ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিতীয় দফায় বন্যার প্রকোপ শুরু, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

প্রকাশিত: ২২:০০, ১১ জুলাই ২০২০

দ্বিতীয় দফায় বন্যার প্রকোপ শুরু, নিম্নাঞ্চল প্লাবিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দ্বিতীয় দফায় দেশে নতুন করে বন্যার প্রকোপ শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি একদিনের মধ্যে বেড়ে গিয়ে আবারও বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে এই দফায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এবার বন্যার স্থিতি ও পরিধিও আরও বেড়ে যেতে পারে। ইতোমধ্যে উত্তরের নদী তিস্তা চতুর্থবারের মতো বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। অপরদিকে উত্তর পূর্বাঞ্চলের সুরমা নদীর পানি শুক্রবার থেকে ফের বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। ফলে এসব এলাকার নিম্নাঞ্চল নতুন করে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। গত ২৬ জুন থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল মধ্যাঞ্চলে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রায় ১৪ জেলা বন্যা কবলিত। এর মধ্যে গত ৭ ও ৮ জুলাই পানি কমতে শুরু করে। বন্যা পরিস্থিতিরও কিছুটা উন্নতি হয়। কিন্তু পুরোপুরি উন্নতি হওয়ার আগে আবার এসব অঞ্চল বন্যার কবলে পড়ছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে দ্বিগুণ হারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ এনামুর রহমান আগেই জানান এই দফায় দেশের ২৩ জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়তে পারে। তার দেয়া হিসাব অনুযায়ী এবার দেশের ৩৫ ভাগ এলাকা বন্যার কবলে পড়তে পারে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তারা জানান দেশের উপকূলীয় এলাকা বাদে অধিকাংশ জেলায় বন্যা কবলিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বন্যাদুর্গত এলাকার সব স্কুলকলেজ অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য জরুরী ভিত্তিতে তা খুলে দিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। একই সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পাঠাতেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শুক্রবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানিয়েছে মাউশি। বিজ্ঞপ্তিতে বন্যাদুর্গত এলাকায় অবস্থিত মাউশির আওতাধীন সব দফতর ও সরকারী-বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্থানীয় প্রশাসন বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া বন্যার কারণে যদি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে তার তথ্য দিতেও বলা হয়েছে। এদিকে পানি উন্নয় বোর্ডের শুক্রবারের বন্যা সংক্রান্ত এক পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, উত্তরাঞ্চলের তিস্তা-ধরলা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের গাণিতিক আবহাওয়া মডেলের তথ্যানুযায়ী আগামী ৭২ ঘণ্টা দেশের উত্তরাঞ্চলের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের আসাম, মেঘালয়, হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ ও বিহার প্রদেশে ভারি থেকে অতিভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস রয়েছে। ফলে এই সময়ে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও আপার মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। তিস্তা ও ধরলা নদীসমূহের পানি সমতল ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত বেড়ে যেতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদীর পানি সমতল বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। তারা জানায় গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে যা ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। এতে আরও বলা হয় সমতলে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১২টি স্টেশনের মধ্যে পানি বেড়েছে ৫৭টি ও হ্রাস পেয়েছে ৪২টি। অপরিবর্তিত রয়েছে ২টি স্টেশন। এছাড়া বিপদসীমার উপরে রয়েছে ৪টি। তারা জানায় দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে গত দুদিন ভারি বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলের কারণে এই অঞ্চলে নতুন করে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সুরমা নদীর পানি বেড়েছে ৬৭ সেন্টিমিটার। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ২১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বাড়ছে জেলার অন্যান্য নদ-নদী ও হাওড়ে। অপরদিকে উজানের পাহাড়ী ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তার পানি ফের বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে লালমনিরহাটের তিস্তা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল আবারও বন্যায় প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। শুক্রবার বিকেল ৩টায় দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২.৭৫ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নিয়ে তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টের চতুর্থবারের মতো বিপদসীমা পার হলো। প্রথমবার ২১ জুন এই নদী বিপদসীমা অতিক্রম করে। এর পর পটানি কমে গিয়ে অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়। ফের ২৬ জুন তিস্তা পানি বিপদসীমার অতিক্রম করে। ফলে এর অববাহিকায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে বন্যার কবলে পড়ে। সর্বশেষ জুলাইয়ের প্রথমে আবারও বিপদসীমা অতিক্রম করে। পরে পানি কমে বিপদসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে উজানের পাহাড়ী ঢল ও ভারি বর্ষণে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে হঠাৎ পানি বেড়ে নতুন করে ৪টি স্টেশনের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট অংশে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, সুরমার সুনামগঞ্জ অংশে ১৭ সেন্টিমিটার, জাদুকাটার লরেরগড় অংশে ২৩ সেন্টিমিটার এবং গুড় নদীর সিংড়া অংশে বিপদসীমার ১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে সুনামগঞ্জে ১৮৩, লামায় ৭৮, কুষ্টিয়ায় ৬০, ছাতকে ১৭৫, লরেরগড়ে ১০৪, মহেশখোলায় ৭০, দুর্গাপুরে ৬০, জাফলংয়ে ১২৮, চিলমারীতে ১০৩, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬০ ও টাঙ্গাইলে ৬০ মিলিমিটার। এদিকে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগার ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম কক্সবাজার মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগারে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলে কাছাকাছি সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। বগুড়া ॥ বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ী ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনা ও বাঙালীর পানি বাড়ছে। এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি তবে কাছাকাছি পৌঁছেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তারা ঢলের তীব্রতা দেখে বলছেন, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় দফায় বিপদসীমা অতিক্রম করে বন্যা এলাকা বাড়িয়ে দিতে পারে। বর্তমানে যমুনা ও বাঙালী তীরের তিন উপজেলার (সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট) ১৫টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রামের অন্তত ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এদের প্রায় সকলেই যমুনার চরগ্রামের মানুষ। এদের কেউ ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে, কেউ উঁচু উন্মুক্ত স্থানে ও কেউ নৌকায় ক্ষণিকের ঘরবসতি গড়েছে। এদিকে যমুনার ১৩টি চর ভাঙনের কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুটি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ৬০০ বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। পাউবো কর্মকর্তারা বলছেন নদীতে পানি বেড়ে যাওয়া ও পানি কমে যাওয়া এই দুই সময়ে ভাঙনের তীব্রতা বাড়ে। নীলফামারী ॥ উজানের পাহাড় ও সমতলে একটানা বৃষ্টি ও গজলডোবা হতে প্রচুর পানি ছেড়ে দেয়ার জেরে ভয়ঙ্কর রূপে ফুঁসে উঠেছে তিস্তা নদী। শুক্রবার সকাল ৬টার পর হতে ১২ ঘণ্টায় নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বিপদসীমার (৫২.৬০) ২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অথচ এ দিন সকাল ৬টায় তিস্তার পানি বিপদসীমার ১২ সেন্টিমিটার নিচে ছিল। সেই সঙ্গে ঢলের পানি দ্রুতগতিতে অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নীলফামারীর ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম জানান, পরিস্থিতি সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। এদিকে ওপারে দোহনী হতে বাংলাদেশের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ভারত কর্তৃপক্ষ তিস্তা নদীর অরক্ষিত এলাকায় লাল সংকেত জারি করেছে। উত্তরাঞ্চলের পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান উজানে ভয়াবহতার কারণে ভারত লাল সংকেত জারি করেছে। অপরদিকে বাংলাদেশ অংশে হলুদ সংকেত রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে লাল সংকেত দেয়া হবে। তিস্তা ব্যারাজের কর্মকর্তারা নজরদারিতে মাঠে রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এদিকে উজানের ঢলে তিস্তায় চতুর্থ দফায় ভয়াবহ বন্যায় তিস্তা অববাহিকায় নতুন করে ৫ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে চরবেষ্টিত গ্রামের মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। যেতে বলা হয়। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ৬ ইউনিয়ন, পূবছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশাচাঁপানী ও ঝুনাগাছচাঁপানীর ইউপি চেয়ারম্যান গন জানায় তিস্তায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। ডিমলার কিছামত ছাতনাই, ঝাড়শিঙ্গেশ্বর, চরখড়িবাড়ি,পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিমখড়িবাড়ি, তিস্তাবাজার, তেলিরবাজার, বাইশপুকুর, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেখানকার মানুষজন গরু ছাগল, বাক্সপোটরা নিয়ে নিরাপদে সরে গেছে। লালমনিরহাট ॥ শুক্রবার বিকাল ৩টায় জেলায় তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেঃমিঃ ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের পাহাড়ী ঢল ও টানা বর্ষণের কারণে তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি ৪র্থ দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। নদী দুইটি রুদ্ধমূর্তি ধারণ করেছে। তিস্তা ও ধরলা নদীর প্রায় ৫০টি চর ও দ্বীপ চরে প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শুকনো খাবারের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কয়েক দফায় পানি ওঠায় তারা হতাশা ও নিদারুণ কষ্টে পড়েছে বানভাসি মানুষ।
×