ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মর্নিং বার্ড দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন শীঘ্রই

বেপরোয়া লঞ্চ চালানো ও সদরঘাটের অব্যবস্থাপনা দায়ী

প্রকাশিত: ২১:৫০, ৫ জুলাই ২০২০

বেপরোয়া লঞ্চ চালানো ও সদরঘাটের অব্যবস্থাপনা দায়ী

শংকর কুমার দে ॥ বুড়িগঙ্গায় মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘনায় এমভি ময়ূর-২ লঞ্চের চালকের বেপরোয়া চালানো এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে যাচ্ছে তদন্ত কমিটি। প্রত্যক্ষদর্শী, বেঁচে যাওয়া যাত্রী, বিআইডব্লিউটিএ, পুলিশ কর্মকর্তা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে তৈরি করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে মনিং বার্ড লঞ্চ ডুবির ঘটনায় সাড়ে বারো ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারি অন্যতম। দীর্ঘ সাড়ে ১২ ঘণ্টা ধরে বুড়িগঙ্গায় নিমজ্জিত লঞ্চের ভেতরে যেখানে পানির নিচে অক্সিজেন নেই, সেখানে বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা সেই রহস্যের জট ও কৌতূহলের অবসান ঘটাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সুমন বেপারিকেও। তদন্ত কমিটি সূত্রে আরও জানা গেছে, বুড়িগঙ্গায় দুই লঞ্চের সংঘর্ষে ৩৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ৭ দিনের মধ্যে কমিটি দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন, দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থাকে শনাক্ত এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় উল্লেখ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদান করার জন্য বলা হয় তদন্ত কমিটিকে। আগামী ৭ জুলাই, ৭ দিন হওয়ার একদিন আগে ৬ জুলাই প্রকাশ পেতে যাচ্ছে তদন্ত প্রতিবেদন। লঞ্চ দুর্ঘটনায় সাতজনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু এক সপ্তাহেও কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভবপর হয়নি। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, ময়ূর-২ লঞ্চটি সদরঘাটে আসার পথে প্রথমে মর্নিং বার্ডকে পেছন দিকে ও পরে সামনের দিকে ধাক্কা দেয়। এতে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লঞ্চটি ডুবে যায়। এ ছাড়া মর্নিং বার্ডের মাস্টার (চালক) আসনে যার থাকার কথা ছিল তিনি ছিলেন না। তার পরিবর্তে সেখানে ছিলেন তার সহকারী। তিনিও লঞ্চ ডুবিতে মারা যান। লঞ্চের মাস্টার ও ড্রাইভারের অদক্ষতা এবং অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ময়ূর-২ মালিকের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সি হর্স কর্পোরেশনের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তদন্ত কমিটিকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেছেন তিনি। তদন্ত কমিটির যেসব সুপারিশ করেছে তার মধ্যে আছে, সদরঘাটের দুই পাড়ে লঞ্চ বেঁধে রেখে চলাচলের পথ সরু করে ফেলা, একই নদীতে ছোট ও বড় লঞ্চ চলাচলের বিষয়ে করণীয় নিয়ে সুপারিশ। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আছে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জনের বক্তব্য। এর মধ্যে মর্নিং বার্ড লঞ্চের বেঁচে যাওয়া ১১ যাত্রীও রয়েছেন। তারা ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। প্রত্যক্ষদর্শীরা লঞ্চ ডুবির কারণ প্রসঙ্গে জানান, ময়ূর-২ লঞ্চটি হঠাৎ করেই মর্নিং বার্ড লঞ্চের দিকে চেপে আসছিল। প্রথমে পেছন দিকে ধাক্কা দিলেই লঞ্চের ভেতরে হইচইসহ কান্নাকাটি শুরু হয়। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সামনে থেকে আরেক ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। তারা এ ঘটনায় ময়ূর-২ লঞ্চের মাস্টার, ড্রাইভার ও সুকানিকে দায়ী করেছেন। লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য ময়ূর-২ লঞ্চের চালকদের অদক্ষতা ও বেপরোয়াভাবে চালানোকেই দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান, ময়ূর-২ লঞ্চের মালিক ও চালক তদন্ত কমিটির কাছে কোন কয়েকবার চিঠি ও ফোন দেয়ার পরও তারা কোন তথ্য দিয়ে সাহায্য করেননি। এ ঘটনার পর থেকেই তারা আত্মগোপনে আছেন। ময়ূর-২ লঞ্চের মালিকের প্রতিষ্ঠান মেসার্স সি হর্স কর্পোরেশনের ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন ফোনে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছেন, লঞ্চের মাস্টারের (চালক) অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ময়ূর-২ লঞ্চের কেরানি সেলিম কমিটিকে বলেছেন, ঘটনার সময়ে তিনি লঞ্চে ছিলেন না। এ কারণে দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটেছে, কে লঞ্চ চালান তা তিনি জানেন না। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির এক সদস্য বলেন, তাদের কমিটি ময়ূর-২ লঞ্চটির দু’জন চালকের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন। তারা হলেন- মোঃ আবুল বাশার, মোঃ জাকির হোসেন। ঘটনার সময়ে সদরঘাটে কর্মরত ছিলেন বিআইডবিব্লউটিএ’র পরিদর্শক মোঃ সেলিম মিয়া। দুর্ঘটনার পর লঞ্চটি যখন ঘাটে এসেছিল তখন ওই দুই চালককে সামনের অংশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা সাড়ে ১২ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারির সাক্ষাতকার নিয়েছেন। সাক্ষাতকারে সুমন বেপারি বলেছেন, মুন্সীগঞ্জ থেকে আসার সময়ে হঠাৎ করে ময়ূর-২ লঞ্চটি ধাক্কা দিলে মর্নিং বার্ড ডুবে যায়। তখন তিনি চেষ্টা করেও বের হতে পারেননি। ভেতরে রড ধরে আল্লাহকে ডেকেছেন। তার আর কিছু মনে পড়ছে না। লঞ্চ নড়াচড়াসহ মানুষের শব্দ পেয়ে বের হন বলে তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেছেন তিনি। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তারই প্রশ্ন-সুমন বেপারি কিভাবে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ডুবে যাওয়ার লঞ্চের ভেতরে সাড়ে ১২ ঘণ্টা জীবিত র্ছিলেন? বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে নিমজ্জিত লঞ্চের ভেতরে তো অক্সিজেন থাকার কথা নয়। অক্সিজেন ছাড়া নদীর তলদেশে নিমজ্জিত লঞ্চের ভেতরে কিভাবে বেঁচে থাকবেন একজন মানুষ? নদীতে নিমজ্জিত লঞ্চের ভেতরের কোন ইঞ্জিন কক্ষই হোক আর যে কোন কক্ষই হোক না কেন, সেখানে নিচ্ছিদ্র থাকার কথা নয় যে পানি প্রবেশ করবে না। এটা অবাক বিস্ময়, অলৌকিক কান্ড বলেই মনে হয় বলে তদন্ত কমিটির কর্মকর্তার দাবি। তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা জানান, ময়ূর-২ লঞ্চটি ঢাকা-চাঁদপুর রুটে চলাচল করে। বেলা সাড়ে ১২টায় লালকুঠি ঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী ২ ঘণ্টা আগে অর্থাৎ সাড়ে ১০টায় ওই ঘাটে যাত্রী তোলার জন্য আসার কথা ছিল। কিন্তু ময়ূর-২ লঞ্চটি সকাল দশটার দিকে ঘাটে আসার সময়ে মর্নিং বার্ডকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। এ ঘটনার জন্য সদরঘাটের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পরই ফরাশগঞ্জ ঘাটে ময়ূর-২ লঞ্চের সব গেট তালা দিয়ে স্টাফরা পালিয়ে যায়। এ কারণে লঞ্চ পরিদর্শনে গিয়ে ফেরত এসেছে কমিটি। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক ও নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৭ দিন সময় দেয়া হয়েছে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে। তদন্ত চলা অবস্থায় কোন কিছু বলা যাবে না। প্রসঙ্গত, গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় মর্নিং বার্ড লঞ্চটি ডুবে যায়। এতে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। লঞ্চ ডুবির এ ঘটনায় নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় গত ২৯ জুন সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) মোঃ রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডব্লিউটিএ’র পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মোঃ রফিকুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- নৌ পরিবহন অধিদফতরের চীফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন জসিমউদ্দিন সরকার, বিআইডবিব্লউটিসি’র প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেভাল আর্কিটেকচার এ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের একজন প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিস অধিদফতরের একজন প্রতিনিধি ও নৌ পুলিশের একজন প্রতিনিধি রয়েছেন তদন্ত কমিটিতে। সুমন বেপারি এখনও হাসপাতালে ॥ রাজধানীর শ্যামবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীতে মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবির ঘটনায় সাড়ে ১২ ঘণ্টা পর জীবিত উদ্ধার হওয়া সুমন বেপারিকে নিয়ে কৌতূহলের যেমন শেষ নেই তেমনই তাকে নিয়ে রহস্য ঘণীভূত হয়েছে। সুমন বেপারির বড় ভাই শাহীন বেপারি বলেছেন, সুমন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩নং ভবনের ১নং ওয়ার্ডে ১৪নং বেডে ভর্তি রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার (২ জুলাই) রাত ১০টা ৪০ মিনিটে ৩নং ভবনে ভর্তি করা হয় তাকে। এর আগে উদ্ধার হওয়ার পর তাৎক্ষণিক ২নং ভবনের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করা হয়েছিল সুমনকে। গত ২৯ জুন সকালে মুন্সীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা মর্নিং বার্ড লঞ্চটি সদরঘাটের অদূরে শ্যামবাজার ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে যায়। ঘটনার পর নদী থেকে ৩৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করে উদ্ধারকারী দল। ঘটনার দিন রাত ১০টার দিকে লঞ্চটি টেনে তোলার সময় জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় সুমন বেপারিকে।
×