ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২

১৬ দিনেই করোনায় আক্রান্ত ৩৪ হাজার

প্রকাশিত: ২১:৫৬, ৬ জুন ২০২০

১৬ দিনেই করোনায় আক্রান্ত ৩৪ হাজার

রাজন ভট্টাচার্য ॥ গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর তিনমাস হতে বাকি আর দুদিন। প্রায় তিন মাসে নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬০ হাজার ৩৯১ জন। মৃত্যুর মিছিল বেড়ে হয়েছে ৮২৮ জনে। আর সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ৮০৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১৬ দিনে দেশে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। মোট আক্রান্তের মধ্যে প্রায় ৩৪ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে অর্ধমাসে। অর্থাৎ প্রায় তিনমাসে যত শনাক্ত হয়েছে এর মধ্যে গত ১৬ দিনে শনাক্ত হয়েছে অর্ধেকের বেশি রোগী। আর এই সময়ে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট মৃত্যুর অর্ধেক! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি আক্রান্ত জেলাগুলোকে লকডাউন না করা, সেক্টরভিত্তিক লকডাউন শিথিল ও যানবাহন চলাচলে কড়াকাড়ি আরোপ না করা এমনকি সর্বশেষ সাধারণ ছুটি বাতিল করে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয়ায় রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। পরীক্ষা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া না হলে আক্রান্তের মাত্রা সহ মৃত্যু আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। তবে আক্রান্ত বিবেচনায় সারাদেশকে লাল, সবুজ ও হলুদে ভাগ করার নতুন সিদ্ধান্ত খুব একটা কার্যকরী হবে বলেও মনে করছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বৃহস্পতিবার দেশে ২ হাজার ৪২৩ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছে ৩৫ জন। শুক্রবার নতুন করে শনাক্ত হয়েছে দুই হাজার ৮২৮ জন রোগী। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬০ হাজার ৩৯১ জন। ৩০জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এর মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮২৮ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৪ হাজার ৬৪৫টি নমুনা সংগ্রহ শেষে ১৪ হাজার ৮৮টি পরীক্ষা করে এসব তথ্য জানা যায় বলে নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে জানান স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে মোট পরীক্ষা হয়েছে তিন লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫টি। এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন ১২ হাজার ৮০৪ জন। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় তা হলো, জুন মাস শুরুর পর একদিনেও শনাক্তের সংখ্যা দুই হাজারের নিচে নামেনি। ত্রিশের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে টানা কয়েকদিন ধরে। নাসিমা সুলতানা বলেন, দীর্ঘদিন ঘরে থাকার পরও পরিবারের বয়স্কদের মধ্যে কেউ কেউ করোনাভাইরাস আক্রান্ত হচ্ছেন। এ কারণে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সঙ্গে মাস্ক পড়ে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলামেশা করার পরামর্শ দেন তিনি। গতকালের মতো আজও ৫০টি পরীক্ষাগারের তথ্য বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা হয় স্বাস্থ্য বুলেটিনে। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ২৬ মার্চ থেকে চলা সাধারণ ছুটির মেয়াদ না বাড়িয়ে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খোলা রাখার পাশাপাশি গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৩ দফা নির্দেশনাও দেয়া হয়। দেশে সংক্রমণের মাত্রা যখন বাড়ছে তখন মহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ও সমালোচনার মধ্যেই ‘মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে’ অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু করার বিকল্প নেই এমন যুক্তি তুলে ধরে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৫ দিন গণপরিবহন চলাচল ও করোনায় সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। তবে মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর গণপরিবহন চলতে সড়কপথে ১৩টি, নৌ-যান ও রেলে ১৪টি ও বিমানে ১০টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়। যদিও এসব নির্দেশনা কোন সেক্টরেই শতভাগ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মালিক ও শ্রমিক নেতারাও এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সবকিছু স্বাভাবিক হওয়ার মধ্য দিয়ে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল শুরু থেকেই। তাছাড়া করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক করার ঘোষণা সঙ্কটের মাত্রা আরও বাড়াতে পারে শুরু থেকেই এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিলেন চিকিৎসকরাও। ৩১ মে থেকে গণপরিবহন চালুর পর থেকে নৌ ও সড়ক পথে ৩০ ভাগও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। তবে রেল ও আকাশপথের চিত্র অনেকটা স্বাভাবিক। যদিও বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গণপরিবহন ব্যবহারে ছোঁয়াছে ভাইরাসে মানুষের বেশি সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত সময়েও অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২১ মে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২ জন, নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন এক হাজার ৭৭৩ জন, ২২ মে আক্রান্ত এক হাজার ৬৯৪ ও মৃত্যু ২৪ জনের, ২৩ মে২০ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত এক হাজার ৮৭৩, ২৪ মে ২৮ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত এক হাজার ৫৩২ জন আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও ২৫ মে ২১ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৯৭৫, ২৬ মে ২১ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ১৬৬ জন, ২৭ মে ২২ জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত এক হাজার ৫৪১ জন, ২৮ মে ১৫ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি দুই হাজার ২৯ জন আক্রান্ত হন। ২৯ মে ২৩ জন মৃত্যু ও দুই হাজার ৫২৩ আক্রান্ত, ৩০ মে ২৮ জনের মৃত্যু ও এক হাজার ৭৬৪ জন আক্রান্ত হয়েছে। মাসের শেষ দিন ৩১ মে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় ৪০ জনের, আক্রান্ত দুই হাজার ৫৪৫ জন। ১ জুন ২২ জনের মৃত্যুর পাশাপাশি দুই হাজার ৩৮১ জন আক্রান্ত হন, ২ জুন ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর আসে। আক্রান্ত হয় দুই হাজার ৯১১ জন। ৩ জুন ৩৭ জনের মৃত্যু ও দুই হাজার ৬৯৫ জনের মধ্যে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। সব মিলিয়ে গত ১৬ দিনে ৩৩ হাজার ৬৪৮ জন আক্রান্ত ও এই সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৪২৫ জনের। জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ এবং পাবলিক হেলথ, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক তৌফিক জোয়ার্দার গণমাধ্যমকে বলেন, লকডাউন যদি একটা সময় পর্যন্ত কঠিন করে রাখা যেত, তাহলে যে বেনিফিট পাওয়া যেত, সেই বেনিফিটটা আমরা মিস করে ফেলেছি। শুরুতে বাংলাদেশ ভাল অবস্থাতে ছিল। এতদিন ঢাকাসহ এর আশপাশের জেলাগুলোতে ৮৫ শতাংশের মতো রোগী ছিল, এটা রিলেটিভলি ভাল, কিন্তু ছড়িয়ে গেলে সামাল দেয়া কঠিন। এখন সে সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গেল। লকডাউনের বাংলাদেশে হাতছাড়া হয়ে গেছে মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ জাহিদুর রহমান বলেন, ‘লকডাউনের বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেছে। তারপরও পালন করা হচ্ছিল বলেই কিছুটা এই অবস্থায় ছিল, এখন আউটবার্স্ট হবে।’ তিনি আরও বলেন, প্রথম থেকে সাধারণ ছুটির কথা বলা হলেও আমরা লকডাউন হিসেবেই চেষ্টা করেছি, কেউ যেমন মানেনি তেমনি অধিকাংশই মেনেছে। অনেক দেশের তুলনায় মৃত্যু সংখ্যা কম ছিল এবং শনাক্তের সংখ্যাও কম ছিল। কিন্তু ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুর এই তিন জেলাকে কঠোরভাবে লকডাউন করা হলে ৮০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করা যেত। কারণ, এসব এলাকায় শুরু থেকে রোগী সংখ্যা বেশি শনাক্ত হচ্ছিল, কিন্তু সেটা করা যায়নি। তারই ফল এখন রোগী শনাক্তের হার।
×