ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সংসদের বাজেট অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ২৩:০৩, ১০ জুলাই ২০২০

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা করোনাকে জয় করেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার পাশাপাশি করোনা মহামারীর সময়ে অনেকে সরকারের সমালোচনা আর খুঁত ধরায় ব্যস্ত থাকলেও তাদের কতজন সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। একইসঙ্গে অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে এর বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কে কোন দলের সেটা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। ধরেই যেন আমরা চোর হয়ে যাচ্ছি। আমরা ধরার পর আমাদের দোষারোপ করা হয়। সে যাই হোক আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেব এবং এটা অব্যাহত থাকবে। সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্দেশে আওয়ামী লীগ এবং দলের সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য যেসব কাজ করে যাচ্ছেন তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের তো অনেক রাজনৈতিক দল আছে। সমালোচনা অনেকেই করে যাচ্ছেন। এমনকি বহু এনজিও, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঠিক বর্তমানে কতজনকে চোখে পড়ে যারা কাজ করছে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে? সেটাই আমার প্রশ্ন। সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ করে সংসদ নেতা বলেন, ঘরে বসে সমালোচনা, বাজেটের খুঁত ধরা, কাজের খুঁত ধরা সেগুলো অনেকেই ধরতে পারেন, এটা ঠিক। কিন্তু মাঠে গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষকে সেবা করা, এই কাজগুলো কিন্তু আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক যারা, আমরাই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দেশের মানুষের যে কোন ক্রান্তিলগ্নে জন্মলগ্ন থেকে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এখনও দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, অনেক মানুষ আছে যারা হয়ত হাত পাততে পারছে না, তাদের কোন আয় নেই। গোপনে তাদেরকে খাবার জিনিস সরবরাহ করা হয়। এমনকি ঢাকা শহরে আমাদের প্রত্যেকটা ওয়ার্ডে বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের যে কমিটিগুলো, তারা কিন্তু সেভাবে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে। আর যারা নিচ্ছে তারা কিন্তু চায় না তাদের নামটা প্রচার হোক। আমরাও চাই না। কারণ এটা তাদের একটু আত্মাভিমানে লাগে। কিন্তু তারা যেন কষ্ট না পায় সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আছে। সরকারের পাশাপাশি দলের পক্ষ থেকেও মানুষকে সহায়তা করা হচ্ছে। করোনাভাইরাস সঙ্কটে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকারের কাজ করে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য আমরা দুই হাজার ডাক্তার ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি। পাশাপাশি আরও দুই হাজার ডাক্তারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাছাড়া হেলথ টেকনোলজিস্ট, কার্ডিওগ্রাফার এবং ল্যাব এ্যাটেনডেন্টের তিন হাজার পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। আমরা সেগুলোও দেব। দুর্নীতিবাজ ধরে আমরাই যেন চোর হয়ে যাচ্ছি ॥ সমাপনী বক্তব্যে রাখতে গিয়ে বিরোধী দল ও বিএনপি এমপিদের বিভিন্ন বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িতদের ধরেই যেন আমরা চোর হয়ে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কে কোন দল সেটা বড় কথা নয়, দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িতদের আমরা ধরে যাচ্ছি। আমরা ধরার পর উল্টো আমাদেরই দোষারোপ করা হয়। তবে যে যাই হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেব এবং এটা অব্যাহত থাকবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক শাসনামলে দুর্নীতিকেই নীতি হিসেবে গ্রহণের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মানুষের চরিত্র নষ্ট করে দিয়ে গেছে ১৯৭৫-এর পরে যারা রাতের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তারাই। কারণ, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এরা মানুষকে দুর্নীতি শিখিয়েছে, কালো টাকা ও ঋণখেলাপী শিখিয়েছে। তারা এই সমাজটাকে কলুষিত করে গেছে। মানুষ আগে যে একটা আদর্শ ও নীতি নিয়ে চলত, দীর্ঘদিন এ দেশে মিলিটারি ডিক্টেরশিপ মানুষের চরিত্র হরণ করেছে। কারণ তাদের অবৈধ ক্ষমতাটাকে নিষ্কণ্টক করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, সামরিক স্বৈরশাসকরা বছরের পর বছর এই দুর্নীতির বীজ বপন করেছে। তা মহীরুহ হয়ে গেছে। যতই কাটেন কোথা থেকে আবার গজিয়ে ওঠে। মানুষের চরিত্রটাই নষ্ট করে দিয়ে গেছে তারা। এই চরিত্রহীনতা একেবারে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছিল। সেখানে আপনি যতই চেষ্টা করেন এর মূলোৎপাটন যথেষ্ট কঠিন। তিনি বলেন, তারপরও এর মধ্যে যে খবরগুলো পাচ্ছেন, এটা কারা করছেন? আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর কে কোন দলের সেটা বড় কথা নয়, এই ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, অনিয়মে জড়িত যাকে যেখানে পাচ্ছি আমরা ধরে যাচ্ছি। ধরছি বলেই যেন আমরা চোর হয়ে যাচ্ছি। আমরা ধরার পর আমাদের দোষারোপ করা হয়। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্য। এর আগে তো দুর্নীতিটাই নীতি ছিল, অনিয়মটাই নিয়ম ছিল। সেভাবেই রাষ্ট্র চলেছে। কিন্তু আমরা আসার পর সেগুলো মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। যতটুকু পারি সেগুলো আমরা শুদ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এই অনিয়মগুলো আমরা নিশ্চয়ই মানব না। যে যাই হোক তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, নেব এবং এটা অব্যাহত থাকবে। করোনায় আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান ॥ করোনাভাইরাসের ভয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাসের কথা শুনলেই মানুষ ভয়ে আতঙ্কিত হয়। এত আতঙ্কিত হব কেন। মরতে তো একদিন হবেই। তবে নিজে সুরক্ষিত থাকার জন্য স্বাস্থ্যবিধিসহ যা যা মেনে চলার দরকার তা করবেন। আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তাহলে করোনার সংক্রমণ থেকে মুক্তি পাব। আমাদের দেশে করোনা রোগীর সুস্থতার হার অনেক বেশি। তাই মনে সাহস রাখতে হবে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে করোনার পরিস্থিতি এবং সরকারের পদক্ষেপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, করোনার কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। অতীতেও কখনও এমন পরিস্থিতি দেখা যায়নি। করোনার যেন নিজস্ব একটা পদ্ধতি আছে। প্রথমে একজন আক্রান্ত হচ্ছে, এরপর দুইজন, এরপর আরও ১০ এভাবে ছড়াতে থাকে। কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকবে না। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। বাংলাদেশ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, করোনার সংক্রমণ জুলাই মাস পর্যন্ত বাড়তে থাকবে। এরপর আস্তে আস্তে কমে যাবে। সেটাই হচ্ছে। আশা করি, পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। করোনাকে জয় করেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে এমন দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনা শুনলেই মানুষের মৃত্যু ভয় পেয়ে বসে। কিন্তু ভয়কে জয় করতে হবে। মৃত্যু তো আছেই, মৃত্যু অবধারিত। এ সময় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতার লাইন পাঠ করে শোনান তিনি। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায়রে জীবন’- এটা তো কবি বলে গেছেন। তাই বলে মরার আগে মরব না, মরার আগে মরব না। মরণকে জয় করতে হবে। করোনা জয় করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব। তিনি বলেন, যারা করোনা আক্রান্ত তাদেরও মনে সাহস রাখতে হবে। আমি যতদূর পারি সবার সঙ্গে একটু কথা বলি সাহস জোগাই। খোঁজ নেই চিকিৎসা ঠিকমতো পাচ্ছে কি না? সেগুলো আমরা নিচ্ছি। যারা করোনা রোগে আক্রান্ত আমরা চাই সবাই সুস্থ হয়ে আসুন। আমাদের সুস্থতার হার অনেক বেশি। অবশ্য যাদের অন্যান্য শারীরিক অসুবিধা আছে তারা বেশি মৃত্যুবরণ করছেন। তবে কারও মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়। কেউ মৃত্যুবরণ করুক আমরা সেটা চাই না। আমরা চাই সবাই সুস্থ হয়ে ফিরে আসুক। এ সময় সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, যাক একটা জিনিস ভাল হয়েছে। এই সংসদ অধিবেশনে যারা আসছেন কয়েকজন সংসদ সদস্য তাদের সকলের করোনা টেস্ট করা হয়েছে। এখন একটু আশ্বস্ত হয়ে চলতে পারবেন। তাছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ও সাবেক হুইপ করোনা জয় করে ফিরে এসেছেন। করোনা জয় করার জন্য মনে সাহস রাখতে হবে। পাটকল আধুনিক করা হবে ॥ বস্ত্র-পাটকলগুলোর শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হবে এবং পাটকলগুলো আধুনিকায়ন করা হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বলেন, গত এক বছর ধরে এ পাটকলগুলোর ২৫ হাজার শ্রমিককে সরকারের পক্ষ থেকে বেতন দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশন (বিজেএমসি) দিতে পারছে না। সরকারের পক্ষ থেকে এভাবে বছরের পর বছর বেতন দিয়ে যেতে হবে। এ পাটকলগুলো সবচেয়ে পুরনো ৫০ ও ৬০-এর দশকে এগুলো স্থাপন করা হয়েছিল। এগুলো আর লাভজনক করা সম্ভব না। বিশ্বে পাটের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আমরা পাটের জিন আবিষ্কার করেছি। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সম্ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী এ বিশাল সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এ পাটকলগুলোকে সময়পোযোগী ও আধুনিক করতে হবে। আমরা সেটা করব। শ্রমিকদের পাওনা ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে আমরা পরিশোধ করব। সব টাকা তাদের হাতে দেয়া হবে না। দিলে খরচ হয়ে যাবে। অর্ধেক টাকা আমরা তাদের পারিবারিক সঞ্চয়পত্র করে দেব। এতে তারা প্রতিদিনের মজুরির চেয়ে বেশি পাবে। এ পাটকলগুলো আধুনিক করে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এদের যারা আগ্রহী হবে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো যাবে।
×