ে। গত ৬ জুলাই থেকে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি থাকে। বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হতে না হতেই দ্বিতীয় দফায় আবারও বন্যার প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী এই দফায় দেশের বন্যার স্থিতি দীর্ঘায়িত হবে। একই সঙ্গে এর বিস্তৃতি হবে বেশি এলাকায়। উপকূলীয় কিছু জেলা বাদে কমবেশি সব জেলায় এবার বন্যা দেখা দিতে পারে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা। এদিকে বন্যা কবলিত এলাকার কয়েক লাখ মানুষ বসতবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট রয়েছে তাদের। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন উঁচু বাঁধের ওপর। করোনার প্রভাবে আগেই বিপর্যস্ত সাধারণ মানুষ। কাজ হারিয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এর ওপর আবার বন্যার আঘাত যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের খাবার জোগাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে গবাদি পশু পাখি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। ফসলের মাঠ এখন পানির নিচে। বেঁচে থাকার স্বপ্ন যেন তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন। দ্বিতীয় দফায় বন্যার আঘাত তাদের জীবন আরও কঠিন করে তুলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, দ্বিতীয় দফায় গত শুক্রবার থেকে বন্যার প্রকোপ শুরু হয়েছে। দেশের সব প্রধান নদ-নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আরিফুজ্জামান ভুইয়া বলেন, ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, নাটোর, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। অপরদিকে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদীসমূহের পানি সমতলে বৃদ্ধি পেতে পারে, যা ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল থাকলেও ২৪ ঘণ্টায় বেড়ে যাবে। ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদ, নুনখাওয়া ও চিলমারী পয়েন্টে যমুনা নদী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি ও কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এ সময় ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেতে পারে এবং বিপদসীমার ওপর দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। অপরদিকে, ধরলা নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আপার মেঘনা অববাহিকার সুরমা নদী সিলেট পয়েন্টে পুরাতন সুরমা নদীর দিরাই পয়েন্টে এবং সোমেশ্বরী নদী, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। তিনি জানান, দেশের ১০১টি পর্যবেক্ষণাধীন পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৬টির, হ্রাস পেয়েছে ৩৩টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ২টি এবং বিপদসীমার ওপরে রয়েছে ৭টির। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। এরপর থেকেই শনাক্তের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে ১ লাখ ৮১ হাজারের বেশি মানুষ করোনায় আক্রান্ত। করোনার প্রভাব কঠোরভাবে মোকাবেলার জন্য সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এরই চাপে দেশে অর্থনীতি ভিত নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার তাগিদে গত ১ জুন থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিস্থিতি অনেকটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে করোনা সঙ্কটে অনেকে কাজ হারিয়েছেন। বাসা ভাড়া টানতে না পেরে অনেকে স্থায়ীভাবে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দিয়েছেন। প্রবাসেও অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরেছেন। জীবন-জীবিকা স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য প্রণোদনাও ঘোষণা করা হয়েছে। শুরু থেকেই সরকার করোনা পরিস্থিতি শক্ত হাতে মোকাবেলা করছে। এর মধ্যে দেশে উপকূলীয় জেলায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আমফান। গত ২০ মে প্রবল শক্তি নিয়ে সুপার সাইক্লোনের আঘাতে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন এলাকা ল-ভ- হয়ে যায়। এর প্রভাবে সারাদেশেই প্রচ- শক্তিতে ঝড়ো হাওয়া বইতে থাকে। ফলে সারাদেশের ওপর এর ক্ষত রেখে যায়। কিন্তু সাতক্ষীরা জেলায় এর ধকল এখনও সামলাতে হচ্ছে। বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এলাকার মানুষকে এখন জোয়ারের পানির সঙ্গে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। তাদের বসতবাড়ি এখন পানির নিচে। বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সরকারী হিসাব অনুযায়ী আমফানের আঘাতে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। করোনাকালে মানুষ যখন জীবন-জীবিকা নিয়ে ভাবছে তখন আমফানের আঘাত তাদের সেই ভাবনাকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। আমফানের ক্ষত এখনও শুকায়নি। এর মধ্যে আবারও বন্যার ধকল এখন দেশকে সইতে হচ্ছে। উত্তরের বহু মানুষ এখন বন্যা আক্রান্ত। এর মধ্যেই দ্বিতীয় দফায় বন্যা শুরু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেছেন, এই দফায় ২৩ জেলায় বন্যা দেখা দেবে। বন্যার স্থায়িত্ব দীর্ঘায়িত হবে। দেশ কঠিন সময় মোকাবেলা করছে। আমরা আমফান মোকাবেলা করলাম, এরপরই আমরা ২৬ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদী বন্যা মোকাবেলা করছি। এদিকে সর্বশেষ বন্যা মোকাবেলার জন্য সরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু করেছে। বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণ তৎপরতার পাশাপাশি বানবাসীদের যাতে কোন ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়, করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেও আশ্রয় কেন্দ্রে প্রস্তুত করা হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বন্যা উপদ্রুত এলাকার সব স্কুল-কলেজ অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য জরুরী ভিত্তিতে তা খুলে দিতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এদিকে বন্যা মোকাবেলায় কাজ শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যাকবলিত জেলাগুলোর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বন্যা মোকাবেলায় যুক্ত হতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণও শুরু হয়েছে। বন্যাকবলিত জেলার জন্য নগদ টাকা ও খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বন্যার্তদের আশ্রয় কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডাঃ এনামুর রহমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা এমন একটি রোগ যার ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। সারাবিশ্বই এখন করোনা মহামারীতে আক্রান্ত। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এর প্রভাব মোকাবেলা ছাড়া কোন উপায় নেই। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এই ভাইরাস আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। সরকার শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাত এবং বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্তমানে কঠিন সময় মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এদিকে দ্বিতীয় দফায় দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি। ফলে বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে। নতুন করে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, নাটোর, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর। কুড়িগ্রাম ॥ অস্বাভাবিকভাবে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমারসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ধরলা ও তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্রুতগতিতে বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য নদ-নদীর পানিও। এসব এলাকার রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙ্গে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানিবন্দী মানুষের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানি বেড়ে নদ-নদীর অববাহিকার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলগুলোতে পানি ঢুকে পড়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সে সব এলাকায় বসবাসকারী মানুষজন। প্রথম দফা বন্যার পানি নেমে যেতে না যেতেই আবারও বন্যার কবলে পড়লে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে তাদের। উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ইউনুছ আলী জানান, বন্যা শেষ না হতেই আবারও বাড়িতে পানি ঢুকে পড়ছে। এমনিতেই অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। আবারও বন্যা দীর্ঘ হলে কষ্টের শেষ থাকবে না। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোঃ রেজাউল করিম জানান, বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। বন্যায় যখন যা প্রয়োজনীয়তা দেখা দিবে তাই করা হবে। গাইবান্ধা ॥ গত তিনদিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে গাইবান্ধায় সবকটি নদীর পানি দ্বিতীয় দফায় আবারও বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। ফলে ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও করতোয়া নদীর পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেয়ে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হচ্ছে এবং জেলার সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলগুলোতে আবারও পানি উঠতে শুরু করেছে। গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ি উপজেলায় অনেক নিচু এলাকায় পানি উঠেছে। প্রথম দফার বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বসতবাড়ি ও সড়কগুলোতে আবার বন্যার পানি উঠতে শুরু করায় বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। এদিকে বন্যার পানিতে আমনের বীজতলা তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছে। এতে আমন বীজের অভাবে বন্যা পরবর্তী আমন চাষ বিঘিœত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। নওগাঁ ॥ কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের পানিতে নওগাঁর ছোট যমুনা ও আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চলগুলো। আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়াই আত্রাইয়ের কাসিয়াবাড়ী ব্রীজ দিয়ে পানি প্রবেশ করে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বড়গাছা ইউপির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত ও পুকুর ডুবে যাওয়ায় ভেসে গেছে মাছ। এছাড়াও ওই এলাকার আমন চাষী কৃষকদের বীজতলা ডুবে গেছে। এতে জনমনে চরম আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। যে কোন সময় উপজেলার নিচু চারটি ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ ॥ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১২ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে যমুনাপাড়ের নিম্নাঞ্চল, দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের কষ্ট বাড়ছে। প্রথম দফায় পানি বৃদ্ধির কারণে বাঁধে আশ্রিত মানুষ এখনও নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেনি। পানি বাড়ার জন্য নিম্নাঞ্চল, দুর্গম চরাঞ্চল ও বাঁধে আশ্রিত ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও গবাদিপশু নিয়ে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। জেলার পাঁচ উপজেলায় প্রায় ৩১ ইউনিয়নের যমুনাপাড়ের মৌসুমি ফসল পাট, ভুট্টা, কাউন, তিল-তিশি, বাদাম ও শাক-সবজি পানিতে ডুবে গেছে। এর পরিমাণ তিন হাজার ৫৬৫ হেক্টর জমির ফসল। এদিকে যমুনার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ করতোয়া, ইছামতি ও বড়াল নদীতেও পানি বাড়ছে। নদী তীরবর্তী ও চরাঞ্চলে ভুট্টা, বাদাম, তিল, কাউন ও সবজি খেত তলিয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে এসব ফসল। সুনামগঞ্জ ॥ বন্যা পরিস্থিতির আবারও অবনতি হয়েছে উজানের পাহাড়ী ঢল ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকার ফলে। সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ এর ষোলঘর পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৪ সে. মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। উজানের ঢল ও ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে সুরমাসহ জেলার নদীগুলোর পানি কূল উপচে হাওড়-জলাশয় টইটুম্বুর করে লোকালয় প্লাবিত হয়েছে আরারও। এ পর্যন্ত জেলার ৮৭ ইউনিয়নের ৮৩ ইউনিয়ন এবং ৪ পৌরসভার ৩৬ ওয়ার্ডের ১৮ ওয়ার্ডের মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। মাত্র ১০/১২ দিন আগের বন্যা পরিস্থিাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে পুনরায় দুর্ভোগ বাড়ি ফেরা বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ। বিভিন্ন স্থানে নতুন করে প্লাবিত হওয়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা দিনে দিনে বড় হচ্ছে বলে বানভাসি মানুষরা জানিয়েছেন। নেত্রকোনা ॥ ভারি বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের কারণে নেত্রকোনার কলমাকান্দায় শনিবার থেকে আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। উপজেলা সদরসহ আটটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এদিকে প্রধান প্রধান নদীগুলোর পানি বিপদসীমা ছুঁইু ছুঁই করছে। দু’দিনের ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে কলমাকান্দা উপজেলার সদর, বড়খাপন, রংছাতি, খারনৈ, নাজিরপুর, কৈলাটি, পোগলা ও লেঙ্গুরা ইউনিয়নের অন্তত ৫০টি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব ইউনিয়নের বেশকিছু গ্রামীণ সড়ক ডুবে চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কলমাকান্দা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনসহ ছাড়াও উপজেলা সদরের থানা রোড, শিবমন্দির, বাসাউড়া, মন্তলা, চানপুর রোড, চত্রংপুর, নয়াপাড়া ও পূর্ববাজারের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। রুদ্রমূর্তিতে তিস্তা ॥ স্টাফ রিপোর্টার নীলফামারী থেকে জানান, তিস্তা এবার প্রচ-ভাবে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করে রাস্তাঘাট ফসলি জমি ও গ্রামের পর গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শনিবার তিস্তার গর্জন ও শোঁ শোঁ শব্দ তিস্তাপাড়ের নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার চর, চরগ্রাম ও লোকালয় কাঁপিয়ে দিয়ে ভাটির দিকে ধাবিত হচ্ছে। দুই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। তাদের মাঝে শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রেখেও উজানের ঢলের চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যেন কঠিন হয়ে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তিস্তাপাড়ের জরুরী অবস্থা ঘোষণা দিয়ে লাল সঙ্কেত জারি করেছে। পাশাপাশি মাইকিং করে তিস্তাপাড়ের পরিবারগুলোকে নিরাপদে আশ্রয় নিতে বলা হয়। শনিবার বিকেলে তিস্তার নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার (৫২.৬০) ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজ (ফ্লাডবাইপাস) এলাকাটি আমরা নজরদারি করছি। তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজ এলাকার উজান ও ভাটি এলাকায় বসবাসকৃত পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তিনি আরও জানান উজান থেকে ভয়াবহ ঢল অব্যাহতভাবে ধেয়ে আসছে। এলাকায় লাল সঙ্কেত ঘোষণা করা হয়েছে। এলাকাবাসী জানায়, উজানের ঢল এবার প্রচ-। ভারতের গজলডোবার স্লুইসগেট খুলে দেয়ার কারণে নীলফামারী জেলার তিস্তা অববাহিকার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার প্রায় ১০ হাজার পরিবারের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। গ্রামের রাস্তাঘাট, বসতঘর ও ফসলি জমির ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৬ ইউনিয়ন, পূর্বছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাঁপানী ও ঝুনাগাছ চাঁপানীর ইউপি চেয়ারম্যানগণ জানান, তিস্তায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। ডিমলার কিছামত ছাতনাই, ঝাড়শিঙ্গেশ্বর, চরখড়িবাড়ি, পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, তিস্তাবাজার, তেলিরবাজার, বাইশপুকুর, ছাতুনামা, ভেণ্ডাাবাড়ি এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেখানকার মানুষজন গরু ছাগল, বাক্সপেটরা নিয়ে নিরাপদে সরে গেছে। অপরদিকে জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি, গোলমু-া, শৌলমারী, কৈমারী এলাকার ২ হাজার পরিবার বন্যাকবলিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় দুই উপজেলার অসংখ্য ফসলি জমির আমন বীজতলা, রোপিত আমনের রোপা তলিয়ে গেছে। বসতঘরগুলোতে প্রকার ভেদে হাঁটু ও কোমড় সমান পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া মাছের খামারগুলোর পুকুর উপচেপড়ায় প্রচুর মাছ ভেসে গেছে। বানভাসীরা জানায়, ঘরে খাদ্য থাকলেও রান্না করার মতো অবস্থা নেই। তাদের এখন শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রচ- সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ডিমলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জয়শ্রী রানী রায় জানান, আমরা প্রতিটি এলাকার মনিটরিং করছি। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে তিস্তা অববাহিকার চর ও চর গ্রামের পরিবারগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। আমরা শুকনা খাবার পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।
×