ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেষতক কতয় বিক্রি হবে জয়নুলের স্কেচ, যাবে কার সংগ্রহে?

প্রকাশিত: ২১:৩২, ৬ জুন ২০২০

শেষতক কতয় বিক্রি হবে জয়নুলের স্কেচ, যাবে কার সংগ্রহে?

মোরসালিন মিজান ॥ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা ছবি বলে কথা, যার সংগ্রহে আছে তিনি নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান এবং এমন অনেক সংগ্রাহক দেশে আছেন যাদের কাছে খ্যাতিমান বহু শিল্পীর কাজ আছে। নেই শুধু জয়নুলের। কারণ শিল্পাচার্যের ছবির অর্থমূল্য অনেক বেশি। অনলাইনে আন্তর্জাতিক বাজারেই মূলত বিক্রি হয়। এর বাইরে পরিবার ও পুরনো সংগ্রাহকদের কেউ কেউ কখনও সখনও বিশেষ কারণে বিক্রি করে থাকেন। সবাই তার খোঁজ পান না। পেলেও সামর্থ্য হয় না কেনার। তবে এবার অনেকদিন পর দারুণ এক সুযোগ এসেছে। জয়নুলের একটি ছবি প্রকাশ্যে নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর পরিবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক ও সিনিয়র শিল্পীরা এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ খবর, হ্যাঁ, আগেই জানানো হয়েছিল। তারপর থেকে চলছিল প্রস্তুতি। অবশেষে আজ শনিবার রাতে অনলাইনে লাইভ বিডিং অনুষ্ঠিত হবে। সম্প্রতি শিল্পাচার্যের স্কেচবুক থেকে নেয়া ছবির ভিত্তিমূল্য ধরা হয়েছে ৮ লাখ টাকা। শেষতক এর মূল্য বেড়ে কত হয় এবং কোন সৌভাগ্যবান এটি সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিপুল কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। জানা যায়, ‘চলো সবাই’সহ আরও অন্তত দুটি ফেসবুক পেইজ থেকে নিলাম কার্যক্রম লাইভ করা হবে। রাত ৮টায় শুরু হবে আলোচনা। এতে অংশ নেবেন বরেণ্য শিল্পী রফিকুন নবী, সৈয়দ আজিজুল হক ও নিসার হোসেন। রাত সাড়ে ৮টা থেকে বিডিং শুরু হবে। নিলামে অংশ না নিলেও পুরো কার্যক্রম সরাসরি সবাই দেখতে পারবেন। ছবি বিক্রির থেকে প্রাপ্ত অর্থ করোনায় বিপদগ্রস্ত সাধারণ মানুষ ও দুস্থ শিল্পীদের সহায়তায় ব্যয় করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবির সবচেয়ে বড় ও প্রকৃত সংগ্রহ রয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে। সাম্প্রতিককালে শিল্পাচার্যের আঁকা একটি ছবি বিক্রি হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ টাকায়। আরেকটি ছবি বিক্রি হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকায়। তবে নিলামে ওঠতে যাওয়া শিল্পকর্মটি স্কেচ হওয়ায় আর্থিক মূল্য সে তুলনায় কম ধরা হয়েছে। এর ফলে বিডিংয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। জয়নুল আবেদিনের পুত্র প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন জানান, ঘরবন্দী সময়ে বাবার পুরনো ফাইল ইত্যাদি ঘেঁটে দেখার কাজ করছিলেন তিনি। স্কেন করছিলেন। হঠাৎই একটি স্কেচবুক দেখতে পান। বহু বছর ধরে বাসায় সংরক্ষিত হলেও তখনই এটি তার প্রথম নজরে আসে। এতে জয়নুল আবেদিনের ৬ থেকে ৭টি স্কেচ পাওয়া যায়। সেখান থেকে একটি ছবি বিক্রির জন্য বেছে নিয়েছেন বলে জানান তিনি। জনকণ্ঠকে পাঠানো ছবির স্ক্রিন শটে দেখা যায়, স্কেচটির মাপ ৮.৪ বাই ৪.৫ ইঞ্চি। ঘোড়ার গাড়ি করে কয়েকজন যাত্রী মালামালসহ গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। এই যাত্রার দৃশ্য নিজের সঙ্গে থাকা স্কেচবুকে তুলে নিয়েছিলেন জয়নুল। স্কেচ থেকেই পরে হয়তো বড় ও পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি হতো। তা না হলেও শিল্পাচার্যের ওয়াটার কালার অসামান্য হয়ে ধরা দিয়েছে। ছবির ওপরে ডান কোণে জয়নুল আবেদিনের স্বাক্ষর করা। তারিখও উল্লেখ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৭০ সালের এই মে মাসেই ছবি আঁকা হয়। ১১ মে আঁকা ছবিটিই আজ নিলামে ওঠছে। নিলাম কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক এবং সিনিয়র শিল্পীরা। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে অনুষদের ডিন নিসার হোসেন জানান, ‘জয়নুল আবেদিন পেইন্টিং আপ ফর অকশনে’ অংশ নিতে ইতোমধ্যে অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রেজিস্ট্রেশন করেছে। আজ লাইভ চলাকালেও বিডিংয়ে অংশ নেয়ার সুযোগ থাকবে। কিছু শর্ত দেয়া আছে। শর্ত মেনে বিডিংয়ে অংশ নেয়ার জন্য শিল্পপ্রেমীদের প্রতি আহ্বানও জানান তিনি। নিসার হোসেন বলেন, শিল্পাচার্য সেই কবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অথচ কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। যতদিন যাচ্ছে ততই তাঁর ছবির চাহিদা বাড়ছে। জয়নুলের একটি ছবি সংগ্রহে থাকা যে কারও জন্য গৌরবের। পাশাপাশি নিলামে অংশ নিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকছে। এরচেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? তিনি বলেন, আমাদের সব সময়ের অনুপ্রেরণা জয়নুল আবেদিন। আজ এই দুর্দিনেও তাঁকেই আশ্রয় করলাম আমরা। শিল্পাচার্যের মানবিক গুণাবলীর উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেঁচে থাকলে তিনিও এ উদ্যোগে খুশি হতেন। আসলেই তাই। কারও অজানা নয় যে, জয়নুল আবেদিন ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ। কোথাও মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। জাতীয় দুর্যোগে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতেন না মোটেই। বরং রং তুলি নিয়ে সেসব স্থানে ছুটে যেতেন। ছবি আঁকতেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ তাঁর দুর্ভিক্ষ সিরিজ। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে বিরাট এক নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। আজও ছবিগুলো দেখে গা শিউরে ওঠে। মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা জীবন-যন্ত্রণাকে আশ্চর্য এক শিল্প ভাষায় বর্ণনা করেছিলেন তিনি। সেই সময়ের মানবিক বিপর্যয়ের সকরুণ ইতিহাসকে ধারণ করে আছে তাঁর দুর্ভিক্ষ সিরিজ। পরবর্তীতেও এ ধারার ছবি আঁকা অব্যাহত ছিল। ষাটের ও সত্তরের দশকে আঁকা অনেক ছবিতে জয়নুলের মানবিক সত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালের সাইক্লোনের ভয়াল তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল দেশের দক্ষিণাঞ্চল। বহু মানুষের করুণ মৃত্যু হয়েছিল। জয়নুলকে সেই মৃত্যু বেদনায় ডুবিয়েছিল। তিনি সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে এঁকেছিলেন আরেক মাস্টার পিস ‘মনপুরা।’ ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ছবিতে সাইক্লোনের ভয়াবহতা তুলে ধরেছিলেন তিনি। কাগজে কালো কালি, তুলি ও মোমে আঁকা ‘মনপুরা’ আজও শিল্পপ্রেমীদের কাছে বিস্ময় এবং একই বছর ১৯৭০ সালে অভিন্ন তাড়না থেকে শিল্পাচার্য আরব লীগের আমন্ত্রণে জর্ডান সিরিয়া লেবানন ও ইজিপ্ট সফর করেন। এসব দেশে ফিলিস্তিনীদের ক্যাম্প পরিদর্শন করে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ছবি আঁকেন তিনি। জনকণ্ঠকে ময়নুল আবেদিন জানান, ওই সফরে মোট ৭২টি ছবি আঁকেন শিল্পাচার্য। এঁকে সেখানেই রেখে আসেন। ছবিগুলো নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন ও বিক্রিলব্ধ অর্থ মানবেতর জীবনযাপন করা ফিলিস্তিনীদের জন্য ব্যয় করার কথা ছিল। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এমনকি প্রবাসে বসে আঁকা ছবিগুলোর আজ পর্যন্ত কোন হদিস পাওয়া যায়নি। তবে প্রায়শই মূল ছবি আঁকার আগে স্কেচবুকে ছোট করে এঁকে রাখতেন জয়নুল আবেদিন। আরব লীগের আমন্ত্রণে গিয়েও বেশ কিছু স্কেচ করেছিলেন তিনি। সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া স্কেচবুক তার প্রমাণ। স্কেচবুকের যে স্কেচটি আজ নিলামে উঠছে সেটি দৈনিক জনকণ্ঠ ছাড়া আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি বলে জানান তিনি। মইনুল আবেদিন বলেন, আজ এই করোনারকালে কত মানুষ সঙ্কটে পড়েছে। বাবা বেঁচে থাকলে তাঁদের কথা ভেবে মন খারাপ করতেন। আমরা এসব ভেবেই ছবিটি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছি। ছবি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ করোনায় সঙ্কটে পড়া অসহায় মানুষ ও দুস্থ শিল্পীদের জন্য ব্যয় করা হবে বলে জানান তিনি।
×