ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পহেলা বৈশাখ বন্ধের পর রমজানের ঈদ কেনাকাটাও হুমকিতে

উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসাবাণিজ্য বিপর্যয়ের মুখে

প্রকাশিত: ১১:১৬, ৯ এপ্রিল ২০২০

উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসাবাণিজ্য বিপর্যয়ের মুখে

এম শাহজাহান ॥ প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রকোপে উৎসবকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। পহেলা বৈশাখের উৎসব বন্ধ হওয়ার পর এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আগামী রমজানের ঈদকেন্দ্রিক বাণিজ্যও। এছাড়া আজ সারাদেশে পালিত হবে পবিত্র শব-ই-বরাত। শব-ই-বরাতের আগেও সারাদেশের মানুষ ভোগ্যপণ্য কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকে। ফলে এই সময় ব্যবসায়ীরা ভাল মুনাফা করে থাকেন। কিন্তু এবার ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে দোকানপাটগুলো নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ রাখা হচ্ছে। এছাড়া ভোক্তাগণও কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্যে এবার বড় ধসের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ পরিস্থিতিতে আগামী দিনে সামগ্রিক অর্থনীতিতেও বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, উৎসবকেন্দ্রিক কেনাকাটা বরাবরই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখ দেশে পালিত হচ্ছে। বড় হয়েছে এই উৎসবের অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গর্ব করার মতো এই যে জিডিপি বা মোট দেশজ উৎপাদন, তাতে উৎসবকেন্দ্রিক অর্থনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে মনে করেন অর্থ বিশেষজ্ঞরা। শুধু পহেলা বৈশাখে গত কয়েক বছর ধরে ১৪ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। সর্বজনীন উৎসব হিসেবে স্বীকৃত পহেলা বৈশাখের ব্যাপ্তি সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে সরকারী চাকরিজীবীরা উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। এছাড়া বেসরকারীখাতের অনেক প্রতিষ্ঠানে এই ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এই উৎসবকে ঘিরে। কিন্তু করোনার প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেল বৈশাখকেন্দ্রিক সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য। এছাড়া এপ্রিলের শেষ নাগাদ রমজান মাস শুরু হচ্ছে। রমজানের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশে টেইলরিং ও থান কাপড়ের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠে। এছাড়া সারা মাস পোশাক-আশাকসহ সব ধরনের বেচাবিক্রি হয়ে থাকে। চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সরবরাহ ও জোগান দিতে ঈদের অন্তত এক থেকে দুই মাস আগে ব্যবসায়ীরা প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু করোনার প্রকোপে এবার ব্যবসায়ীরা কোন প্রস্তুতি নিতে পারেননি। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী ঈদের বাণিজ্যেও বিপর্যয় নামার ঝুঁকি রয়েছে। রোজার ঈদেও ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার কেনাকাটা হয়ে থাকে সারাদেশে। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে আগামী দিনের উৎসবকেন্দ্রিক বাণিজ্য নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এদিকে, বাণিজ্য সংগঠনগুলো সরকারী ছুটির তালিকা অনুসরণ করে ইতোমধ্যে আগামী ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত মার্কেট, শপিংমল ও ফ্যাশন হাউসগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া সরকারী ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হলে ছুটি বাড়াবে বাণিজ্য সংগঠনগুলো। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে বেঁচে থাকার ওপর। বেঁচে থাকলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকবে দ্বিতীয় পদক্ষেপে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ হেলাল উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে এ মুহূর্তে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করছে ব্যবসায়ীরা। জীবন বাঁচলে পরবর্তীতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হবে। সাধারণ মানুষের মতো ব্যবসায়ীরাও আগে বাঁচতে চায়। আর এ কারণে সব দিক বিবেচনায় নিয়ে এ মুহূর্তে বাণিজ্যের কথা ভাবা হচ্ছে না। তবে এটা ঠিক চলমান সঙ্কটে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। লাখ লাখ শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই এখন লকডাউন হয়ে আছেন। করোনার প্রকোপ দূর হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং সঙ্কট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি প্রস্তাব দেয়া হবে। আশা করছি, ব্যবসাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী ওই সময় ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াবেন। জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপে ঈদকেন্দ্রিক কোন প্রস্তুতি নিতে পারেনি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। এই সময় যেসব ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে তারও প্রস্তুতি শুরু হয় দুই থেকে আড়াই মাস আগে। কিন্তু এবার করোনার প্রভাবে সেই প্রস্তুতিতেও পিছিয়ে পড়ছেন ব্যবসায়ীরা। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকায় শিল্পের উৎপাদন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অথচ এই সময় সারাদিন-রাত পরিশ্রম করে কারখানার শ্রমিকরা তৈরি করেন পোশাক, পাঞ্জাবিসহ ঈদের সব পোশাক। ঢাকার পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী এবং মানিকগঞ্জের বিভিন্ন কারখানায়ও তৈরি হয় ঈদের পোশাকসহ অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। কিন্তু এসব এলাকার বেশিরভাগ কারখানা এখন বন্ধ রাখা হয়েছে। শ্রমিকদের জানমাল রক্ষায় সব ধরনের কারখানা বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। এছাড়া নিট উৎপাদনকারী মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ থেকেও কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন সেলিম ওসমান। করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষায় শিল্প মালিকরা এখন কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বড় ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। উৎপাদনমুখী সব শিল্প যাতে সঠিকভাবে এখান থেকে সুবিধা পেতে পারে সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার হলে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এদিকে, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারাদেশে বিভিন্ন পণ্যের ছোট-বড় প্রায় ২৬ লাখ দোকান রয়েছে। বৈশাখসহ ঈদবাণিজ্য ধরতে দোকানদারদের এখন ব্যস্ত সময় পার করার কথা। কিন্তু তারা এখন কর্মহীন হয়ে অলস সময় পার করছেন। একইসঙ্গে বকেয়া আদায়ে নতুনভাবে হালখাতার আয়োজন করা হয় পহেলা বৈশাখে। কিন্তু এখন দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কবে নাগাদ করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে সেই তথ্য সবার অজানা। বরং বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশে লকডাউনের সময় বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে সরকারী ছুটি মোতাবেক দোকানপাট, মার্কেট ও শপিংমল বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি ও ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতি। দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে এর আগে ৩১ মার্চ পর্যন্ত দোকানপাট বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এখন ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ সব ধরনের মার্কেট (কাঁচাবাজার ব্যতীত) বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। চলমান এই সঙ্কটে ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সম্প্রতি জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীরা খাতভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেব করছেন। এছাড়া রফতানিখাতে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। তবে আশার কথা, ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি খাতের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এছাড়া ৭৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এতে দেশের অন্য খাতেও সরকারী সাহায্য সহযোগিতা আসবে। আশা করছি, সরকারী-বেসরকারী খাতের যৌথ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে দেশের বাণিজ্যিক কর্মকা-। জানা গেছে, আজ ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সারাদেশে পবিত্র শব-ই-বরাত পালিত হবে। মানুষেন জীবন বাঁচানোর তাগিদে সব ধরনের কাঁচাবাজার, ফার্মেসি ও মুদিপণ্যের দোকান চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে কাঁচাবাজারে পণ্য সরবরাহ নির্বিঘœ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া সহজলভ্যে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে নিত্যপণ্য পৌঁছে দিতে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয় ওএমএস বা খোলাবাজারে ১০ টাকা কেজির চাল বিক্রি শুরু করেছে। এতে করে বাজারে নতুন করে আর জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি। শব-ই-বরাতে ক্রেতারা চাহিদা অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য সংক্রান্ত মনিটরিং টিম।
×