ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এম নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কেন অনিবার্য

প্রকাশিত: ২১:৫৮, ২৩ জুন ২০২০

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কেন অনিবার্য

বাংলাদেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলটির ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা জন্মদিন আজ। আমাদের রাজনৈতিক বিবর্তনের ধারায় যে দলটির অবদান সবচেয়ে বেশি, সেই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে। শুরুতে দলটির নাম আওয়ামী লীগ ছিল না। জন্মকালে যে দলটির নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, সেই দলটিই আজকের আওয়ামী লীগ। প্রথম কমিটিতে সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন সে সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সে সময়ের কথা উল্লেখ আছে। যখন ঢাকার রোজ গার্ডেনে দলের গোড়াপত্তন হচ্ছে, তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘কর্মী সম্মেলনের জন্য খুব তোড়জোড় চলছিল। আমরা জেলে বসেই সে খবর পাই। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে অফিস হয়েছে। ...আমরা সম্মেলনের ফলাফল সম্বন্ধে খুবই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল, আমার মত নেয়ার জন্য। আমি খবর দিয়েছিলাম, ‘আর মুসলিম লীগের পেছনে ঘুরে লাভ নেই। এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।...এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না।’ ... আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, না রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলে তাতে যোগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে। ... সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেয়া হলোÑ ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগ।’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক আর আমাকে করা হলো জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দী’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নেই। একটা অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।’ তরুণ শেখ মুজিব যে অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবেছিলেন, তা কার্যকর হতে খুব বেশি দিন সময় লাগেনি। ১৯৪৯ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নেতৃত্ব দলকে একটি অসাম্প্রদায়িক দলে রূপান্তর করেন। তখন এটি ছিল একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। ১৯৭০ সালের নির্বাচন শুধু বাঙালীর জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল না, আওয়ামী লীগের জন্যও একটি ইতিহাস সৃষ্টির সুযোগ ছিল, যা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালী আর আওয়ামী লীগ অর্জন করেছে। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে ৩১৩ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শেষে পাকিস্তানের কারাগার থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে সরকার গঠন করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দুরূহ কাজটি হাতে তুলে নেন এবং সাড়ে তিন বছরের মাথায় দেশটাকে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না, বাংলাদেশে গত চার দশকে যত সরকার দেশ শাসন করেছে, বঙ্গবন্ধুর সেই সাড়ে তিন বছরের সরকারের মতো এত কঠিন সব চ্যালেঞ্জ অন্য কোন সরকারকে মোকাবেলা করতে হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে দেশের শত্রুরা সপরিবারে হত্যা করলে আওয়ামী লীগ আবার অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে। যদিও বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করে বাকশাল গঠিত হয়েছিল। বাকশালের মূল নেতৃত্বেই ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। দলটিকে সম্পূর্ণভাবে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে কারাগারে বন্দী জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাÑ শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকার কারণে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের এক বিশেষ কাউন্সিল অধিবেশনে প্রবাসে নির্বাসন জীবনযাপনকারী শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতভাবে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই বছর ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশের এক ক্রান্তিকালে দেশে ফেরেন। তাঁর নেতৃত্বেই দলে নতুন করে ঐক্য সুসংহত হয়। এর পর থেকে ৪০ বছর ধরে তাঁর নেতৃত্বেই দলটি গণতন্ত্র ও মানুষের ভোট-ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে সফলতা দেখিয়ে আসছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিজয়লাভের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার পেছনে দলটির মুখ্য অবদান ছিল। ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর আসন অলঙ্কৃত করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনা করছে। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় শুধু নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের যত ইতিবাচক অর্জন, সবই হয়েছে আওয়ামী লীগের শাসনামলে। ২০১৯ সালে মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭২.৩ বছর। শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের ৯৪ শতাংশ জনগণ এখন বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছে। ২০১৯ পর্যন্ত বিদ্যুত উৎপাদন এর ক্ষমতা ২২,৫৬২ মেগাওয়াট। বাংলাদেশ আইসিটি খাতে রফতানি শুরু করেছে। ২০১৯ সালে আইসিটি খাতে রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে ১৬০০ কোটি মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আয় হয়েছে। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মহাকাশে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে। ৩২তম নিউক্লিয়ার নেশন হিসেবে বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৯ সালে দেশের খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ৪ কোটি মেট্রিক টন। দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। চাল উৎপাদনে তৃতীয় হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। রফতানি আয় কমার পরও প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ। বিগত কয়েক বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালে এসে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলার। ২০১৯ সালে এসে অতি দারিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ১১.৩%। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ফলে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বের মতো এগিয়ে নিতে নেয়া হয়েছে ১০০ বছরের ‘ডেলটা প্ল্যান’। সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে কর্মসংস্থান হবে ১ কোটি লোকের। আর এখন তো এটা প্রমাণিত যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা মানেই দেশের মানুষ নিরাপদ বোধ করে। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকে গত ১১ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা অতীতে আর কখনও হয়নি। দেশের মানুষর ভাগ্য পরিবর্তনে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেই দলটি অনিবার্য। বঙ্গবন্ধু কন্যার সফল ও কার্যকর নেতৃত্বে দলটি আজ মানুষের আস্থার গভীরে স্থান করে নিতে পেরেছে। লেখক : সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি, অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক [email protected]
×