ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

কামাল লোহানী ॥ ইতিহাসের সাক্ষী

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ২৩ জুন ২০২০

কামাল লোহানী ॥ ইতিহাসের সাক্ষী

কামাল লোহনীর মতো এমন বর্ণাঢ্য জীবন সচরাচর দেখা যায় না। তার জীবনে তিনি ছিলেন না কোথায় সেটি খুঁজে পাওয়া ভার। আজীবন তিনি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি ও অপশক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের এক অবিসংবিদিত ব্যক্তিত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ১৯৫২ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। কলেজে অধ্যয়নকালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে শামিল হন তিনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাবনা সফরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুসলিম লীগ সম্মেলন ভ-ুল করে দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি এবং প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। রাজনীতির পথ মসৃণ নয় জেনেও তিনি ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে নবগঠিত যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করতে গিয়ে পুনরায় গ্রেফতার হন।এই কারাবাসের সময় তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং আমৃত্যু সেই আদর্শে অবিচল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পুনরায় গ্রেফতার হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই কারাকক্ষে বন্দী ছিলেন। সেই বন্দী দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এবং তার ¯েœহসান্নিধ্যে আসেন। ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। এভাবেই তার সাংবাদিক কর্মজীবনের শুরু।সেই থেকে তার কলমের আঁচড়ে তৈরি হতে থাকে এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। পরবর্তীতে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত মুখ।এসময় পূর্ণোদ্যমে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সক্রিয় রাজনীতিতে তার ব্যস্ত সময় পার হচ্ছিল। একের পর এক মুসলিম লীগ বিরোধী আন্দোলন, ৬ দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তার সশরীরে উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, মাতৃভূমির মাটিকে শোষণমুক্ত করতে তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এসবের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠিত হলে তিনি সেখানে যোগ দেন এবং এ বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই প্রথমবারের মতো বাঙালী জাতির বিজয়ের সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেদিনের সেই চূড়ান্ত বিজয়ের ঘোষণা পাঠ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন কামাল লোহানী। স্বাধীনতার পর তিনি কাজ করেছেন বাংলাদেশ বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে। দুই দফায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কামাল লোহানী একজন দক্ষ সংগঠকও। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুই দফায় যুগ্ম-সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কামাল লোহানীর লেখা ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারব না’, ‘লড়াইয়ের গান’ কবিতার বই ‘দ্রোহে ও প্রেমে’ ও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে প্রকাশিত তাঁর লেখা নিয়ে বই আকারে বেরিয়েছে ‘সত্যি কথা বলতে কি’। এতসব কর্মকা-ের স্বীকৃতিস্বরূপ কামাল লোহানী সাংবাদিকতায় ২০১৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এর আগে ২০১০ সালে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি সম্মানসূচক ফেলোশিপ পান। ক্রান্তি স্মারক ২০০৩, ঋসিজ শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক সম্মাননা ও স্মারক, কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, জাহানারা ইমাম পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেছিলেন তারই চাচাত বোন দীপ্তি লোহানীকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী এবং আন্দোলনের সঙ্গী ছিলেন স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। এ ছাড়া প্রয়াত দীপ্তি লোহানী ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেরও একজন শব্দসৈনিক। কামাল লোহানী ও দীপ্তি লোহানী দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। তাঁরা হলেন সাগর লোহানী, বন্যা লোহানী, ঊর্মি লোহানী। প্রত্যেকেই বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। বাবা-মার দেখানো আদর্শ থেকে তারা এক চুলও বিচ্যুত হননি। তারাও এদেশের মাটি মানুষের কথা বলেন। পুত্র সাগর লোহনী পেশায় সাংবাদিকতা ও তথ্যচিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। জ্যেষ্ঠ কন্যা বন্যা লোহানী চাকরির পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। কনিষ্ঠ কন্যা ঊর্মি লোহানী বরেণ্য মানুষদের জীবনীভিত্তিক অনলাইন আর্কাইভ গুণীজন.কম পরিচালনা করেন। কামাল লোহানী ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ। যার হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে ছিল কেবলই বাংলাদেশ। যার জীবনবোধ, আচার, আচরণ, বিনয় সবকিছুর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যেত এক অপরূপ বাংলাদেশকে। বাংলা ভাষার আন্দোলন থেকে শুরু স্বাধীনতা এবং সকল প্রকার অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতেই তিনি আমাদের এক বাতিঘরে পরিণত হয়েছিলেন। যে বাতিঘর আমৃত্যু নিরন্তর আলো দিয়ে গেছে। আমরা এমন বাতি ঘরের আলোয় আমাদের সকল অন্ধকার দূর করে সম্মুখপানে এগিয়ে যাব, সেটিই প্রত্যাশা। লেখক : গণমাধ্যম কর্মী [email protected]
×