ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অনির্দিষ্টকালের জন্য ট্রেন, লঞ্চ ও ফেরি চলাচল বন্ধ ;###;২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন ;###;পরিবহনে জরুরী সেবা অব্যাহত থাকবে

লকডাউন ॥ যোগাযোগ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ১১:২৩, ২৫ মার্চ ২০২০

লকডাউন ॥ যোগাযোগ ব্যবস্থা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ^ব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মোকাবেলায় লকডাউন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা। সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। ট্রেন, নৌযান ও ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়েছে মঙ্গলবার থেকেই। ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে বন্ধ হচ্ছে গণপরিবহন চলাচল। ইতোমধ্যে চারদেশ বাদে দেশের আন্তর্জাতিক সকল রুটে বিমান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগও বন্ধ রয়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সবকিছু লকডাউন করার বিকল্প নেই। দেশের সবকিছু স্থবির করে দিতে পারলেই এই রোগের মহামারী ঠেকানো সম্ভব হবে। এজন্য সবাইকে সতেচন হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তাদের মতে, চীনের উহান প্রদেশ থেকে কোভিড-১৯ দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার ইতালিতে। করোনার সংক্রমণে বিশ^ব্যাপী দুই থেকে চারভাগ মৃত্যু হলে ইতালিতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেয়া ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়া। রোগটি ইতালিতে ছড়িয়ে পরার পর সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এই প্রেক্ষাপটে দেশে করোনার প্রভাব ঠেকাতে দ্রুত ও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। অন্যথায় সংক্রমের মাত্রা বাড়ার পাশাপাশি মৃত্যুহার বাড়ার আশঙ্কাও করছেন তারা। ইতোমধ্যে দেশে করোনাভাইরাসে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো চার জনে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এই তথ্য জানান। মঙ্গলবার ফেসবুক লাইভে তিনি এই তথ্য প্রকাশ করে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৯২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ছয় জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। যিনি মারা গেছেন তার বয়স ৭০ বছরের বেশি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত ব্যক্তিসহ নতুন করে ছয় জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত করোনা শনাক্ত রোগী ৩৯ জন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে একজনের বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস আছে বলে জানান ফ্লোরা। তিনি সৌদি আরব থেকে ওমরাহ করে এসেছেন। বাকিরা অন্য করোনা আক্রান্তদের কন্টাক্টে আসেন। এই কর্মকর্তা জানান, এখন আইসোলেশনে আছে ৪০ জন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৪৬ জন। করোনাভাইরাসে দুনিয়াজুড়ে মৃতের সংখ্যা ১৬ হাজার ৫৬৮ জনে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক জরিপ পর্যালোচনাকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওমিটারের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক মহামারীতে এ পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৫ দেশ ও অঞ্চলে তিন লাখ ৬৬ হাজার ৯৫৬ জন আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসা গ্রহণের পর সুস্থ হয়ে উঠেছে এক লাখ ২ হাজার ৫০১ জন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। উৎপত্তিস্থল চীনে ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হলেও সেখানে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কমে গেছে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। চীনের বাইরে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ১৩ গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত ১১ মার্চ দুনিয়াজুড়ে মহামারী ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ছোঁয়াচে করোনাভাইরাস ইস্যুতে আজ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে দেশজুড়ে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে নামানো হয়েছে সেনাবাহিনী। দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়িয়ে নয় এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়েছে। আতঙ্কে ঢাকা ছাড়ছেন মানুষ। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে চালু থাকবে জরুরী সেবা। ২৬ মার্চ থেকে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ॥ করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগামীকাল ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে বাসসহ সকল প্রকার গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজ মন্ত্রণালয় থেকে ভিডিও বার্তায় গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেন। বার্তায় তিনি বলেন, দেশের মানুষ, যাত্রীসাধারণ, গাড়ির মালিক শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে আগামী ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে গণপরিবহন লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ওষুধ, জরুরী সেবা, জ্বালানি, পচনশীল পণ্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। পণ্যবাহী যানবাহনে কোন যাত্রী পরিবহন করা যাবে না। বাস-ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ কান্তি বলেন, সরকার আমাদের এমন কোন সিদ্ধান্ত দিলে তাহলে অবশ্যই আমরা পরিবহন বন্ধ করে দেব। তিনি জানান, এমনিতেই গণপরিবহনে যাত্রী কমেছে। বিকেলে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, গণপরিবহন বন্ধে আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেয়েছে। নির্দেশ অনুযায়ী পরিবহন মালিকদের তা জানানো হয়েছে। সবাইকে পরিবহন বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস কারও একার সমস্যা নয়। বৈশি^ক সমস্যা। যার ফলে আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি। জনস্বার্থে সব ধরনের পদক্ষেপের সঙ্গে থাকবে পরিবহন মালিক শ্রমিকরা। পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী উল্লেখিত সময় পর্যন্ত সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকবে। তিনি বলেন, জনস্বার্থে সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত পরিবহন মালিকরা। অনির্দিষ্টকালের জন্য ট্রেন বন্ধ ॥ সরকারের পক্ষ থেকে ১০ দিনের আনুষ্ঠানিক ছুটি ঘোষণার পরদিন সকাল থেকেই ট্রেন চলাচল সিমীত করা হয়। বিকেলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে দেশের সকল রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রীবাহী রেল চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার রেল মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এ ঘোষণা দেন। এরপর সন্ধ্যা থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়। পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী। মন্ত্রী জানান, যেসব রেল বিভিন্ন বেজ স্টেশন থেকে ঢাকায় এসেছে, তারা আবার ফিরে যাওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে তেল, খাদ্যসহ জরুরী পণ্য পরিবহনের জন্য সীমিত আকারে ট্রেন চলবে। এর আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে রেলওয়ের সব লোকাল ও মেইল ট্রেন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা ॥ দেশের সব রুটে আজ মঙ্গলবার থেকে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নৌ-মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর খান। বিআইডব্লিউটিএ জানায়, করোনার বিস্তার রোধে সারাদেশে মঙ্গলবার থেকে যাত্রীবাহী নৌ চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে পণ্যবাহী নৌ চলাচল করবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিকেল থেকে দেশের নদীবন্দরে চলাচলকারী সব যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে মন্ত্রণালয় থেকে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত অব্যাহত থাকবে। বিআইডব্লিউটিএ-এর পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, পন্টুনে আজ যতগুলো লঞ্চ ভিড়েছে সেগুলো ছাড়ার পরে এ আদেশ কার্যকর হবে। বন্ধ ফেরিঘাট ॥ দেশের অন্যতম প্রধান দুই ফেরিঘাটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দুপুরের পর থেকে মুন্সীগঞ্জে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে এবং মানিকগঞ্জ থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি রুটে সব ধরনের ফেরি চলাচল বন্ধ থাকবে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের উপমহাব্যবস্থাপক (এজিএম) শফিকুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এদিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি সেক্টরের ডিজিএম (ভারপ্রাপ্ত) জিল্লর রহমান জানান, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুট মঙ্গলবার বিকেল নাগাদ লকডাউন হয়ে যায়। দেশের শ্রমিক, ক্ষেতমজুর ও কৃষকের অধিকার আদায়ের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতি, বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র এক যৌথ বিবৃতিতে বৈশ্বিক করোনা মহামারী পরিস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য, খাদ্য ও চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। বিবৃতিতে শ্রমিক, কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ দেশের মেহনতি মানুষকে এক চরম সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে দাবি করে অবিলম্বে উপযুক্ত চিকিৎসা, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা, রেশনিং ব্যবস্থা চালু এবং সকল প্রকার ছাটাই-জোরপূর্বক অব্যাহতি ও লে-অফ বন্ধ করে সবেতন ছুটির দাবি জানানো হয়। শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় সংগঠনের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি জানানো হয়।
×