ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব গণমাধ্যমে ২৫ মার্চ

প্রকাশিত: ১১:২৯, ২৫ মার্চ ২০২০

বিশ্ব গণমাধ্যমে ২৫ মার্চ

মোরসালিন মিজান ॥ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সংঘটিত গণহত্যা ঢাকায় থেকেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক। পাকিস্তানীদের চোখ এড়িয়ে এসব খবর সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তারা। সাহসী সাংবাদিকদের প্রতিবেদন পরে বিশ্বগণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগৃহীত দুর্লভ পত্রপত্রিকা দিচ্ছে আরও অনেক তথ্য। বহুকালের পুরনো পত্রিকা, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পড়ে গা শিউরে ওঠে আজও। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার নিরীহ নির্দোষ এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী। ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় তারা। জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন অগণিত মানুষ। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের এ নিষ্ঠুরতার খবর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগেনি। সে সময়ের বেশ কিছু দৈনিক পত্রিকা ঘেঁটে দেখা যায়, ২৫ মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ছাড়াও ঢাকার অন্য হোটেলে অবস্থান করছিলেন একাধিক বিদেশী সাংবাদিক। তাদের একজন ছিলেন এসোসিয়েট প্রেসের রিপোর্টার আরনল্ড জেটলিন। অন্যজন আলোকচিত্রী মিশেল লরেন্ট। দুজনই পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী। অপারেশন সার্চলাইট চলাকালেই তারা শহরে বেরিয়ে পড়েন। পাকিস্তান বাহিনীর চোখ এড়িয়ে গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহে ব্যস্ত হন। তাদের পাঠানো তথ্য বলছে, ২৭ মার্চ সকাল অবধি ঢাকা নগরীতে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার নিরীহ নির্দোষ মানুষকে হত্যা করা হয়। দি নিউইয়র্ক টাইমসের এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন থেকে যায়, ২৫ মার্চ রাতে তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের অতিথি তালিকায় সায়মন ড্রিং ছাড়াও ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিকের নাম ছিল। এই ৩৫ জনের সবাই হোটেলের বাইরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি চান। কিন্তু অনুমতি না পেয়ে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তারা। সাংবাদিকদের ঠেকাতে হোটেলের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক মেজর তাদের গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। বলেন, ‘ইট ইজ গোয়িং টু বি টু ব্লাডি। বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমরা আমাদের লোকদের যদি গুলি করতে পারি, আপনাদের উপরেও গুলি করতে পারব।’ এ অবস্থায় হোটেলের ভেতরে অবস্থান করতে বাধ্য হন তারা। পরদিন ২৭ মার্চ সকালে বাংলাদেশ ছাড়া করতে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিমানবন্দরে। সেখানে প্রত্যেককে বিবস্ত্র করে তল্লাশি চালানো হয়। সাংবাদিকদের ক্যামেরা ফিল্ম টাইপ রাইটার নোটবইসহ সংবাদ লেখার প্রয়োজনীয় সব উপকরণ কেড়ে নেয়া হয়। পরে ঢাকা থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় করাচিতে। সেখান থেকে বিদেশী সাংবাদিকদের কেউ কেউ ব্যাংককে যান। কেউ কেউ যান ভারতের বোম্বেতে। দি নিউইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক সিডনী এইচ শ্যনবার্গ বোম্বে গিয়ে নিজের প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি তার প্রতিবেদনে পাকিস্তানী সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণ এবং সমগ্র ঢাকা নগরীজুড়ে তাদের হত্যাকা-ের বিবরণ দেন। প্রতিবেদনটি তার পত্রিকায় ২৮ মার্চ প্রকাশিত হয়। ৩০ মার্চ লন্ডনস্থ দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গণহত্যার খবর। বিখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের পাঠানো প্রতিবেদনে গণহত্যার বিস্তারিত বিবর ওঠে আসে। জানা যায়, ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলেও ২৬ মার্চ গোটা দিন এবং ২৭ মার্চ সন্ধ্যার পর থেকে ফের চলে বাঙালী নিধন। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমণ শুরুর সময় তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিদেশী সাংবাদিকদের। কিন্তু এর আগেই হোটেলের ছাদে আত্মগোপন করতে সক্ষম হন প্রখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। হোটেলের অতিথি তালিকায় নাম থাকলেও তাকে খুঁজে বের করতে পারেনি পাকিস্তান বাহিনী। সায়মন ড্রিং আগেই হোটেল ছেড়ে গেছেন বলে ধারণা করেন তারা। পরবর্তী সময়ে ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেয়া হলে হোটেলের বাইরে এসে সংবাদ সংগ্রহের কাজ করেন সায়মন ড্রিং। একই দিন তার প্রতিবেদনটি ছাপা হয় বিখ্যাত ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায়। সংগৃহীত পত্রিকা ঘেটে দেখা যায়, গণহত্যার খবরের সূত্র ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ২৫ মার্চের একাধিক ঘোষণা কলকাতা থেকে রেডিও মনিটরিং করে এসোয়িটেড প্রেস, রয়টার্স ও দি ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল। তারা বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে গণহত্যার খবরটি যতদ্রুত সম্ভব বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ২৬ মার্চের কাগজ ২৫ তারিখ রাত ১০টার মধ্যে ছাপা হয়ে যায়। এ কারণে পরের দিন ভারতবর্ষের অনেক পত্রিকা ঘেটে গণহত্যা কিংবা ক্র্যাকডাউনের খবর পাওয়া যায়নি। একই কারণে এশিয়া আফ্রিকা মহাদেশ থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র গণহত্যার খবর দিতে পারেনি। বরং কোন কোন পত্রিকায় লেখা হয়, ইয়াহিয়া খান ঢাকায় অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলোচনা অব্যাহত আছে। তবে সময়ের পার্থক্যের কারণে গণহত্যার সংবাদ প্রকাশে এগিয়ে ছিল উত্তর আমেরিকার পত্রিকাগুলো। এসব পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে গণহত্যার খবর ছাপা হয়। বার্তা সংস্থাগুলো থেকে নেয়া সংবাদের ভাষা প্রায়শই এক এবং অভিন্ন। ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটস থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত সংবাদপত্র দি সান বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে লিখে: ঐব ংধরফ ‘ঃযবু শরষষবফ ধ হঁসনবৎ ড়ভ ঁহধৎসবফ ঢ়বড়ঢ়ষব.’ ‘চবড়ঢ়ষব ধৎব ভরমযঃরহম মধষষধহঃষু রিঃয ঃযব বহবসু ভড়ৎ ঃযব পধঁংব ড়ভ ভৎববফড়স ড়ভ ইধহমষধ উবংয.’ ঐব পধষষবফ ড়হ ‘বাবৎু ংবপঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধ উবংয ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব বহবসু ভড়ৎপবং ধঃ ধহু পড়ংঃ.’ একই দিন বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে আলাস্কার একটি সংবাদপত্রে লেখা হয়: ‘ঝযবরশয গঁলরন পযধৎমবফ ঃযধঃ ঃযব ধৎসু যধফ ধঃঃধপশবফ ঃড়ি নধংব ড়ভ ঃযব ঊধংঃ চধশরংঃধহ জরভষবং, ঞযব ঢ়ৎড়ারহপরধষ সরষরঃরধ, ধঃ সরফহরমযঃ, দশরষষরহম ধ ষড়ঃ ড়ভ ঁহধৎসবফ ঢ়বড়ঢ়ষব.’ নর্থ ইস্টার্ন কেলিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত ‘দি টাইমস স্ট্যান্ডার্ড’ একইভাবে শেখ মুজিবকে উদ্ধৃত করে গণহত্যার খবর দেয়। তবে একটি দুটি নয়, অসংখ্য পত্রিকায় এই খবর আসে। ২৬ মার্চ সকালে উত্তর আমেরিকার কয়েক হাজার পত্রিকায় গণহত্যার খবর বের হয়। আর ২৭ মার্চ সারা দুনিয়ার পত্রিকায় এসেছে গণহত্যার খবর। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব খবর বাঙালী নিধনের বিবরণ তুলে ধরার পাশাপাশি, বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে।
×