ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ঢাকা চেম্বারের ২০ দফা প্রস্তাব

প্রকাশিত: ১৭:২২, ১১ জুলাই ২০২০

অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ঢাকা চেম্বারের ২০ দফা প্রস্তাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে ঢাকা চেম্বার ২০ দফা প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করতে গিয়ে ঢাকা চেম্বার বলেছে, চীন থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সুনিদিষ্ট রোডম্যাপ ও কৌশল নেয়া এখনই জরুরি। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত‘ বেসরকারী খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক ওয়েবনার ১১ জুলাই অনুষ্ঠিত হয়। এতে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আয়োজিত এ ওয়েবনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ। এ সময় তিনি দেশের অর্থনীতির ২০টি খাতের বর্তমান অবস্থা ও খাতগুলোর উন্নয়নে সুপারিশ উপস্থাপন করেন। মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, চলমান কোভিড মহামারী পরিস্থিতিতে জীবন-জীবিকার চাকা সচল রাখতে অনেক কঠোর পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হচ্ছে। কোভিডউত্তোর অর্থনৈতিক পুণঃউদ্ধার প্রক্রিয়ায় সরকারের যথাযথ নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার একান্ত অপরিহার্য। এ সময় ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রফতানিমুখী শিল্পের জন্য উৎসে কর কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন। তিনি জানান, এ পরিস্থিতির ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ ১২.৭২ শতাংশ কমেছে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে ২৮৭ কোটি মার্কিন ডলার। ডিসিসিআই সভাপতি চীন হতে বাংলাদেশে বিনিয়োগ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সুনিদিষ্ট রোডম্যাপ ও কৌশল এখনই নেয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, গত অর্থবছরে রফতানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ শতাংশ কম অর্জিত হয়েছে। ডিসিসিআই’র সভাপতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি ফিরে পাওয়া, অশুল্ক বাধাসমূহ দূরীকরণ ও সম্ভাবনাময় অংশীদারদের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, তৈরি পোষাক খাতে উৎসে কর ০.৫ শতাংশ হতে ০.২৫ শতাংশ নামিয়ে আনলে এখাতে রফতানি আরো বৃদ্ধি পাবে। চামড়া খাতের উন্নয়নে তিনি দ্রুত সিইটিপি স্থাপন ও ট্যানারি মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের প্রস্তাব করেন। এছাড়াও কোভিড-১৯ এর কারণে এমএসএমই খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং ব্যাংকগুলো থেকে তারা প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ সুবিধা পাচ্ছেনা, এ অবস্থা উত্তরণে স্বল্প সুদে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ও রিফাইন্যান্সিং স্কিম আরো বেশি হারে বাস্তবায়নে তিনি আহ্বান জানান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, বাজেটে সরকার কর্পোরেট কর সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে সরকার ও বেসরকারী খাত একযোগে কাজ করতে হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, কিছু অসাধু ব্যক্তির অসৎ কাজের জন্য দেশ-বিদেশে আমাদের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে, বিষয়গুলো যেন পুনরায় না হয়, সে বিষয়ে সকলকে মনোযোগী থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, সরকারী সব খাতে কমপ্লায়েন্স হতে হবে এবং গুড গর্ভানেন্স নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কোভিড-১৯ মহামারী নিয়ন্ত্রনে ভিয়েতনামের উদাহরণ উপস্থাপন করে বলেন, এক্ষেত্রে আমরা তা অনুসরণ করতে পারি। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট আইনসমূহের আরো সংষ্কার একান্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং খাতে আরো ডিজিটাইলাইজেশন এখন সময়ের দাবি এবং প্রান্তিক পর্যায়ের জনগনের ব্যাংক হিসাব না থাকায় সরকার কোভিড-১৯ মোকাবেলায় নগদ আর্থিক সহায়তা সকলে মাঝে পৌঁছাতে পারেনি। মন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রথমদিকে আমাদের ধারণা না থাকায় ¯^াস্থ্য খাতে কিছুটা দূর্বলতা ছিল, তবে সময়ের ব্যবধানে আমরা তা কাটিয়ে উঠেছি। তিনি জানান, আশিয়ান অঞ্চলের দেশগুলোতে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়াতে হলে, বাংলাদেশকে আশিয়ানের পর্যবেক্ষক মর্যাদা অর্জন করতে হবে, এছাড়াও তিনি প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে আরো বাণিজ্য সম্প্রসারণের উপর জোরারোপ করেন। তিনি বলেন, কোভিড মহামারী আমাদের তৈরি পোষাক খাতে বিশেষ করে, মেডিকেল টেক্সটাইলে নতুন সুযোগ নিয়ে এসেছে, এবং দেশের বেসরকারী খাতের উদ্যোক্তাদের এ সুযোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ, আনোয়ার গ্রু অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি হোসেন খালেদ, বিল্ড-এর চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি আবুল কাসেম খান এবং চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জ ও ঢাকা চেম্বারের প্রাক্তন সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম অংশগ্রহণ করেন। ড. মাশরুর রিয়াজ কোভিড-১৯-এর ফলে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতি মোকাবেলায টিকে থাকা, স্থিতিশীলতা বজায়ে রাখা এবং অর্থনীতি পুনঃউদ্ধারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ অত্যাবশ্যক বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর ফলে বৈশি^ক চাহিদা ও সাপ্লাই দুটোই উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। তিনি অর্থনীতির এ অবস্থা উত্তরণে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের আহ্বান জানান। মাশরুর রিয়াজ কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট নীতিমালা সমূহের সংষ্কার ও বন্ড মার্কেট আরো কার্যকরের উপর জোরারোপ করেন। হোসেন খালেদ বলেন, ব্যাংক খাত হতে সরকারের বেশি মাত্রায় ঋণ নেওয়ার প্রবনতা বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহকে কমিয়ে দিতে পারে। আমাদের শিল্পখাত বর্তমানে কর্মসংস্থানের সুযোগ ধরে রাখার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এবং এ অবস্থা মোকাবেলায় ব্যাংক ও বেসরকারী খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি পুঁজিবারের উপর সকলের আস্থা বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান এবং পরিবেশ সুরক্ষায় আরো বেশি হারে ‘সবুজ প্রকল্প’ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। আবুল কাসেম খান বলেন, ভুয়া কোভিড সনদ নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার ফলে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুন্ন হয়েছে এবং এ পরিস্থিতি যেন আর বাড়তে না পারে সেজন্য সরকারকে আরো সর্তকতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোরারোপ করেন। তিনি আরো বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর জন্য আমাদের অবশ্যই সহায়ক করা কাঠামা থাকতে হবে, যাকিনা এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে উদাহরণ তৈরি করবে। আসিফ ইব্রাহীম বলেন, বাংলাদেশের জিডিপি ও পুঁজিবাজারের অনুপাত মাত্র ১১.১ শতাংশ, যা তুলনামূলভাবে এশিয়া ও পাশ^বর্তী দেশগুলোর মধ্যে অনেক কম। তিনি দেশের বন্ড মার্কেট আরো কার্যকর করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পসমূহে অর্থায়ন নিশ্চিতকল্পে সেগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। তিনি সকল ব্যাংকসমূহকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানান এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো বেশি হারে ট্রেজারি চালান ক্রয়ের প্রস্তাব করেন। মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি রাশেদ মাকসুদ খান, এমএইচ রহমান, আফতাব-উল ইসলাম, এফসিএ, বেনজীর আহমেদ, সাইফুল ইসলাম এবং মোঃ সবুর খান মতামত ব্যক্ত করেন। রাশেদ মাকসুদ খান বলেন, আমাদের চামড়া খাত অত্যন্ত সম্ভাবনাময়, এটাকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এম এইচ রহমান বলেন, কোভিড-১৯ এর ফলে যদি বেকারত্বের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলে, স্থানীয় বাজারে চাহিদা কমবে, যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আফতাব-উল ইসলাম করদাতাদের উপর আরো করের হার না বাড়িয়ে বরং ট্যাক্সনেট বাড়ানোর প্রস্তাব করেন এবং তিনি বন্ড মার্কেট সম্প্রসারণের উপর জোরারোপ করেন। বেনজীর আহমেদ বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে সেবা ও এমএসএমই খাতে প্রায় ১ কোটির বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হতে পারে। তিনি সকল প্রকার লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া অটোমেশনের আওতায় নিয়ে আসার আহ্বান জানান। সাইফুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারী বাংলাদেশের জন্য ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং তা গ্রহণে আমাদের উদ্যোগী হতে হবে। সবুর খান বলেন, কোভিড-১৯ আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এবং এ খাতের আরো সম্প্রসারণে বাংলাদেশকে এগিয়ে আসার উপর তিনি জোরারোপ করেন।
×