ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৯০ ভাগ বাসে অরাজকতা, যাত্রী শ্রমিক বেপরোয়া

নৌ ও সড়কপথের স্বাস্থ্যবিধি নামকাওয়াস্তে

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ৩ জুন ২০২০

নৌ ও সড়কপথের স্বাস্থ্যবিধি নামকাওয়াস্তে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক ও নৌপথে চলা গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি খুব একটা মানা হচ্ছে না। মঙ্গলবার এ দুই পথে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি এখন নামকাওয়াস্তে। সচেতনতার পরিবর্তে যাত্রীদের বেপরোয়া মানসিকতা আর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অতি মুনাফার চিন্তাসহ উদাসীনতাই করোনা সুরক্ষার জন্য দেয়া স্বাস্থ্যবিধিকে ঢিলেঢালা অবস্থায় পরিণত করেছে। করোনার ভয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও খুব একটা তৎপর নয়। যদিও রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা সড়ক ও নৌ টার্মিনালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষিত বিধি মেনে চলতে যাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। কে শোনে কার কথা। যেতে হবে। তাছাড়া দীর্ঘদিন পর গাড়ি চলছে। তাই মুনাফা করার বিকল্প নেই। যেমন ইচ্ছে তোলা হয় যাত্রী। তবে রেল ও আকাশপথে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দৃশ্য সন্তোষজনক বলা যায়। এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে সচেতন হওয়ার পশাপাশি করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অন্যথায় সামনের দিনগুলোতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে সার্বিক পরিস্থিতি নাজুক অবস্থার দিকে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা। মঙ্গলবার বিআরটিসি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানারও অভিযোগ এসেছে। তিনি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি বলেছেন, ভাইরাস তো মালিক শ্রমিককে আলাদা করে চিনবে না। সাবধান না হলে অতি সংক্রমক এই ভাইরাস কাউকে ছাড়বেনা বলেও সতর্ক করেন মন্ত্রী। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ২৬ মার্চ থেকে চলা সাধারণ ছুটির মেয়াদ না বাড়িয়ে ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস খোলা রাখার পাশাপাশি গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১৩ দফা নির্দেশনাও দেয়া হয়। দেশে সংক্রমণের মাত্রা যখন বাড়ছে তখন মহামারী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ও সমালোচনার মধ্যেই ‘মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচাতে’ অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু করার বিকল্প নেই এমন যুক্তি তুলে ধরে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী ১৫ দিন গণপরিবহন চলাচল ও করোনায় সংক্রমণের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। তবে মহামারীর মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর গণপরিবহন চলতে সড়কপথে ১৩টি, নৌযান ও রেলে ১৪টি ও বিমানে ১০টি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা দেয়। যদিও এসব নির্দেশনা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে তাই এখন দেখার বিষয়। মালিক ও শ্রমিক নেতারাও এ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। তাছাড়া করোনার সর্বোচ্চ সংক্রমণের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক করার ঘোষণা সঙ্কটের মাত্রা আরও বাড়াতে পারে শুরু থেকেই এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরাও। রবিবার থেকে সড়কপথে গণপরিবহন চলাচল শুরু হয়। প্রথমদিনের থেকে দ্বিতীয়দিনে স্বাস্থ্যবিধি আরও ঢিলেঢালা দেখা গেছে। সরেজমিন নগরীর অন্তত ২০টির বেশি পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ গণপরিবহন স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছে। তবে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করার নির্দেশনা মানছে ৯০ ভাগ বাস। এর বাইরে বাদবাকি নির্দেশনা মানার বালাই নেই। চালকসহ হেলপাররা বলছেন, মালিকপক্ষ থেকে সুরক্ষার জন্য কোনকিছু দেয়া হয়নি। তাই তারা এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেননি। তবে বেশি যাত্রী পরিবহন নিয়ে তাদের বক্তব্য হলো যাত্রীরা জোর করে গাড়িতে উঠে যায়। অনেক সময় ভিড় থাকলে জানালা দিয়েও যাত্রী ওঠানামা করছেন। তবে যাত্রী ও চালকদের কোন কোন ক্ষেত্রে মাস্ক পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। দরজায় কন্ডাক্টর দাঁড়িয়ে দিব্যি যাত্রী তুলতে দেখা গেছে। গা ঘেঁষে ঘেঁষে নামা ওঠা করেন যাত্রীরা। বাস বাদে লেগুনা, মোটরসাইকেল, অটোরিক্সায় স্বাস্থ্যবিধি মানার একেবারেই বালাই নেই। লেগুনায় যত সিট তত যাত্রী, এমনকি দাঁড়িয়ে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। মেক্সিগুলোও একইভাবে যাত্রী পরিবহন করেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর অফিস চালুর দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবারও সড়কে অফিসগামী মানুষের খুব একটা ভিড় দেখা যায়নি। অধিকাংশ অফিসগামী চাকরিজীবীকে রিক্সা কিংবা হেঁটেই গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। এ সময় লেগুনাসহ ছোটখাট পরিবহনগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। সকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়। খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় দেখা গেছে, চাকরিজীবীদের অধিকাংশই হেঁটে অফিসের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। আবার কেউ কেউ রিক্সা ও লেগুনাতে উঠে বসেছেন। তবে লেগুনাগুলোতে কোনও স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। প্রতিটি লেগুনাতেই গাদাগাদি করে বসতে দেখা গেছে। এসব পরিবহনে হ্যান্ড সানিটাইজার বা জীবাণুনাশক ছিটানোরও ব্যবস্থা নেই। একই চিত্র বাসাবো এলাকায়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা ও সিএনজিযোগে অফিসগামী মানুষকে এসে নামতে দেখা গেছে। তবে এখান থেকে যেসব বাস ছেড়ে গেছে, সেগুলোতে পাশাপাশি দুটি সিটের একটি করে ফাঁকা রাখতে দেখা গেছে। বাসগুলোতে যাত্রী উঠানোর সময় হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও শরীরের তাপমাত্রা মাপতে দেখা যায়নি। তাছাড়া অধিকাংশ এলাকায় যাত্রীদের ধরে বাসে উঠাতেও দেখা গেছে। মিডওয়ে পরিবহনের হেল্পার রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র ও হ্যান্ড সানিটাইজার আমাদের দেয়া হয়নি। যাত্রী যখন গাড়িতে ওঠেন, তখন আমি দরজা থেকে নেমে সরে দাঁড়াই। আমরা নির্ধারিত আসনের বাইরে কোনও যাত্রী বাসে তুলছি না। আসলে যাত্রীরাও এখন অনেক সচেতন।’ গুলিস্তান, বঙ্গবাজার, নগরীর জিরোপয়েন্ট, দৈনিক বাংলা, শাহবাগ, বাসাবো, কমলাপুর, মতিঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, কাকরাইল, বাড্ডা, বাংলামটর, কাওরানবাজার ও ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেশিরভাগ বাসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি না মানার চিত্র দেখা গেছে। এমনকি কোন বাসেই ভাড়ার তালিকাও দেখা যায়নি। ইচ্ছেমতো ভাড়া নেয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা। বাড়তি ভাড়াকে কেন্দ্র করে বাস সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যাত্রীদের কাথা কাটাকাটি হয়েছে। বৈশাখী পরিবহনের যাত্রী মিনার জানান, বাসের কিছু অংশে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাইদা পরিবহনের হেলপার আলাল বলেন, মালিকপক্ষ থেকে আমাদের সুরক্ষার জন্য কিছু দেয়া হয়নি। তাই যাত্রীদের কিছু দিতে পারিনি। প্রজাপতি পরিবহনেও সুরক্ষার বালাই নেই। ট্রাস্ট পরিবহনে সুরক্ষা পালনে নজির বলা যায়। গণপরিবহনে প্রথমদিনে অধিকংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও কোথাও কোথাও তা না মানার অভিযোগও পাওয়া গেছে বলে জানিয়ছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি এ সঙ্কটে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব মেনে গণপরিবহন পরিচালনার জন্য আবারও অনুরোধ জানান। মন্ত্রী মঙ্গলবার সংসদভবন এলাকার বাসভবন থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন-বিআরটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে এ আহ্বান জানান। করোনার সংক্রমণরোধে সবাইকে দৃঢ় মনোবল নিয়ে নিজ নিজ গৃহ এবং কর্মস্থলে সচেতনতার প্রাচীর নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, সোমবার থেকে শর্তসাপেক্ষে সারাদেশে গণপরিবহন চলছে। প্রথমদিনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও স্বাস্থ্যবিধি না মানার অভিযোগও পাওয়া গেছে। যাত্রী সাধারণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, সচেতনতা বোধ ও সামাজিক দূরত্ব যথাযথ প্রতিপালনের মধ্য দিয়ে আমরা এ সংক্রমণ রোধ করতে পারি। নিজেদের অবহেলা ও শৈথিল্য দুর্যোগ আরও ঘণীভূত করতে পারে। এদিকে কমলাপুরে গিয়ে দেখা গেছে, মাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে চলার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে। প্লাটফরমে প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে জীবাণুনাশক টানেল। সবার গায়ের তাপমাত্রা মেপে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। রোদের কারণে যাদের গায়ে তাপমাত্রা বেশি ধরা পরে তাদের ভেতরে প্রবেশে অনুমতি দেয়া হয়নি। এরপর তাপমাত্রা স্বাভাবিক হলে ফের প্রবেশের অনুমতি মেলে। এছাড়া গেটে প্রতিটি যাত্রীর হাতে স্যানিটাইজার দেয়া হয়। মাস্ক বাধ্যতামূলক চেষ্টা করা হলেও অনেকে ফাঁকি দিয়ে মাস্ক ছাড়াই ভেতরে চলে যান। তবে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা যাত্রীদের বেশিরভাগই মাস্ক ব্যবহার করেন। প্রতিটি ট্রেন আসার পর ও যাত্রা শুরুর আগে ছিটানো হয় জীবাণুনাশক।
×