ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বেশি বেশি পরীক্ষার উদ্যোগ সরকারের

করোনা চিকিৎসায় নির্দিষ্ট অনেক হাসপাতালে প্রস্তুতির অভাব

প্রকাশিত: ১০:৩৪, ২ এপ্রিল ২০২০

করোনা চিকিৎসায় নির্দিষ্ট অনেক হাসপাতালে প্রস্তুতির অভাব

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। সারাবছর বিশাল এই হাসপাতালজুড়ে শুনশান নীরবতা থাকে। ব্যস্ত সময়ে এখানে ভিড় চোখে পড়ে না। রোগীর সংখ্যা একেবারেই থাকে হাতেগোনা। নোভেল করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালটি নির্দিষ্ট করেছে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ। মঙ্গলবার হাসপাতাল গেট থেকেই শোনা যাচ্ছিল ঠক ঠক শব্দ। চারদিকে কাজ চলছে। কোথাও ড্রেনেজ লাইন সংস্কার। কোথাও রং করার কাজ। কোথাও চলছে রুম মেরামত। চলছে দেয়াল সংস্কারসহ নানা কর্মযজ্ঞ। ভেতরে রোগী নেই। করোনার জন্য চিকিৎসা নিতেও কেউ আসেনি। জানা গেছে, অবহেলায় পড়ে থাকা রেলওয়ে হাসপাতালটি কার্যকর করতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল। তাতে অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। হাসপাতালে রোগীর আনাগোনাও বাড়েনি। প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সৈয়দ ফিরোজ আলমগীর বলেন, ভবনটি পুরোপুরি তৈরি হতে অন্তত দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। এরপর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহের ওপর নির্ভর করবে চিকিৎসা শুরুর কার্যক্রম। এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া গেলেও আইসিইউ সেবা দেয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমরা করোনা চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এই মুহূর্তে সেবা চালু সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমাদের চিকিৎসা সেবা চালুর জন্য কিছু ডাক্তার দেয়া হয়েছে। আরও অন্তত ১০ জন নার্সসহ কিছু ডাক্তার প্রয়োজন। সব মিলিয়ে এই হাসপাতাল পুরোপুরি চালু হলেও মাঝারি মানের সেবা দেয়া সম্ভব হবে। রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা আবদুল আহাদ বলেন, হাসপাতালে আটজন চিকিৎসক যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কোন যন্ত্রপাতি আসেনি। ভবন প্রস্তুত হলে তারা নিজেদের ১৫টি শয্যা তৈরি করবেন। তবে সরকার থেকে সরবরাহ করা হলে ১০০টি পর্যন্ত শয্যা বসানোর সুযোগ আছে। এতো গেল একটি হাসপাতালের চিত্র। ‘সরকারী সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই হাসপাতালে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জরুরী চিকিৎসাব্যবস্থা সংযোজনের প্রক্রিয়া চলছে। এখনও হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা চালু হয় নাই। সুতরাং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত অথবা করোনাভাইরাস সংক্রমণের সন্দেহভাজন রোগীদের সরকারঘোষিত অন্য হাসপাতালে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হইল।’ ‘জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে’ ওপরের এই বিজ্ঞপ্তিটি সাঁটানো হয়েছে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের প্রধান ফটকে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে যে কয়টি হাসপাতাল সরকার নির্ধারণ করেছে, এ হাসপাতালটি তার একটি। এই হাসপাতালে ১৭৫ করোনা রোগীর সেবা দেয়া সম্ভব হবে। তবে এখনও নাকি আইসিইউ প্রস্তুত হয়নি। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ফারুক আহমেদ জানান, চিকিৎসা কাজে যারা হাসপাতালে নিয়োজিত আছেন তাদের প্রশিক্ষণের যথেষ্ট অভাব আছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এখনও পাঠানো হয়নি। তিনি জানান, হাসপাতালে নার্স, ওয়ার্ড বয়, ক্লিনার সঙ্কট রয়েছে। এর পরও দ্রুত সময়ে কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী অন্তত এক সপ্তাহ পর করোনা চিকিৎসা সেবা চালু সম্ভব হবে। চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া এই ভাইরাস এখন বিশ^জুড়ে ছড়িয়েছে মহামারী আকারে। ২০০’র বেশি দেশ এখন আক্রান্ত। প্রতিরোধে গোটা বিশ^ প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এখন পর্যন্ত দুনিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় নয় লাখ। মৃত্যু হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪২ হাজার মানুষের। বাংলাদেশও আক্রান্ত হয়েছে গত আট মার্চ থেকে। এখন পর্যন্ত দেশে করোনার রোগীর সংখ্যা ৫৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ২৬ জন, মৃত্যু হয়েছে ছয় জনের। করোনা প্রতিরোধে বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নেয়া হয়েছে নানা রকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। বিশে^র প্রায় ৩৫টি প্রতিষ্ঠান কোভিড-১৯ টিকা তৈরির চেষ্টা জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছি। সবার নজর এখন প্রতিষেধক তৈরির দিকে। ১১ হাসপাতালে চিকিৎসা ॥ এদিকে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এখন পর্যন্ত ১১টি হাসপাতালের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। ৩০ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে এসব হাসপাতালের নাম জানানো হয়। যদিও এরমধ্যে বেশিরভাগ হাসপাতালে আগে থেকেই করোনা সেবা কার্যক্রম চালু ছিল। নির্ধারিত এসব হাসপাতালের মধ্যে সাতটি সরকারী ও চারটি বেসরকারী। এরমধ্যে একটি হাসপাতাল মুন্সীগঞ্জে। তালিকাভুক্ত হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, সংক্রমণ রোগ ব্যাধি হাসপাতাল, শেখ রাসেল গেস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, মহানগর হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল। বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মধ্যে রয়েছে, সাজিদা ফাউন্ডেশন, রিজেন্ট হাসপাতাল (উত্তরা/মীরপুর), ইউনাইটেড হাসপাতাল (মুন্সীগঞ্জ) ও আকিজ গ্রুপ। যদিও আকিজ গ্রুপের হাসপাতাল তৈরির কাজ শুরুর পর্যায়েই বন্ধ হয়ে গেছে। শুধুমাত্র করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবক’টি এখনও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি। সবক’টিতে নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্সসহ প্রয়োজনীয় জনবল। তেমনি অভাব আছে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামেরও। কোন কোন হাসপাতাল প্রস্তুত করতে এখনও সময় লাগবে কমপক্ষে ১৫ দিন। সবক’টিতে আইসিইউ সেবা নেই। মাত্র ২৯টি আইসিইউ প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয়েছে কোভিট-১৯ প্রতিরোধ যুদ্ধ। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে পর্যায়ক্রমে সবকিছু স্বাভাবিক হবে। তবে ঢাকা মেডিক্যাল করোনা চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম শুরুর প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সরকার জনগণকে অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করলেও অনেকে এ নির্দেশনা মানছেন না। রাজধানীসহ সারাদেশে অনেকেই রাস্তায় বের হচ্ছেন, বাজারে ঘোরাফেরা করছেন ও চায়ের স্টলে আড্ডা মারছেন। বিশেষ করে ঢাকা থেকে যারা গেছেন তারাই ঘোরাফেরা বেশি করছেন। দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবেন না। ঘরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। রাজধানীসহ সারাদেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা চাই না কেউ পরীক্ষার বাইরে থাকুক। কারও মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলে নমুনা পরীক্ষার জন্য আইইডিসিআরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করুন। নিজে সুস্থ থাকুন, পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন। তিনি বলেন, সবকটি হাসপাতাল প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভয়ের কারণ নেই। পরীক্ষা বাড়ানো হবে। হাসপাতালের সংখ্যা ॥ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য মতে, দেশে সরকারী হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। আর বেসরকারী হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে অনুমিত জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। সেই হিসাবে প্রতি ১ হাজার ১৫৯ জন ব্যক্তির জন্য হাসপাতালে একটি শয্যা রয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের অসুস্থতা গুরুতর হয়ে উঠলে শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। চীন, ইতালিসহ যেসব দেশে বেশি রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, সেখানে নিউমোনিয়া, ফুসফুসের জটিলতার কারণেই বেশিরভাগ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার এক পর্যাযয়ে এই রোগীদের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে (আইসিইউ) প্রয়োজনের তুলনায় শয্যার সঙ্কট আছে। সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে মোট আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৬৯টি। এর মধ্যে সরকারী হাসপাতালে রয়েছে ৪৩২টি (ঢাকায় ৩২২, ঢাকার বাইরে ১১০) আর বেসরকারী হাসপাতালে রয়েছে ৭৩৭টি (ঢাকা মহানগরীতে ৪৯৪, ঢাকা জেলায় ২৬৭, অন্যান্য জেলায় ২৪৩)। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সরকারী স্বাস্থ্যখাতে কর্মরত মোট চিকিৎসকের সংখ্যা বর্তমানে ২৫ হাজার ৬১৫ জন। আর চিকিৎসক, সেবিকা ও নানা পর্যায়ের হাসপাতাল কর্মী মিলে মোট জনবল কর্মরত রয়েছেন ৭৮ হাজার ৩০০ জন। স্বাস্থ্যখাতের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় দাবি করছেন যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় তারা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন। আইইডিসিআর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে এই বিষয়ে সমস্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই সেটা আরও ভাল অবস্থানে নেয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে যেহেতু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আমরা পরবর্তী স্তরের দিকে যাচ্ছি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকায় নির্ধারিত হাসপাতালের বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে করোনা চিকিৎসা সেবা শুরু হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনা ইউনিট প্রস্তুত করা হয়েছে। আস্তে আস্তে সবকিছু সচল হবে। চিকিৎসা সেবা মিলবে ঢাকা মেডিক্যালে ॥ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের কারও নোভেল করোনাভাইরাসের উপসর্গ রয়েছে বলে সন্দেহ হলে সেখানেই তাদের এই পরীক্ষার বন্দোবস্ত হচ্ছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসিরউদ্দিন বুধবার বলেন, মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ তলায় ভাইরোলজি বিভাগে এই পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষার জন্য কিটের কোন সমস্যা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই পরীক্ষা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হবে। ডেঙ্গুর সময় যেভাবে বিনামূল্যে করেছিলাম এখনও সেভাবে হবে। করোনাভাইরাস সন্দেহ হলে আইইডিসিআরসহ ঢাকার অন্যান্য যেসব হাসপাতালে এই পরীক্ষা চালু হয়েছে সেগুলোতেও রোগীরা যেন যান, সেই পরামর্শ দেন ঢাকা মেডিক্যালের পরিচালক। এখানে নোভেল করোনাভাইরাসের পরীক্ষা হয় শুনলে সবাই যাতে চলে না আসনে। কারণ হাসপাতালে ভর্তি, জরুরী বিভাগ ও বহির্বিভাগে আসা রোগীদের মধ্যে যাদের কোভিড- ১৯ ভাইরাসের উপসর্গ সন্দেহ করা হবে, শুধু তারাই ওই বিভাগে পরীক্ষা করাতে পারবেন। পরীক্ষার ফলাফল দ্রুতই পাওয়া যাবে জানিয়ে ব্রিগেডিয়ার নাসির বলেন, এই পরীক্ষার সঙ্গে আইইডিসিআরসহ যে যে সংস্থা সংযুক্ত থাকার কথা সেসব সংস্থা যুক্ত রয়েছে।
×