ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

করোনা সঙ্কট ॥ পরিত্রাণে এই ক্ষতি মেনে নিতে হবে

প্রকাশিত: ০১:০৭, ২৬ এপ্রিল ২০২০

করোনা সঙ্কট ॥ পরিত্রাণে এই ক্ষতি মেনে নিতে হবে

বর্তমান করোনাভাইরাস সংক্রমণের মোকাবেলায় দুনিয়া জুড়ে চলছে প্রাণিকুলের টিকে থাকার লড়াই। মানুষ ছাড়াও এই ভাইরাসের উপস্থিতি ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে বাঘ ও পোষা বিড়ালের দেহে। ফলে সামনে আমাদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে আমরা জানি না। ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী আক্রান্ত হয়েছে ২৮ লক্ষেরও বেশি মানুষ, মারা গেছে ১ লক্ষ ৯৭ হাজারের বেশি। এমন দুর্বিপাকেরকালে এর মোকাবেলায় চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল মহলে চলছে নিরন্তর প্রচেষ্টা, দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথাযথ টিকিয়ে রাখতে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তাদের জনগণ সেদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার এমন রূপ দেখে ভড়কে গেছে। সেখানে মৃত্যুর সংখ্যা এখন পর্যন্ত অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি, ফেব্রুয়ারির ২৯ থেকে শুরু হয়ে ২৫ এপ্রিল তারিখে এসে এই দুই মাসেরও কম সময়ে সে দেশে মৃত্যুর সংখ্যা ৫২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় এই মরণঘাতী ব্যাধি থাবা দিয়েছে চীন থেকে শুরু হয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশ ছুঁয়ে ইউরোপ পর্যন্ত। ধনী বা দরিদ্র দেশ কেউই করোনাভাইরাসের আগ্রাসী অত্যাচার থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি। এর অবসান কবে হবে তা জানতে জীববিজ্ঞানী ও গবেষকগণ অবিরাম গবেষণা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় মার্চে। প্রথম তিনজন আক্রান্ত শনাক্ত হয় মার্চের ৮ তারিখে। সরকারী সূত্রে মার্চের ১৮ তারিখে প্রথম মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। মাত্র পাঁচ সপ্তাহ যেতে যেতে আমাদের দেশে মৃত্যু সংখ্যা এখন ১৩১। ইতোমধ্যে সংক্রমণ বেড়ে (২৪ এপ্রিল পর্যন্ত) হয়েছে ৪৬৮৯ জন। মৃত্যুর হার শতকরা ৩ ভাগের নিচে হলেও নতুন আক্রান্ত শনাক্তের দৈনিক গড় ৮০ জনের মতো। এর মধ্যে আনুমানিক ২০ ভাগ হারে আক্রান্ত মানুষের হাসপাতালের চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন হচ্ছে। সে অনুপাতে দৈনিক ১৫-১৬ জন নতুন আক্রান্তকে হাসপাতালে সেবা দিতে হলে ও এইভাবে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকলে বিশেষজ্ঞগণ বলছেন আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিতে আমাদের দেশের হাসপাতালগুলো কুলিয়ে উঠতে পারবে না। আরও আশঙ্কা রয়েছে এই কারণে যে, বর্তমান আক্রান্তের দৈনিক গড় হার সম্ভবত আরও বাড়বে ফলে পরিস্থিতি হয়তো আরও খারাপের দিকেই যাবে। যেহেতু এই অসুখটি খুবই ছোঁয়াচে ও খুব দ্রুত অন্যকে সংক্রমিত করে, ফলে পরিস্থিতি যাতে আরও খারাপের দিকে না যায় সে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কিছু পরামর্শ দেয়া হয়েছে যাতে দেশের মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে পারে। সেসব পরামর্শের অন্যতম হলো ‘ঘরে থাকা’ যা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘লকডাউন’ নামে পরিচিত হয়েছে। মানুষকে বলা হয়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে সে যেন ঘরে থাকে ও সম্ভাব্য আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাবার কোন সুযোগ যেন তার কাজ বা জীবন যাপনের মাধ্যমে না ঘটে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতগুলোকে ছুটি দেয়া হয়েছে যাতে মানুষের পারস্পরিক সংযোগ না ঘটে। কল-কারখানা, বাজার ও দোকান-পাট খোলা রাখার নিয়ম করে দেয়া হয়েছে, সবাইকে বলা হয়েছে সেই নিয়ম সঠিকভাবে অনুসরণ করতে। এমনকি গাড়ি চলাচল সীমিত করে গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। বুদ্ধি দেয়া হয়েছে যাদের পক্ষে সম্ভব ও উপযুক্ত তারা যেন বাসায় বসে অফিসের প্রয়োজনীয় কাজ করেন ও এরকম কাজের ক্ষেত্রে যাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে তারা যেন তার যথাযথ প্রয়োগ করেন। অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে বাসা থেকে কাজ করছেন বিশেষ করে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবায় ইন্টারনেট ব্যবহার আমাদের দেশে এখন এই বিপদের দিনে অত্যাবশ্যকীয় সেবায় পরিণত হয়েছে, জনপ্রিয়ও হতে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্যে আসন্ন সংক্রামক বিপদের আশঙ্কা এখনও কাটেনি। ফলে এই নিয়ম ও পরামর্শগুলো মেনে যদি দেশের মানুষ ঘরে থাকে, আক্রান্ত না হয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তখন বাড়বে। কিন্তু বাদ সেধেছে ‘অর্থনীতি’ নামের একটি শব্দ। দেশের মানুষ বেঁচে থাকল কিন্তু কাজকর্ম বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলে এই অর্থনীতিবাবুর দশা কী হবে? শিল্পোৎপাদন ও বাজারের ওপর নির্ভর করে আমাদের যে আর্থিক ক্রিয়াকর্ম সেখানে একটি স্থবিরতা এসেছে, এই নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এটা স্বাভাবিক, আর্থিক ক্রিয়া না থাকলে ও হাতে টাকা না থাকলে দেশের মানুষ অনিশ্চয়তায় থাকবে; কী খাবে, পরবে ও সন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে? এসব নানারকম চিন্তা তাদের আচ্ছন্ন করে রাখবে আর এসব ভাবনা সামনে এসে পড়াই সঙ্গত। কিন্তু একটি বাস্তবতা আমাদের বুঝতে হবে, এই ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়েছে মাত্র মাস দুই, এর ব্যাপ্তি কতদূর হবে আমরা জানি না। সরকার দেশের মানুষকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে দেশে খাদ্যাভাব হবে না। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকার ইতোমধ্যে নানামুখী খাতে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে জানিয়েছেন তিনি তিনটি ধাপে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদের পরিকল্পনা করে রেখেছেন যাতে সবাইকে নিয়েই এই অবনত পরিস্থিতির মোকাবেলা করে সংক্রমণ শেষে আবার সোজা হয়ে আমরা জীবনধারা শুরু করতে পারি। আমাদের এও মনে রাখতে হবে এই ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে যা যা ঘটছে পৃথিবীর ছোট বড় কোন দেশই কিন্তু তা থেকে মুক্ত নয়। এর আগ্রাসী আক্রমণের কারণে একটি যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে যে কারণে এখনকার এই পরিস্থিতিকে কেউ কেউ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করছেন। এরকম একটি যুদ্ধাবস্থায় এখন মানবসমাজের টিকে থাকার প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে জীবনের এমন সঙ্কটে গোটা পৃথিবীর মানুষ একসঙ্গে কখনও পড়েনি যেখানে শত্রুকে দেখা যায় না আর অদৃশ্য সেই শত্রুকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে শুধু বুদ্ধি সচেতনতার অস্ত্র দিয়ে। আমরা যদি বেঁচে থাকি নিশ্চয়ই আবার উঠে দাঁড়াতে পারব, অন্তত মানব-সভ্যতার ইতিহাস তাই-ই বলে। জমি-জমা-টাকা-পয়সা আর বিলাসিতার যা যায় যাক, সব ক্ষতি আমাদের মেনে নিতে হবে। ফলে টাকা পয়সা আর ধন- দৌলতের চিন্তা না করে আমাদের একটি সুযোগের সদ্ব্যবহার করা দরকার সে হলো সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্মিলিত যুদ্ধে অংশ নেয়া। এমন একটি অভিন্ন লড়াইয়ে একসঙ্গে কাজ করবার সুযোগ বিশ্বের মানুষ একসঙ্গে পেয়েছে খুবই কম। আমাদের শুধু মাথায় রাখতে হবে শিশুদের আমরা কী বলছি, তাদের সত্য বুঝবার বাস্তবতার মধ্যে আমরা রাখছি কিনা, কেন সে ঘরের বাইরে যেতে পারছে না তা সে কতখানি উপলব্ধি করতে পারছে। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে তাদের আমরা সবটুকু বোঝাতে পারছি কিনা যে এরকম একটি পরিস্থিতির জন্যে মানুষ দায়ী নয়। এই ভাইরাস একটি অতিপ্রাকৃত দানব সমতুল্য বটে তবে প্রাকৃতিক। আমাদের কিন্তু বুঝতে হবে যে শিশু এমন একটি পরিস্থিতি দেখছে তার মূল্যায়ন একদিন সে-ই করবে। তখন যেন আমাদের কোন ভুল তার হাতে ধরা না পড়ে অর্থাৎ আমরা যেন এখন কোন ভুল না করি। আমাদের মাথায় রাখতে হবে আমরা যে পৃথিবী রেখে যাচ্ছি তা আমাদের জন্যে আমাদের মতো আর থাকবে না। সে হবে আজকের শিশুদের জন্যে এক নতুন পৃথিবী। হয়তো সে পৃথিবীতে আর করমর্দন বা আলিঙ্গন থাকবে না। মানুষ আর কখনও প্রিয়জনের গা ঘেঁষে বসবে না কিন্তু সে পৃথিবীকে সে সাজিয়ে নেবে নিজের মতো করেই। আমরা জানি না করোনা-উত্তর নতুন পৃথিবীতে অর্থনৈতিক বৈষম্য আর থাকবে কিনা, কিন্তু এখন সময় হয়েছে সে বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্নে আমরা যেন কোন বিভক্তির অবকাশ না রাখি। মানুষে, সমাজে আর রাষ্ট্রে কোন বিভাজন না রাখে সে চিন্তা করে আমাদের এখন প্রথম উপায় হলো পরামর্শ অনুধাবন করে সেগুলো অনুসরণ করা। ‘ঘরে থেকে’ বিনা পয়সায় এমন চিকিৎসা পরামর্শই আমাদের জনে এনে দিতে পারে একটি নতুন শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার সভ্যতা। আমাদের তাই ধৈর্য ধরে সে ভাবনাই ভাবতে হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×