মিজানুর রহমান, আশাশুনির প্রতাপনগর থেকে ফিরে ॥ চারদিকে থৈথৈ পানির মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আমফানের তা-বে ক্ষতিগ্রস্ত বিধ্বস্ত কিছু কিছু বাড়ির চিহ্ন। জোয়ারের পানিতে নদী আর বেড়িবাঁধ একাকার। কোনটি রাস্তা আর কোনটি বেড়িবাঁধ চেনার উপায় নেই। ঘরের মধ্যে কোমর পানি। জোয়ারে রাস্তায় জমছে হাঁটুপানি। রাস্তার ওপর দিয়ে চলছে নৌকা। বাঁধভাঙ্গা পানির স্রোতে অর্ধেক ভেসে গেছে গড়িমহল রাস্তার ব্রিজ। প্রধান সড়কের কালভার্ট বাঁচাতে রাস্তার দু’পাশে বাঁশের তৈরি খাঁচা আর বালির বস্তা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে নিরাপদ ব্যবস্থা। আমফানের তা-বের দীর্ঘ ৩৪ দিন পরও ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের ১০টি পয়েন্ট দিয়ে এখনও জোয়ার ভাটার পানি উঠা নামা করায় মানবিক বিপর্যয়ে ইউনিয়নের সাড়ে ৭ হাজার পরিবার। পানিতে ভেসে যাওয়া বাঁধের কিছু কিছু অংশ জানান দিচ্ছে এখানে এক মাস আগেও বেড়িবাঁধ ছিল আর এটি গ্রামের সীমানা। এই ভয়াবহ চিত্র আমফান তা-বের একমাস ৪ দিন পরের ক্ষতিগ্রস্ত আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের ২০টি গ্রামের।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, খোলপেটুয়া আর কপোতাক্ষ বেষ্টিত ইউনিয়নের ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কোন অস্তিত্ব নেই। আমফানে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় প্রায় ৫শ’ ঘরবাড়ি। রাস্তা কাঁচা পাকা মিলিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের চাকলার ১টি অংশ, কুড়ি কাউনিয়ার ৪টি অংশ, হরিষখালির ২টা অংশ হিজরাকোলার ২টি ও শুভদ্রাকাটির ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের অংশ দিয়ে এখনও জোয়ারভাটার পানি উঠানামা করছে। ১৯শ’ হেক্টর চিংড়িঘের ভেসে গেছে। এই ইউনিয়নে এখন নিরাপদ স্থান বলতে কিছু নেই। এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ১শ’ ৫ টন চাল পাওয়া গেছে। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধের চাকলা, কুড়িকাউনিয়া, হিজলাকোলা এই ৩টি বাঁধের অংশ তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। আর হরিষখালি বাঁধের কাজ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে কবে নাগাদ এই কাজ শুরু হবে সেটি জানেন না ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ২০০৯ সালের আইলার পর থেকে মাটির শক্তি কমে গেছে। ফলে বেড়িবাঁধ টেকসই হয় না ইউনিয়ন বাসীকে বাঁচাতে টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নেই বলে দাবি করেন ইউপি চেয়ারম্যান।
জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে বুধবার যেয়ে দেখা যায় বিধ্বস্ত চিত্র। প্রতিদিন ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। আমফান তা-বের পর জনগণ স্বেচ্ছাশ্রমে কুড়ি কাউনিয়া ৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ তৈরি করলেও গত পূর্ণিমায় সেটে আবার পানিতে ভেসে গেছে। শ্রীপুর গ্রামের আবুল কাশেম মোড়ল (৫৬) বলেন, কপোতাক্ষ নদের পাড়ে মাটির ঘর বেঁধে বাস করতেন তিনি। ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে ভেঙ্গে তছনছ হয়ে যায় তার বসতঘর। আইলার পর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা চালায় তারা। এরইমধ্যে আমফানের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গেছে, ঘর ভেসেছে, ঘরের চাল উড়ে গেছে, বালিশ, কাঁথা, মাদুর, চাল, ডাল যা ছিল ঘরে সবই ভেসে গেছে নদীর পানিতে। থাকার জায়গা নেই। সুপেয় পানি নেই। খাবার নেই। স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। এমনকি মানুষ মারা গেলে কবর দেয়ার জায়গাও নেই। এ অবস্থা শুধু শ্রীপুর গ্রামের নয়, কুড়িকাহুনিয়া, সনাতনকাটি, দৃষ্টিনন্দন, চান্দারআটি, বন্যাতলা, হরিষখালি, চাকলা, কোলা, কল্যাণপুর, প্রতাপনগর, রইয়ার বিল, সুভদ্রাকাটিসহ গ্রামের পর গ্রামের দৃশ্য একই।
প্রতাপনগর ইউনিয়নের পাশের ইউনিয়ন আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর আলম লিটন বলেন, তার ইউনিয়নে ১৩টি পয়েন্টে ভেঙ্গে গেছে। আদি বিছট গ্রাম ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। বিছট, নয়াখালি, কাকবাশিয়া ও মনিপুরি গ্রামের ২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোন সরকারী সাহায্য ছাড়াই স্থানীয়ভাবে বাঁশ ও গাছ দিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ বাঁধতে পেরেছিলেন বলেই তার ইউনিয়নে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তা কারও নজরে আসেনি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: